সমুদ্রের অতলে লুকিয়ে আড়াই হাজার বছরের ‘সংরক্ষিত’ জাহাজ, বদলে যেতে পারে ইতিহাসের ধারা

ব্ল্যাক সি (Black Sea)— রাশিয়া, তুরস্ক আর বুলগেরিয়ার মাঝে অবস্থিত একটি সমুদ্র। ইউরোপের ইতিহাসের বহু পটপরিবর্তনের সাক্ষী। তার একটি বিশেষ অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয় ‘ডেড স্পট’ (Dead Spot) নামে। অতীতে কুখ্যাত ছিল জাহাজ দুর্ঘটনার জন্য। তাহলে কি মানবসভ্যতার কোনো রহস্যের নিদর্শন লুকিয়ে আছে এর অতলে? উত্তরের সন্ধানে ২০১৬ সালে অভিযান চালায় সমুদ্র অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীদের একটি দল। রিমোটচালিত একটি নৌযান পাঠানো হল সমুদ্রের গভীরে। একটি স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরায় অবিরাম ধরা পড়ছে জলের তলার দৃশ্য। সমুদ্রের শেষপ্রান্তে পাওয়া গেল কয়েকটি ডুবে যাওয়া জাহাজের সন্ধান। কিন্তু তারপরের ঘটনায় চমকে উঠলেন বিজ্ঞানীরা।

প্রতিটি জাহাজই যেন সযত্নে সংরক্ষিত। যেন কোনো মিউজিয়ামের সাজিয়ে রাখা হয়েছে তাদের। কয়েকটি জাহাজের বয়স প্রায় হাজার বছরেরও বেশি। অথচ, জলের তলায় থাকার কোনো চিহ্নই নেই তাদের দেহে। সবকটিই যে সুন্দর করে সংরক্ষিত রয়েছে, তা বলা ভুল হবে। মাস্তুল ভেঙেছে, ভিতরের সুদৃশ্য কারুকার্যগুলিও বিলীন হয়েছে অনেকটাই। তবে সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে কাঠামোগুলি। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, জং ধরেনি কোনোটিতেই। এত বছর সমুদ্রের তলায় থাকা সত্ত্বেও প্রায় অমলিন রয়েছে জাহাজের কাঠ, জানলা, নোঙর, এমনকি দড়িগুলি পর্যন্ত। কয়েকটির গায়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে প্রস্তুতকারকের নাম। 

কী করে সম্ভব হল এই অদ্ভুত ঘটনা? ‘ডেড স্পট’-এর জলেই লুকিয়ে আছে তার কারণ। একটা পর্যায়ের পর এখানের জলস্তরে অক্সিজেনের মাত্রা ধারাবাহিকভাবে কমতে থাকে। এক সময়ে শূন্যে পৌঁছে যায় অক্সিজেন। যার ফলে অমলিন রয়ে গেছে শতাব্দীপ্রাচীন জাহাজগুলি। অটোমান, বাইজেনটিয়াম, এমনকি মধ্যযুগীয় ইতালির জাহাজের নমুনায় বোঝাই অঞ্চলটি। নবম শতাব্দী থেকে উনিশ শতকের মধ্যে ডুবেছে মোট ৪১টি জাহাজ। পাওয়া গেছে দুষ্প্রাপ্য ধাতু। তবে কোনো যুদ্ধবিগ্রহে সলিলসমাধি ঘটেনি তাদের। সম্ভবত পড়তে হয়েছিল খামখেয়ালির প্রকৃতির কোপে। জানা ছিল না ‘ডেড স্পট’-এর ঝড়ের হাত থেকে বাঁচার কোনো নির্দিষ্ট উপায়।

স্বাভাবিকভাবেই এই আবিষ্কার আরও আগ্রহী করে তোলে অনুসন্ধানকারীদের। আর সেই সন্ধানের ফলও হয় আশ্চর্যজনক। ২০১৮-তে ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও বুলগেরিয়ার একটি মিলিত সংগঠন স্বয়ংক্রিয় যান পাঠায় সমুদ্রের গভীরে। এবারের অভিযান আরও অন্ধকারে। যেখানে মানুষনির্মিত কোনো যন্ত্র আজ পর্যন্ত যেতে পারেনি। কিন্তু অতলে পৌঁছোতেই ভুল ভাঙে তাদের। সেখানেও অপেক্ষা করে আছে একটি জাহাজ। একইভাবে সংরক্ষিত। আর তার বয়স প্রায় ২৪০০ বছর। খ্রিস্টের জন্মেরও আগে ‘ব্ল্যাক সি’-র অজানা অংশে সমাধিস্থ হয়েছিল জাহাজটি।

আরও পড়ুন
মাঝসমুদ্রে জাহাজ থেকে উধাও নাবিকরা, আজও অমীমাংসিত ‘এমভি জয়িতা’-র রহস্য

প্রায় ৭৫ ফুট লম্বা জাহাজটি পাড়ি দিয়েছিল ভূমধ্যসাগরের কোনো অঞ্চলের উদ্দেশ্যে। একইভাবে ঝড়ের কারণে ডুবতে হয় সেটিকে। গ্রিসদেশীয় জাহাজটি ছিল পণ্যবাহী। ওয়াইন বা অলিভ তেলের নিদর্শনও পাওয়া গেছে তার ভিতরে। ক্যামেরার চোখে ধরা পড়েছে অপূর্ব সব নকশা। যেন হোমারের ‘ওডিসি’-তে বর্ণিত জাহাজের চেহারা বাস্তবের রূপ নিচ্ছে। আপাতত তুলে আনা হয়েছে কিছু নিদর্শন। সেকালের যন্ত্রবিদ্যা তো বটেই, দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রে মানুষ কীভাবে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করত, চলছে তারও পরীক্ষা।

আরও পড়ুন
হারিয়ে যায় জাহাজ, বিমান— বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের যমজ ‘ডেভিল সি’-র কাহিনি

আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের নমুনা এখন তাদের হাতে। তাও প্রায় অক্ষত। ইতিহাস যেন কথা বলছে! অনুসন্ধানকারী দলটির মতে, এই আবিষ্কার খুলে দিয়েছে ইতিহাসের চোখ। ইউরোপীয় সভ্যতার ধারায় সংযোজন হতে পারে নতুন অধ্যায়। দুর্গম প্রকৃতির ছায়ায় বিশ্রামে থাকা প্রাচীন নমুনাদের সন্ধান কি বদলে দিতে পারে ইতিহাসচর্চার গতিপথ। বলবে সময়...

Powered by Froala Editor