বৃষ্টির বদলে ঝরে পড়ছে জেলির মতো পদার্থ, প্রকৃতির খেলা নাকি গোপন অস্ত্রপরীক্ষা?

আমেরিকার ওয়াশিংটন রাজ্যের ওকভিলে (Oakville) শহর। ছোট্ট, গাছপালায় ঘেরা। বেশ ধীরেসুস্থে কাটে লোকজনের জীবন। আবহাওয়াও বেশ মনোরম। সবে ১৯৯৪ সালের আগস্ট মাস পড়েছে। গরম খুব একটা নেই। কাল রাতে বৃষ্টিও হয়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। আকাশের মুখ ভার সকাল থেকেই। পুলিশ অফিসার ডেভিড লেসি গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন কর্মস্থলের দিকে। আচমকাই নামে বৃষ্টি। অভ্যাসবশত চালু করে দেন গাড়ির উইন্ডশিল্ডটা। কিন্তু গাড়ির কাচ পরিষ্কার হচ্ছে না কেন? বরং কিছু একটা চটচটে পদার্থ আটকে বন্ধ হয়ে গেছে সামনের দৃষ্টিপথ। গাড়ি থেকে নেমে পড়েন লেসি। কাচে হাতে দিয়ে বুঝতে পারেন, বৃষ্টি নয়। তার গাড়ির কাচে লেগে আঠালো জাতীয় কোনো বস্তু। যদিও সেটা কী জিনিস বোঝার ক্ষমতা তাঁর নেই।

শুধু ডেভিড লেসি নন, সেই অদ্ভুত জিনিসের রহস্য আবিষ্কার করতে পারেননি বিজ্ঞানীরাও। ওকভিলের মানুষ সেদিন সাক্ষী হয়েছিলেন এক অতিপ্রাকৃত ঘটনার। ঘুম থেকে উঠে দেখেন শহরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পড়ে রয়েছে জেলির মতো একপ্রকার পদার্থ। কোনোটির আকার চালের দানার মতো, কোনোটি যেন ইটের ছোটো টুকরো। বোঝাই যাচ্ছে বৃষ্টির সঙ্গে আকাশ থেকে নেমে এসেছে এগুলো। হাতে ধরে দেখেছেন অনেকে। নরম, চ্যাটচেটে জাতীয়। 

স্বাভাবিকভাবেই এই দৃশ্যে হকচকিয়ে যান ওকভিলের মানুষ। যেন মহাজাগতিক কোনো রহস্য আছড়ে পড়েছে তাদের শহরে। সারাদিন ধরে চলে জল্পনা। উঠে আসতে থাকে ‘এলিয়েন’-এর তত্ত্ব। কী এই জিনিস? উত্তর দিতে পারছিলেন না কেউই। প্রাথমিক ঘোর কাটতেই শুরু হল অন্য বিপদ। দুদিন পর স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হন এক বৃদ্ধ ও তাঁর মেয়ে। জ্বর, সর্দিকাশি, প্রচণ্ড মাথাব্যথা, সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। পরীক্ষায় হৃদযন্ত্রে সামান্য সমস্যাও ধরা পড়ে। ডাক্তাররা কিন্তু এই রোগের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারলেন না। অবশ্য কদিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ওঠেন তাঁরা।

পরদিন শহরের বিভিন্ন হাসপাতালে পাঁচজন রোগী ভর্তির রিপোর্ট পাওয়া যায়। প্রত্যেকেরই এক সমস্যা। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, এঁরা কোনো না কোনোভাবে সেদিনের আঠালো পদার্থের সংস্পর্শে এসেছেন। কদিনের মধ্যে বহু মানুষের শরীরে দেখা দেয় একই উপসর্গ। আতঙ্কের অন্য নাম হয়ে ওঠে ওকভিলে। তবে সৌভাগ্যের বিষয়, প্রাণহানি হয়নি কারোরই।

আরও পড়ুন
অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন চোখের সামনে, আজও অধরা অ্যালকেমিস্ট ফুলকানেল্লির রহস্য

বিজ্ঞানীরা অবশ্য পরে অনুমান করেছিলেন, ওই পদার্থটির মধ্যে দু-ধরনের ব্যাকটেরিয়া ছিল। তার প্রভাবেই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন অনেকে। কিন্তু পরবর্তী গবেষণা বলছে, ওই ব্যাকটেরিয়া দুটি মানুষের পক্ষে ক্ষতিকারক নয়। তবে?

আরও পড়ুন
মহাকাশ-ফেরত চেরি বীজ থেকে জন্মানো আশ্চর্য গাছ, আজও যা রহস্য গবেষকদের কাছে

উত্তর আসেনি। ওকভিলে-র রহস্যময় পদার্থকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পরীক্ষার জন্য। কিন্তু তারপর আর হদিশ মেলেনি সেগুলির। গলে গেছে, বাষ্প হয়ে গেছে, নাকি চুরি হয়ে গেছে, সে বিষয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। এরকম একটা আশ্চর্যজনক কাণ্ড ঘটল, অসুস্থ হল গোটা শহরের মানুষ—অথচ কোনো পদক্ষেপই নিল না প্রশাসন। নমুনা না থাকায়, বস্তুটির জানা গেল না আসল পরিচয়ও।

অবশেষে সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছে গুজব আর কল্পনা দিয়ে। জন্ম নিয়েছে অসংখ্য তত্ত্ব। সেগুলিও নেহাৎ ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এগুলি কি আমেরিকা সরকারের কোনো গোপন জৈব অস্ত্র? যা কদিনের মধ্যে অসুস্থ করে দিতে পারে একটা শহরকে? ওকভিলে-কে হয়তো বেছে নেওয়া হল পরীক্ষার গিনিপিগের মতো। আর তার জন্যই গায়েব করে দেওয়া হল পদার্থের নমুনাগুলিকে!

অনেকের অবশ্য মত যে, এগুলি স্টার জেলি। রাস্তাঘাটে প্রায়ই দেখা যায়। টর্নেডোতে এসে পড়তে পারে। কিন্তু আকাশ থেকে স্টার জেলি পড়ার ঘটনায় বিশ্বাস করেননি অধিকাংশ মানুষ। বিশেষ করে গত কয়েকদিনে সেই অঞ্চলে কোনো ঘূর্ণিঝড় ঘটেনি। ফলে আর গাঢ় হয়েছে অস্ত্রপরীক্ষার গুজব।

নাকি সেদিনের ‘বৃষ্টিপাত’ প্রকৃতিরই কোনো নতুন ধরনের খেলা? যার ব্যাখ্যা আজও রয়ে গেছে মানুষের বোধের বাইরে। তবে ওকভিলে-তে আর কখনও ঘটেনি এই ধরনের ঘটনা। সেখানের মানুষের স্মৃতিতে জড়িয়ে গেছে ১৯৯৪-এর আগস্ট মাসের ইতিহাস। হয়তো গল্প শোনায় উত্তরপ্রজন্মকে। কিন্তু প্রশ্নগুলো আজও রয়ে গেছে অমীমাংসিত।

Powered by Froala Editor