মৃত্যুর একদিন পর প্রত্যাবর্তন, রুশ সাংবাদিকের কাহিনি হার মানায় রহস্যগল্পকেও

অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলেন তিনি। সে-সময়ই দুই দুষ্কৃতি আচমকা হামলা চালায় তাঁর ওপর। তিন-তিনবার ঝলসে ওঠে বন্দুক। বাড়ির গলির সামনেই লুটিয়ে পড়েন খ্যাতনামা রুশ সাংবাদিক ও যুদ্ধ-বিশ্লেষক। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে হাজির হয় পুলিশ। অ্যাম্বুলেন্সও চলে আসে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে। তবে ব্যর্থ হয় চেষ্টা। প্রাণ হারান সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক। 

না, সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা নয়। ২০১৮ সালের ২৯ মে। ইউক্রেনের বুকে ঘটে যায় এমনই আশ্চর্য এক ঘটনা। আর আক্রান্ত সেই সাংবাদিক আর কেউ নন, আরকেডি বাবচেঙ্কো (Arkady Babchenko)। রুশ রাজনৈতিক নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির সমর্থক এবং পুতিনের কট্টর সমালোচক বলেই পরিচিত যিনি। এমনকি রাশিয়ায় তাঁর জীবনের আশঙ্কা তৈরি হওয়ায় ২০১৬ সালে ইউক্রেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি। ফলে, আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে এই ঘটনার গুরুত্ব নতুন করে বলে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। ইউক্রেন তো বটেই, গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতাতেই জায়গা করে নেয় এই হত্যাকাহিনির গল্প। কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় রাশিয়া তথা রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে। রুশ গোয়ান্দারাই চক্রান্ত করে এই হত্যালীলা চালিয়েছে— তা নিয়েই উঠে আসে একাধিক তত্ত্ব। 

তবে এই গল্প এই হত্যাকাহিনি নিয়ে নয়। বরং, মৃত্যুর পরেও ফিরে আসা নিয়ে। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। মৃত্যুর পরও প্রত্যাবর্তন। বাবচেঙ্কোর গল্প সেখানেই হয়ে ওঠে নাটকীয় কাহিনি। 

এই হত্যাকাণ্ডের ঠিক ২৪ ঘণ্টা পরেই ইউক্রেনের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে হাজির হন বাবচেঙ্কো। জানান, তিনি সুস্থ আছেন সম্পূর্ণভাবে। তাঁর ওপর হামলা হয়েছিল ঠিকই, তবে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল ইউক্রেনের গোয়েন্দা বিভাগ। হামলাকারীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ এবং তাঁদের গ্রেপ্তার করার জন্যই, বাবচেঙ্কোর মৃত্যুকে এইভাবে উপস্থাপন করেছিল ইউক্রেনের পুলিশ ও গোয়েন্দারা। 

হ্যাঁ, বাবচেঙ্কোকে টেলিভিশনে ‘লাইভ’ অনুষ্ঠানে দেখে চমকে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। নতুন করে চর্চা শুরু হয়েছিল এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে। ঘোলা হয়ে উঠেছিল বিতর্কের জল। উঠতে শুরু করে একাধিক প্রশ্ন। কেন নাটকীয়ভাবে সাজানো হল বাবচেঙ্কোর হত্যাকাহিনি? যদি সত্যিই প্রাণনাশের ঝুঁকি থাকত তাঁর, তবে তা জেনেও কেন তাঁকে শুধুমাত্র ‘টোপ’ হিসাবে ব্যবহার করল ইউক্রেনের পুলিশ? 

এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে, কেন রাশিয়া ছেড়ে ইউক্রেনে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাবচেঙ্কো, তা বলে নেওয়া দরকার। আসলে নব্বই-এর দশকে রাশিয়ার সেনাবাহিনিতে কাজ করেছেন বাবচেঙ্কো। তারপর তিনি পা রাখেন সাংবাদিকতার দুনিয়ায়। বিশেষত যুদ্ধ বিষয়ক প্রবন্ধ এবং যুদ্ধ বিশ্লেষক হিসাবেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন তিনি। একুশ শতকের প্রথম দশকে দেশের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর। তবে ২০১২ সাল থেকেই ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে তাঁর অবস্থান। প্রথমত, রাশিয়া ক্রাইমিয়া অধিগ্রহণ এবং সিরিয়ার যুদ্ধে রুশ অবস্থানের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন তিনি। রাষ্ট্রের সঙ্গে এই সংঘাত চরমে পৌঁছায় ২০১৬ সালে। রাশিয়ার সৈন্যবাহী একটি যুদ্ধবিমান সিরিয়ায় অভিযান চালানোর সময়ই ভেঙে পড়ে মাঝপথে। দুঃখপ্রকাশ তো দূরের কথা, ব্যাপারটিকে ইতিবাচক বলেই চিহ্নিত করেছিলেন তিনি। আর তারপরই তাঁর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয় রাশিয়ায়। বাবচেঙ্কো আশ্রয় নেন ইউক্রেনে। 

তবে শুধু বাবচেঙ্কোই নন, রুশ প্রশাসনের চক্ষুশূল হয়ে ওঠার এই তালিকায় ছিলেন আরও বেশ কিছু সাংবাদিক। যাদের মধ্যে অনেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাশিয়ায়, কেউ আশ্রয় নেন অন্যদেশে, কেউ আবার রহস্যজনকভাবে মারা যান। বাবচেঙ্কোকেও একইভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল বলেই দাবি করেছিল ইউক্রেন। 

২০১৮ সালের ৩০ মে সাংবাদিক সম্মেলনে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পেত্র পরোশেঙ্কো জানান, রাশিয়ার গোপন পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরেছিল ইউক্রেনের গোয়েন্দারা। শুধু বাবচেঙ্কোই নন, ইউক্রেনে আশ্রয় নেওয়া ৩০ জন সাংবাদিককে হত্যার চক্রান্ত ছিল রুশ গোয়েন্দাদের। আর তাঁদের সম্পর্কে তথ্য সংরক্ষণ করতে এবং সরাসরি আটক করতেই এই ছক সাজানো হয়েছিল। প্রস্তুত রাখা হয়েছিল পুলিশ বাহিনি এবং অ্যাম্বুলেন্স। এমনকি বুলেট-প্রুফ জ্যাকেট আগে থেকেই পরানো ছিল বাবচেঙ্কোকে। যদিও এই ঘটনার পর সন্দেহভাজন বা আক্রমণকারী— কাউকেই গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয় ইউক্রেনের পুলিশ। 

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্যের পরেও থেকে যায় বেশ কিছু প্রশ্ন। প্রথমত, যদি কোনোভাবে মাথায় গুলির আঘাত লাগত বাবচেঙ্কোর, তবে কি তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হত? দ্বিতীয়ত, কাউকে আটক করাই বা সম্ভব হল না কেন এত পরিকল্পনার পরেও? রাশিয়ার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাদের মানহানি এবং চাপ তৈরির জন্যই এই চক্রান্ত সাজায় ইউক্রেন। যদিও সেই অভিযোগ বাতিল করে দেয় ইউক্রেন। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে চিরকাল ইউক্রেনকে সমর্থন করলেও, ইউক্রেনের এই সিদ্ধান্ত এবং সাংবাদিকের মৃত্যু-উপস্থাপনাকে সেবার ‘হলুদ কার্ড’ দেখিয়েছিল ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং একাধিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমও… 

Powered by Froala Editor