রাখি পরালেই দিতে হবে টাকা, কবি মহাদেবী বর্মার কাছে আবদার আরেক কবির

ইলাহাবাদের হিন্দু বোর্ডিং হাউসে আয়োজিত এক কবি সম্মেলন। আমন্ত্রিত প্রখ্যাত কবি সুমিত্রানন্দন পন্থ (Sumitranandan Pant)। সুমিত্রানন্দনের কোঁকড়ানো বড় চুল দেখে তাঁকে মহিলা ভেবে বসলেন আর এক কবি মহাদেবী বর্মা (Mahadevi Verma)।

এটাই ছিল এই দুই মহান কবির প্রথম সাক্ষাৎ। মহাদেবী রাশভারী স্বভাবের মহিলা বটে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে দেখা করবার মানুষের অভাব ছিল না। রাখিবন্ধন, হোলি, জন্মদিনে তাঁর বাড়িতে বসত চাঁদের হাট। বিখ্যাত সাহিত্যিক গোপীকৃষ্ণ গোপেশকে তিনি রাখি পরাতেন। কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালার সঙ্গে তাঁর ভাই-বোনের মতো সম্পর্কের কথা তো জগৎ-খ্যাত। সুমিত্রানন্দন পন্থকেও রাখি পরাতেন। সুমিত্রানন্দনও রাখি বেঁধে দিতেন মহাদেবীর হাতে। এভাবে নারী-পুরুষের লিঙ্গসমতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন দুই কবির হাত ধরে।

নৈনিতাল জেলার মুক্তেশ্বর-রামগড় এলাকা থেকে হিমালয়ের অপূর্ব রূপ দেখা যায়। এখান থেকে তুষার-আচ্ছাদিত হিমালয়কে নানান রূপে দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানে দীর্ঘকাল ছিলেন। উত্তরাখণ্ডের এই হিল স্টেশন রামগড়ে 'মীরা কুঠির' প্রতিষ্ঠা মহাদেবী বর্মার। ১৯৩৩ সালে যখন শান্তিনিকেতনে যান তিনি। রবি ঠাকুরের কাছেই রামগড়ের প্রাকৃতিক শোভার পাঠ মহাদেবীর। পরের বছরই বদ্রীনাথ যান তিনি। রবীন্দ্রনাথের বর্ণনা মনে রেখেছিলেন। রামগড়ের কাছেই উমাগড় নামক একটি ছোট্ট এক গ্রাম। সেখানে একটা রাত কাটিয়ে অভিভূত মহাদেবী। ব্যস, রূপ আর প্রশান্তির মিশেল রামগড় মনে ধরে গেল। ১৯৩৬ সালে গ্রীষ্মকালে থাকার জন্য বাড়ি কিনে ফেললেন এখানে। ১৯৩৭ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত গ্রীষ্ম মানেই মহাদেবীর কাছে রামগড়। মীরা কুঠিরে থাকাকালীন 'দীপশিখা' (১৯৪২) কাব্যের পুরো কাজটি করে ফেলেন মহাদেবী। হিমালয়ের সঙ্গে মহাদেবীর ভ্রাতৃত্ব গড়ে ওঠা রামগড় পাহাড়ে। রবীন্দ্রনাথ সেই সূত্রধর। যদিও তিনি রাখিবন্ধন পালন করতেন ইলাহাবাদে। সাহিত্য জগতে মহাদেবীর রাখি উৎসব নিয়ে রয়েছেন নানান গল্প।

মহাদেবী বার্মার 'ভাই'দের মধ্যে সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা (Suryakant Tripathi Nirala) সবচেয়ে কাছের। তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে পেনশন দিত। পেনশনের টাকা যেত কোনো না কোনো অভাবীর ঘরে। পরে মহাদেবী বার্মা নিরালার টাকা বাঁচানোর দায়িত্ব নেন।

আরও পড়ুন
মসজিদে পৌঁছলেন রবীন্দ্রনাথ, রাখির বাঁধনে জড়িয়ে নিলেন মৌলবীদেরও

১৯৫০-৫১ সালের রাখি উৎসব। খুব ভোরে ইলাহাবাদে হাজির কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী নিরালা। পরিস্থিতি এমন, তাঁর কাছে রিকশাচালককে দেওয়ার মতো টাকা নেই। দিদির দরজায় পৌঁছতে না পৌঁছতেই মহাদেবীর কাছে বারো টাকা চেয়ে বসলেন। মহাদেবী টাকা এনে জিজ্ঞেস করলেন— 'বলো, আজ বারো টাকার কী দরকার?' নিরালার অক্লেশে জবাব, 'দু-টাকা এই রিকশাওয়ালার জন্য আর দশ টাকা দিতে হবে আমাকে। আজ রাখি তাই না? রাখি বাঁধার জন্য টাকা দিতে হবে।'

আরও পড়ুন
মুঘল সম্রাট হুমায়ুনকে রাখি পাঠালেন রাজপুত রানি কর্ণাবতী, সাড়া দিলেন সম্রাটও

আগেই বলা হয়েছে, সুমিত্রনন্দন পন্থ ও মহাদেবী বর্মা রাখিবন্ধনে পরস্পরকে রাখি বেঁধে নারী-পুরুষের লিঙ্গসমতার নতুন চর্চা শুরু করেছিলেন। মহাদেবীর এই আচরণের কারণে তাঁকে 'আধুনিক সময়ের মীরাবাই' বলা হয়। কবি নিরালার কাছে তিনি 'হিন্দির বিশাল মন্দিরের সরস্বতী'। 'আমি মোক্ষের চেয়ে মাটিকে বেশি পছন্দ করি।' এ হেন উচ্চারণ নিও-রোমান্টিসিজমে বিশ্বাসী ভারতের 'সিমন দ্য বোভোয়ার' মহাদেবী বর্মার। ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বই মানবতার প্রকৃত রক্ষাবন্ধন, কবি মহাদেবীর মহাজীবন এভাবেই বিশ্বাস করতে শিখিয়েছে।

Powered by Froala Editor