শেকসপিয়রের নাটক ও একটি অগ্নিকাণ্ড

এটি সেই সময়কাল, যখন রানি এলিজাবেথ 'প্রথম' ইংল্যান্ডের (England) সিংহাসনে বসেন। কয়েক বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর ইংল্যান্ড তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছে। কারণ সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রে ইংল্যান্ডের কদম বেশ মজবুত। সাহিত্য-শিল্পাঙ্গনেও ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা। বই লেখা, কবিতা লেখার সঙ্গে নাট্যজগতেও ঘটে নতুন নতুন আবিষ্কার। ততদিনে সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বিরাজ করছেন। তাঁর জনপ্রিয়তাও ঈর্ষণীয়। উইলিয়াম শেকসপিয়র (William Shakespeare)। ১৫৯৯ সাল। শেকসপিয়র তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে লন্ডনে একটি রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। তার নাম 'গ্লোব থিয়েটার' (Globe Theatre)।

তখন নাট্যব্যবসা বিকশিত হলেও সামাজিক মর্যাদা পায়নি। নাটক, থিয়েটারের স্থান বাণিজ্যিক মর্যাদার সিঁড়িতে খুবই নিচে ছিল। এই কারণে, 'গ্লোব' লন্ডন শহরের মাঝখানে নয়, শহরের বাইরে তৈরি করা হয়েছিল৷ অর্ধবৃত্তে নির্মিত এই গ্লোব ছিল 'ওপেন এয়ার' থিয়েটার হল। এর বায়ুকাঠামো উন্মুক্ত। তার মধ্যে একটি, গ্লোবের দর্শক ধারণক্ষমতা বন্ধ থিয়েটার হলের তুলনায় বহুগুণ বেশি।

থিয়েটারটি এতটাই বড় ছিল যে, প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার মানুষ একসঙ্গে নাটক দেখতে পারতেন। থিয়েটার হলটি উন্মুক্ত থাকায় বাইরের আলো ঢুকত সহজেই। মোমবাতি, প্রদীপ বা টর্চের প্রয়োজন ছিল না। এমনকী লাইটিং স্কিমেও বিরাট খরচ পড়ত না। অতিরিক্ত এই খরচগুলি কম হওয়ায় টিকিটের দামও কম রাখা যেত। এ-কারণে সাধারণ মানুষ অনায়াসে টিকিট কিনে রঙ্গমঙ্গে 'রঙ্গ' করে নাটক দেখতেন। সেই ‘এক পয়সা’র টিকিটগুলি কিন্তু তৎকালীন বিশ্বে থিয়েটার ব্যবসা এবং বিশেষ করে শেকসপিয়রের নাটকগুলিকে সামাজিক জীবনের সমস্ত স্তরে পৌঁছে দেয়।

নাটকের পোশাক কিংবা সেটের পেছনে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করতেন না নির্মাতারা। এসবের তেমন গুরুত্ব তখনও অনুভূত হয়নি। পুরো কাজটাই 'ওজনদার' সংলাপের ওপর। নাট্যমঞ্চে শিল্পীদের উচ্চকণ্ঠ ধ্বনিত হলে দর্শকরা মোহিত হতেন। করতালির বজ্রধ্বনিতে তেতে উঠত হল। দর্শকরা নাটক দেখার চেয়ে নাটক শোনার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিলেন। সংলাপে জমে উঠত পরিবেশ। এভাবেই সপ্তাহের পর সপ্তাহ হিট শো চলত।

আরও পড়ুন
থিয়েটারের জন্য চড়া সুদে টাকা ধার, গ্রেপ্তার হতে হয়েছিল ‘দেউলিয়া’ শিশির ভাদুড়িকে

রঙ্গমঞ্চের ঠিক পাশের জায়গাটি ‘ওয়ান পেনি' টিকিটধারীদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। এর নাম 'পিট'। তবে, এমনও জায়গা ছিল, যেখানে সিট না থাকলেও ছিল দাঁড়ানোর জায়গা। 'হয় দাঁড়ান কিংবা মাটিতে আপনার আসন ঠিক করুন'— এমনটাই নিয়ম। থিয়েটারের প্রবেশপথে রাখা থাকত 'বাক্স'। যাতে নাটকটি দেখে যে যাঁর মতো অনুদান দিতেন। বাক্সে জমা হওয়া আর্থিক পরিমাণ সেই দিনের লাভ বা ক্ষতি নির্ধারণ করত। এই 'বক্স অফিস কালেকশন' কনসেপ্টটি কিন্তু সেই সময় থেকে আজ অবধি অনুসরণ করা হয়।

আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও বাঙালির তৈরি প্রথম থিয়েটারের গল্প

গ্লোবের একটি সম্পূর্ণ শো-তে দর্শকরা অভিনেতাদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারতেন। মঞ্চে নাটক চলাকালীন তাঁরা স্বাধীনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতেন। শ্রোতাদের বিশেষ চাহিদায় কখনও সংলাপের পুনরাবৃত্তি করা হত আবার কখনও তা পরিবর্তনও করা হত। সুতরাং প্রশংসার করতালিও যেমন জুটত, সমালোচনাও বাদ যেত না। পিট-এর চারপাশে তিনটি সারফেস অবজারভার গ্যালারিও তৈরি করা হয়েছিল। গ্যালারিতেই বসার ব্যবস্থা। বিশেষ এই গ্যালারির মাথার উপর ছিল ছাদ। স্বাভাবিকভাবেই এখানকার টিকিটের দামও তাই বেশি।

১৬১৩ সালের ২৯ জুন। থিয়েটার চলছে গ্লোব থিয়েটারে। মঞ্চায়ন হচ্ছে উইলিয়াম শেকসপিয়র এবং জন ফ্লেচার রচিত 'হেনরি এইট' (অষ্টম হেনরি)। ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরিকে নিয়ে লেখা এ-নাটক। মঞ্চে অনুষ্ঠানের দৃশ্য। দৃশ্যায়নে 'তোপ স্যালুট'। দুর্ভাগ্যবশত, কামান থেকে নির্গত স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে সরাসরি গ্লোবের ছাদে চালে যায়। কাঠের গ্লোব থিয়েটার জ্বলে ওঠে। মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে পুরো রঙ্গমঞ্চ পুড়ে ছাই হয়ে যায়। যদিও এই ঘটনার পর, মাত্র দুই বছরের মধ্যে গ্লোব পুনর্নির্মিত হয়।

১৬৪২ সাল। ইংল্যান্ডে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার বাতাবরণ। জনগণ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। নতুন সরকার গঠিত হয়। এই পিউরিটান বিপ্লবের কারণে গোটা নাট্যজগৎকেই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ইংল্যান্ডে নাটক বানানো ও দেখা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে শুরু করে। তখন সমস্ত প্রেক্ষাগৃহের মতো বন্ধ হয়ে যায় গ্লোবও। ধ্বংস করে দেওয়া হয় থিয়েটার হল। পরবর্তী সাড়ে তিনশো বছরে ইংল্যান্ডের মাটি এবং জনসাধারণের হৃদয় ও মন থেকে গ্লোব থিয়েটারের নাম সম্পূর্ণ মুছে যায়। যে রঙ্গমঞ্চের জন্য জুলিয়াস সিজার, হ্যামলেট, ওথেলো, ম্যাকবেথ, কিং লিয়ারের মতো গল্প রচিত, যেখানে নাটকগুলি প্রথমবারের মতো মঞ্চস্থ, তা চলে যায় বিস্মৃতির আড়ালে। তবে ১৯৯৭ সালে প্রায় চার শতক পর হেনরি ভি-এর প্রযোজনায় খোলা হয় ‘শেকসপিয়র গ্লোব'। এই হল ১৫৯৯ এবং ১৬১৩-র গ্লোবের প্রামাণ্য নকশার ভিত্তিতে তৈরি। ঐতিহাসিক গ্লোব যে জায়গায় অবস্থিত, তার থেকে ৭৫০ ফুট (২৩০ মিটার) দূরে এই শেকসপিয়র গ্লোব। ইতিহাস হয়তো এভাবেই পুনর্নির্মিত হয়।

Powered by Froala Editor