প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও বাঙালির তৈরি প্রথম থিয়েটারের গল্প

প্রায় ২০০ বছর আগের কথা। কলকাতায় জাঁকিয়ে বসেছে ইংরেজরা। সমানতালে চলছে দেশশাসন আর বিনোদন। ১৭৯৩-তে ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ চালু হওয়ার পর এক শ্রেণির বাঙালির হাতেও এসেছে প্রচুর অর্থ। ব্যবসা, দেওয়ানি, জমিদারি, চাকরি—ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশা ক্রমেই বাড়ছে। সেই সূত্রেই বাঙালির চোখে পড়ে এক আশ্চর্য জিনিস—থিয়েটার। দেশে যাত্রাপালা, কবিগান, খেউড় ইত্যাদি ছিল ঠিকই, কিন্তু থিয়েটার আলাদা জাতের। হিন্দু কলেজের সৌজন্যে ইংরেজি শিক্ষার হাওয়া লেগেছে পালে। অতএব, থিয়েটার করতে হবে বাঙালিকেও। 

কলকাতায় তখন থিয়েটার ব্যাপারটা ইংরেজদের একচেটিয়া। ‘চৌরঙ্গী থিয়েটার’ তো রীতিমতো পাল্লা দেয় লন্ডনের দলগুলির সঙ্গে। থিয়েটারের আলো, মঞ্চসজ্জা, পোশাকের চাকচিক্যে ধনী বাঙালিবাবুরা মুগ্ধ। এবার নিজেদের জন্যও এরকম ব্যবস্থা দরকার। এগিয়ে এলেন প্রসন্নকুমার ঠাকুর। পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির বিখ্যাত সন্তান। পেশায় আইনজীবী। সমাজসংস্কারেও ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।

১৮৩১ সালে তাঁর হাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালির প্রথম থিয়েটার। ১৭ সেপ্টেম্বরের ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকা বলছে, প্রসন্নকুমার তাঁর বাড়িতে একটি আলোচনাসভা ডাকেন। উপস্থিত থাকেন শ্রীকৃষ্ণ সিংহ, কৃষ্ণচন্দ্র দত্ত, গঙ্গানারায়ণ সেন প্রমুখরা। প্রত্যেকেই জমিদার। নামের আগে রয়েছে ‘বাবু’ উপাধি। তাঁদের নিয়ে তৈরি হয় একটি কমিটি। নাম ঠিক হয় ‘হিন্দু থিয়েটার’। প্রসন্ন ঠাকুরের নারকেলডাঙার বাগানবাড়িতে শুরু হয় পথচলা। 

তবে এ থিয়েটার বাঙালির হলেও বাংলার হল না। বাংলা ভাষায় কোনো নাটক এখানে অভিনীত হয়নি। ২৮ ডিসেম্বর অভিনীত হয় শেকস্‌পিয়রের ‘জুলিয়াস সিজার’ নাটকের অংশ বিশেষ এবং ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’-এর ইংরেজি অনুবাদ। হ্যাঁ, সংস্কৃত নাটকটি অভিনয় করা হয়েছিল অনুবাদ করেই। অনুবাদক ছিলেন উইলসন সাহেব। সাজসজ্জা ও রীতিনীতিতেও ছিল ইংরেজ থিয়েটারের স্পষ্ট ছাপ। ১৮৩২-এর মার্চে ‘নাথিং সুপারফ্লয়াস’ নামের আরেকটি ইংরেজি নাটক অভিনীত হয় এখানে।

আরও পড়ুন
প্রসন্নকুমার ঠাকুরের হাত ধরেই আদালতে ঢুকেছিল বাংলা ভাষা

থিয়েটার কর্তৃপক্ষ কিন্তু এ বিষয়ে ঘোষণা করেই রেখেছিল। ‘বাঙালির থিয়েটার’-এ ইংরেজি নাটকের অভিনয় নিয়ে কেউ কুমন্তব্যও করেনি। কারণ একটাই, বাংলায় নাটক নেই। প্রসন্ন ঠাকুরের নাট্যমঞ্চ প্রতিষ্ঠার তিরিশ বছর পরে লেখা হয় প্রথম বাংলা নাটক। মাতৃভাষার মধ্যে নাটক তৈরির ক্ষমতা আছে, সেটাও ছিল অবিশ্বাস্য। ইংরেজি ভাষায় হয়, সেখানে শেকস্‌পিয়র আছেন। কিন্তু বাংলায় নাটক লেখা যায় না। এই ছিল প্রচলিত বিশ্বাস।

আরও পড়ুন
বিলেত থেকে কলকাতায় এল সাইকেল, দেখাদেখি বানালেন সাঁতরাগাছির প্রসন্নকুমারও

তাছাড়া বাংলায় লিখলে ইংরেজরা বুঝবেই বা কী করে? হিন্দু থিয়েটারের নাটক দেখতে যেতেন স্যার এডওয়ার্ড রায়ান, কর্নেল ইয়ং-সহ সম্ভ্রান্ত ইংরেজরা। তাঁদের সামনে বাঙালি বালকরা রাম-লক্ষণ-সীতা সেজে ভাঙা ইংরেজিতে রামকাহিনি অভিনয় করছে এবং তাঁরা উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন। এরকমই ঘটত। ‘সমাচার দর্পণ’-ও সাধুবাদ জানিয়েছিল প্রসন্ন ঠাকুরের প্রয়াসকে। বাবু সম্প্রদায় যেভাবে আমোদপ্রমোদে লক্ষ লক্ষ টাকা উড়িয়ে দেয়, তার চেয়ে থিয়েটার করা ‘অবশ্যই উত্তম’।

প্রসন্নকুমার নিজে শিক্ষালাভ করেছিলেন ইংরেজ শিক্ষকদের কাছে। বনেদি বংশের সন্তানদের জন্য তাই ছিল রীতি। আর রাজা দর্পনারায়ণের পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুরবাড়ির নামে সম্ভ্রম প্রকাশ করত ইংরেজরাও। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নামডাক তখনও শুরু হয়নি। সেই পরিবারে জন্ম প্রসন্ন ঠাকুরের। ইংরেজি তো বটেই, ফার্সি, সংস্কৃত, উর্দুতেও ছিল দখল। তাঁর হাত ধরেই কলকাতার আদালতে মান্যতা পায় বাংলা ভাষা। 

সে গল্প অবশ্য অনেক পরের। ১৮৩৮ সালে। ততদিনে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছেন জোড়াসাঁকোর দ্বারকানাথ ঠাকুর। কমছে ইংরেজি থিয়েটার দলগুলির দাপট। খুলতে শুরু করেছে বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চার পথ। উনিশ শতকের ‘নবজাগরণ’-এর আলো প্রবেশ করেছে কলকাতায়। ১৯৩৫-এ নবীন বসু বাংলায় ‘বিদ্যাসুন্দর’ অভিনয় করে সকলের তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। 

১৮৩২-এই উঠে যায় ‘হিন্দু থিয়েটার’। বাংলা থিয়েটারের পরবর্তী ধাপগুলির জন্য তৈরি করে যেতে পারেনি বিশেষ কোনো ঐতিহ্য। কিন্তু প্রসন্নকুমার ঠাকুর প্রমাণ করতে পেরেছিলেন দর্শকাসন থেকে হাততালি দেওয়ার দিন শেষ। ইংরেজের সঙ্গে টক্কর দিয়ে থিয়েটারের মালিক হওয়ার কৌলিন্য অর্জন করতে বাঙালি শিখে গেছে। 

তথ্যসূত্র :
বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস, ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor

Latest News See More