মাঝসমুদ্রে জাহাজ থেকে উধাও নাবিকরা, আজও অমীমাংসিত ‘এমভি জয়িতা’-র রহস্য

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ রাষ্ট্র সামোয়ার (Samoya) রাজধানী আপিয়া থেকে সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিল একটি প্রকাণ্ড পণ্যবাহী জাহাজ। ৪ টন পণ্যের পাশাপাশি সেই জাহাজে ছিলেন ১৬ জন নাবিক-সহ ২৫ জন কর্মী। গন্তব্য ২৭০ মাইল দূরে অবস্থিত টোকেলাউ দ্বীপপুঞ্জ। মাত্র দু-দিনের পথ। যদিও যাত্রী ও পণ্য নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারেনি জাহাজটি। যাত্রা শুরুর প্রায় পাঁচ সপ্তাহ পরে মাঝসমুদ্রে আবিষ্কৃত হয়েছিল তার ‘মৃতদেহ’। না, ডুবে যায়নি এই জাহাজ। সমুদ্রে সে সাঁতার কেটে চলেছিল আপন খেয়েলাই। শুধু নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল তার নাবিকরা। 

১৯৬২ সাল। প্রকাশিত হয় ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক রবার্ট মওঘামের (Robert Maugham) লেখা উপন্যাস ‘দ্য জয়িতা মিস্ট্রি’। এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল এমনই। না, এই প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত নয়। বাস্তবেই দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের ওই বিশেষ অঞ্চল থেকেই হারিয়ে গিয়েছিল ‘এমভি জয়িতা’ (MV Joyita) নামের আস্ত একটি জাহাজ। অবশ্য নামটিতে আদ্যোপান্ত বাঙালিয়ানার ছাপ থাকলেও, ভারত বা বাংলার কোনো সম্পর্ক নেই এই জাহাজের সঙ্গে। স্প্যানিশ ভাষায় ‘জয়িতা’ কথাটির অর্থ ‘লিটল জুয়েল’। ১৯৩১ সালে তৈরি এই জাহাজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করত মার্কিন নৌসেনারা। পরবর্তীতে তা হয়ে ওঠে পণ্যবাহী জাহাজ। বিক্রি করে দেওয়া হয় সামোয়ার এক ব্যবসায়ীকে। সে যাই হোক, বিশ্বের রহস্যজনক ‘ঘোস্ট শিপ ইনসিডেন্ট’-এর তালিকায় শীর্ষস্থানেই উঠে আসে এমভি জয়িতার আশ্চর্য দুর্ঘটনার কাহিনি। কিন্তু ঠিক কী হয়েছিল এই জাহাজের সঙ্গে?

একটু খুলে বলা যাক। ১৯৫৫ সালের ৩ অক্টোবর। প্রাথমিকভাবে এ-দিনই আপিয়া থেকে রওয়ানা দেওয়ার কথা ছিল এমভি জয়িতার। তবে গণ্ডগোল করে বসে ইঞ্জিনের ক্লাচ। দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টার প্রচেষ্টায় বন্দরেই মেরামত করে সারিয়ে তোলা হয় জাহাজটিকে। শেষ পর্যন্ত ৪ অক্টোবর আপিয়া থেকে সমুদ্রে পাড়ি দেয় জয়িতা। হিসেব অনুযায়ী, ৬ অক্টোবর সকালেই গন্তব্য বন্দরে পৌঁছে যাওয়ার কথা তার। অথচ, দিন পেরিয়ে সন্ধে হয়ে যাওয়ার পরেও তার দেখা না-মিললে জরুরি সতর্কতা জারি করে টোকেলিউ বন্দর। কোথায় গেল আস্ত জাহাজটি? মাঝসমুদ্রে বিপদের সম্মুখীন হলেও যে ‘এসওএস’ এসে পৌঁছানোর কথা বন্দরে। তেমনটাও হয়নি। তবে? পরদিন জয়িতার অনুসন্ধানে নামানো হয় নৌসেনা। উদ্ধারকার্যে হাত লাগায় নিউজিল্যান্ডের রয়্যাল এয়ারফোর্সও। তবে প্রায় একসপ্তাহ ধরে অনুসন্ধান চালিয়েও জাহাজটির কোনো চিহ্নই খুঁজে পাননি নৌ এবং বায়ুসেনারা। 

এর প্রায় মাস খানেক পরের ঘটনা। ১০ নভেম্বর ফিজি দ্বীপপুঞ্জের কাছে ‘এমভি জয়িতা’ ভেসে যেতে লক্ষ করে একটি বাণিজ্যতরী। দূরবীনে ‘এমভি জয়িতা’ নামটি দেখেই রীতিমতো চমকে উঠেছিলেন ক্যাপ্টেন। গন্তব্য থেকে ৬০০ মাইল দূরে এসে হাজির হয়েছে এই জাহাজ। তবে কি দিকভুল করলেন নাবিকরা? রেডিও মারফত একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করার পরও সাড়া না-মেলায়, এমভি জয়িতায় উদ্ধারকারী দল পাঠায় সংশ্লিষ্ট জাহাজটির ক্যাপ্টেন। তবে সেখানে গিয়ে যে-দৃশ্যের সাক্ষী হয়েছিলেন তাঁরা, তা রীতিমতো আশ্চর্য করে দেয় সকলকেই। হঠাৎ যেন কোনো মহাবিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছিল এই জাহাজে। 

হ্যাঁ, স্পষ্টতই সেখানে নাবিক ছিল না কোনো। জরুরি অবস্থাকালীন রেডিওটি সেট করা ছিল বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে, যার কম্পাঙ্কের সঙ্গে হুবহু মিলে যায় টোকেলাউ বন্দর এবং জরুরি সাহায্য প্রদানের কম্পাঙ্ক। অর্থাৎ, কোনো গুরুতর বিপদে পড়েছিলেন তাঁরা। তবে তদন্তে উঠে আসে রেডিওর অভ্যন্তরে তার ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে অকেজো হয়ে গিয়েছল সেটি। কিন্তু কী সেই বিপদ? ভেঙে গিয়েছিল জাহাজের অধিকাংশ জানলা। এমনকি জাহাজের মূল অংশের উপরিভাগে তৈরি হয়েছিল প্রকাণ্ড একটি গর্ত। সেখান থেকেই বৃষ্টির জল ঢুকে প্লাবিত হয়েছিল জাহাজের অভ্যন্তর। তবে জাহাজটিকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন নাবিকরা, প্রমাণ পাওয়া যায় তারও। জাহাজের ইঞ্জিন রুমে নিয়ে আসা হয়েছিল জাহাজ সারাইয়ের জন্য নানাবিধ সরঞ্জাম, জল নিকাষের জন্য বৈদ্যুতিক পাম্প। অবশ্য জরুরি মুহূর্তে সে-সব যে কোনো কাজে আসেনি, আন্দাজ পাওয়া যায় প্রেক্ষাপট থেকেই। 

তবে যে-জিনিসটি সবথেকে বেশি অবাক করেছিল উদ্ধারকারীদের, তা হল ক্যাপ্টেনের ঘরে ছড়িয়ে থাকে মেডিক্যাল ব্যাগ, অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী এবং রক্তাক্ত জামা-কাপড়। সেগুলি যে নাবিকদেরই, তাতে সন্দেহ নেই কোনো। এমনকি সেখানে পাওয়া গিয়েছিল ক্যাপ্টেনের রক্তাক্ত জামাও। অন্যদিকে জাহাজ থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল তিনটি লাইফবোট এবং একটি ডিঙি। নাবিকরাই সেগুলি ব্যবহার করেছেন তাতে সন্দেহ নেই কোনো। সঙ্গে ৪ টন পণ্যের বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট ছিল না জাহাজে। কিন্তু কী হয়েছিল এই জাহাজের সঙ্গে?

সেই প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর জানা নেই কারোরই। কেউ মনে করেন, এই জাহাজে হামলা চালিয়েছিল ভিনগ্রহীরা। আবার কেউ কেউ সে-সময় আশঙ্কা করেন, এই জাহাজ শিকার হয়েছিল জাপানিদের। প্রশান্ত মহাসাগরে গোপনে সক্রিয় রয়েছে নাৎসি ইউবোট এবং জাপানের রয়্যাল নেভি— আশঙ্কা করেন অনেকে। তাছাড়া নাবিকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, লড়াই, বীমা জালিয়াতির সম্ভাবনাকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। তবে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য তত্ত্ব হল, জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল এই জাহাজ। তারাই লুঠ করে সমস্ত পণ্য। তছনছ করে দেয় গোটা জাহাজটিকে। ধারণা করা হয়, লাইফবোটে করে পালানোর চেষ্টা করলেও তাঁদের হাতেই নিহত হয়েছিলেন নাবিকরা। কারণ, অনেক খুঁজেও সন্ধান মেলেনি তাঁদের। খুঁজে পাওয়া যায়নি লাইফবোটগুলিকেও। 

অবশ্য নাবিকরা না-ফিরলেও নতুন করে সমুদ্রে ফিরেছিল এমভি জয়িতা। ১৯৫৬ সালে মেরামত করা হয় এই জাহাজকে। ফের পণ্যবহনের কাজ শুরু করে জাহাজটি। তবে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে ফের দু-বার দুর্ঘটনার শিকার হয় সেটি। শেষ পর্যন্ত ১৯৫৯ সালে লোহার দরে নিলাম করে দেওয়া হয় এই জাহাজকে। কিনেছিলেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক রবার্ট মওঘাম। পরবর্তীতে এই ‘স্মারক’-ই তাঁকে অনুপ্রাণিত করে ‘দ্য জয়িতা মিস্ট্রি’-খ্যাত আস্ত একটি উপন্যাসটি লেখার জন্য। 

Powered by Froala Editor