আঠেরো শতকের মাঝামাঝির সময়। কল্যাণীর ঘোষপাড়া গ্রামে হাজির হলেন এক ফকির। তখন অবশ্য ‘কল্যাণী’ নামটির জন্মই হয়নি। কাঁচরাপাড়ার সীমানার মধ্যেই পড়ত গ্রামটি। সে যাইহোক, ফকিরের নাম আউলচাঁদ। ঘোষপাড়া গ্রামেরই জনৈক বাসিন্দা রামশরণ ঘোষকে সারিয়ে তুললেন মৃতপ্রায় দশা থেকে। সামান্য কমণ্ডলুর জলের সাহায্যেই। আর, জন্ম হল একটি মিথের। যে মিথ প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে উদ্বেলিত করে আসছে বাংলার অসংখ্য নরনারীকে। কিন্তু কী সেই মিথ?
সে-প্রসঙ্গে ঢোকার আগে, কাহিনি আরেকটু এগোনো প্রয়োজন। আউলচাঁদের অলৌকিক ক্ষমতায় মুগ্ধ রামশরণ ও তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী। সর্বপ্রথম তাঁরাই দীক্ষা নিলেন আউলচাঁদের কাছে। ধীরে ধীরে, আরও অনেকে। ইতিহাস বলে, ঘোষপাড়া গ্রামে মোট ২২ জন শিষ্য ছিলেন আউলচাঁদের। জন্ম নিল বাংলার আরেকটি লৌকিক সম্প্রদায়। ‘কর্তাভজা’।
আরও পড়ুন
নবদ্বীপ ও কলকাতায় পা রেখেছিলেন গুরু নানক, দেখা হয়েছিল চৈতন্যের সঙ্গে?
কারা এই কর্তাভজা? কর্তাটিই বা কে? এসব প্রশ্ন উঠলে পথ গুলিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক। অল্প কথায় বলতে গেলে, কর্তাভজা ধর্মের মূল হলেন গুরু। গুরু ভজলেই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছনো যায়। অথবা, গুরুই ঈশ্বর। এর জন্যে মন্দির-মসজিদে ছোটাছুটির দরকার নেই। গুরুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করলেই হল। না, সন্ন্যাসী হতে হবে না তার জন্য। গৃহী থেকেই শরণ নেওয়া যায় তাঁর।
এমনই সহজ মতে চলেন কর্তাভজারা। মধ্যযুগের বাংলায়, বৈষ্ণব ধর্মের একাধিক উপসম্প্রদায়ের একটি। বাউল-ফকিরদের সঙ্গে মিল পেতেই পারেন আপনি। আবার, কতদিক দিয়েই না আলাদা!
আরও পড়ুন
শুধুই মূর্তি নয়, প্রাণ আছে কালীর – প্রতিমার পা চিরে নাকি রক্ত বের করেছিলেন কমলাকান্ত
আউলচাঁদের প্রসঙ্গে ফিরি। আনুমানিক ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে জন্ম তাঁর। উলা বীরনগরের পানচাষি মহাদেব বারুই। তাঁরই পানের বরজে একদিন এক অদ্ভুত শিশুর দেখা মেলে। নাম রাখা হয় পূর্ণচন্দ্র। পরবর্তীকালে, সেই পূর্ণচন্দ্রই ফুলিয়ার বলরাম দাসের কাছে দীক্ষা নেন এবং ‘আউলচাঁদ’ নামে পরিচিত হন।
কর্তাভজাদের কাছে, এই আউলচাঁদই হলেন চৈতন্যের অবতার। তাঁদের বিশ্বাস, স্বয়ং শ্রীচৈতন্যেই অন্তর্ধানের পর ফিরে এসেছেন আউলচাঁদের রূপ নিয়ে। আউলচাঁদের মৃত্যুর পর, রামশরণ ও তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবী কর্তাভজা ধর্মকে ছড়িয়ে দেন সাধারণ মানুষের কাছে। মৃত্যুর আগে আউলচাঁদ বলে গিয়েছিলেন, পরবর্তী জীবনে সরস্বতী দেবীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করবেন তিনি। কর্তাভজাদের বিশ্বাস, সরস্বতী দেবীর সন্তান দুলালচন্দ্র ওরফে দুলালচাঁদ আসলে আউলচাঁদেরই নবজন্ম। চৈতন্য থেকে আউলচাঁদ হয়ে দুলালচাঁদ – পরম্পরা কেমন মিলেমিশে যায় কর্তাভজাদের মনে!
আরও পড়ুন
দই-চিঁড়ে উৎসব শুরু করেছিলেন নিত্যানন্দ, ‘হাজির’ চৈতন্যও, তাঁরাও বাংলাদেশি?
এই সরস্বতী দেবীই কর্তাভজাদের কাছে পরিচিত হয়েছিলেন ‘সতীমা’ নামে। রামশরণের মৃত্যুর পর, তিনিই হাল ধরেন এই সম্প্রদায়ের। তাঁর সন্তান দুলালচাঁদের সময়ে, প্রচারের শিখরে পৌঁছয় এই উপসম্প্রদায়। শহুরে বাঙালির ব্যাঙ্গ-কুৎসা-বিদ্রুপ উপেক্ষা করে, সেই থেকেই রমরমা কর্তাভজাদের। যা থামেনি আজও।
মূল উৎসব দোলের আগের দিন। আজও কল্যাণী ঘোষপাড়ায় হাজির হলে দেখা যায়, সতীমার থানে হত্যে দিয়ে পড়ে আছেন অজস্র নরনারী। ভিড় ডালিমতলাতেও। সেই ডালিমতলা, যার নিচে ‘অলৌকিক’ উপায়ে সকলের রোগ দূর করতেন সতীমা। হিমসাগর পুকুরে স্নান সেরে, দণ্ডি কেটে ডালিমতলায় হাজির হন নরনারী। বুকের মধ্যে পুষে রাখা মানত। লোকাচার আর অন্ধবিশ্বাসের এক আশ্চর্য মিলমিশ সেখানে।
দোল উপলক্ষে বসে মেলাও। আর পাঁচটা মেলার থেকে চরিত্রগতভাবে আলাদা ঘোষপাড়ার মেলা। দু’বাংলা থেকে হাজির হন অসংখ্য ভক্ত। বাউল-ফকির-দরবেশদের ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে চারপাশ। সারারাত চলে গান। মাইক থেকে নিভৃত আখড়া – জনসমাগম সব জায়গাতেই। তেরাত্তির কাটিয়ে, দোলের দিন সকালে আবির মাখিয়ে দেন প্রত্যেকে, একে অপরকে। তারপর, বাড়ি ফেরা। মনে বিশ্বাস, সতীমা মঙ্গল করবেন সকলের। বিশ্বাসীদের মনে হিন্দু-মুসলমান ভেদ নেই। ভেদ নেই উচ্চ-নীচেরও। সকলেই মানুষ। সকলেই ভজন করেন কর্তার। আউলচাঁদের দয়া হলে, আর সতীমা একবার আশীর্বাদ করলে, মঙ্গল রোখে সাধ্যি কার!
আরও পড়ুন
বর্ধমানের জঙ্গলের এই দুর্গাকেই ভারতমাতা হিসেবে পূজা করতেন স্বদেশি বিপ্লবীরা
বিশ্বাস এমনই এক আশ্চর্য বস্তু। দুশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বিশ্বাসই মানুষকে টেনে আনছে ঘোষপাড়ার মেলায়। আনবে আরও। বাংলার লৌকিক ধর্মসম্প্রদায়দের এই বৈচিত্র্যই আসলে বাংলার আসল স্পন্দন। নগরায়ন, আধুনিকতা ও ছুটতে-থাকা সময় যার হৃদয়ে আঘাত হানতে পারেনি। সে-কারণেই লালনের গানের সঙ্গে মিলে যায় দুলালচাঁদের ভাবের গীত। সুদূর বীরভূমের তান্ত্রিকের চাটাইয়ে বসে গঞ্জিকা সেবন করে শহুরে যুবক। ঘোষপাড়ার মেলা আসলে এই মিলনের কথাই বলে। ভেদহীন এক আশ্চর্য মিলন। যার শেষে শুধু জেগে থাকে একটাই পরিচয় – মানুষ…