টেলিফোনেই সংবাদ ও গান পরিবেশনা, বিস্মৃত এক সময়ের গল্প

আজকের দিনে স্মার্টফোন ছাড়া মানুষের জীবন প্রায় অচল। ব্যক্তিগত যোগাযোগ তো বটেই, দেশ-দুনিয়ার খবর থেকে শুরু করে গান, সিনেমা, ওয়েবসিরিজ, ভিডিও গেম, এমনকি ব্যাঙ্কিং পরিষেবাকেও মানুষের হাতের মুঠোয় পৌঁছে দিয়েছে স্মার্টফোন। তবে আজ থেকে বছর পঁচিশ আগেও মোবাইলের ব্যবহার সীমিত ছিল কেবলমাত্র ফোন ও বার্তালাপের মধ্যেই। পরবর্তীতে একুশ শতকের শুরুর দিকে চালু হয় বিভিন্ন ভ্যালু-অ্যাডেড পরিষেবা। এসএমএস বা মেসেজের মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে যেত সংক্ষিপ্ত আকারে লিখিত আবহাওয়া, ক্রিকেট বা ফুটবল ম্যাচের স্কোর ও অন্যান্য খবরাখবর। তবে মজার বিষয় হল, আজ থেকে প্রায় একশো তিরিশ বছর আগে এই একইধরনের পরিষেবা চালু হয়েছিল ইউরোপের বেশ কিছু শহরে।

টেলিফোন নিউজপেপার (Telephone Newspaper)। হ্যাঁ, উনিশ শতকের ইউরোপে এই নামেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল এই বিশেষ পরিষেবা। অবশ্য তখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি মোবাইল। বরং, ল্যান্ড ফোন বা টেলিফোনের মাধ্যমেই গ্রাহকদের কাছে এই পরিষেবা পৌঁছে দিত ততকালীন টেলিকম সংস্থারা। 'টেলিফোন নিউজপেপার'-এর এই ইতিহাসও বেশ বিচিত্র। 

আসলে উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় রেডিও তৈরির কর্মযজ্ঞ। তবে সম্পূর্ণ সফল হয়নি সেই গবেষণা। সে-যুগের বেতার পাঠাতে পারত না মানুষের কণ্ঠস্বর। শুধুমাত্র সাংকেতিক চিহ্ন, অর্থাৎ ডট এবং ড্যাশের মাধ্যমেই বিশেষ বিশেষ বার্তা পাঠাত রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি। আজ যে সাংকেতিক ভাষা আমাদের কাছে পরিচিত মর্শকোড নামে। অন্যদিকে আধুনিক বেতার সম্প্রচার শুরু হয় বিশ শতকের শুরুতে, আধুনিক রেডিও-র আত্মপ্রকাশের পর। 

অবশ্য রেডিও আবিষ্কারের আগেই মানুষের হাতে চলে আসে, এক জায়গা থেকে ভিন্ন জায়গায় মানুষের কণ্ঠস্বর পাঠানোর প্রযুক্তি। টেলিফোন। যদিও ১৮৭০-এর দশকে আবিষ্কৃত এই যুগান্তকারী প্রযুক্তির মাধ্যমে কেবলমাত্র দু-জন ব্যক্তিই কথা বলতে পারতেন নিজেদের মধ্যে। এর বছর দশেক পরে টেলিফোনকেই সংবাদ প্রচারের মাধ্যম হিসাবে বেছে নেন সে-যুগের টেলিকম অপারেটররা। তবে কি প্রত্যেক গ্রাহককে ফোন করে পৃথক পৃথকভাবে পৌঁছে দেওয়া হত সংবাদ?

না, ব্যাপারটা তেমন নয়। বরং, একটি নির্দিষ্ট স্টুডিও বা থিয়েটারে বসানো হত একাধিক টেলিফোন ট্রান্সমিটার এবং মাইক্রোফোন। গ্রাহকরা নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করলেই এই মাইক্রোফোনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের সম্প্রচার পৌঁছে যেত তাঁদের কাছে। ১৮৮১ সাল। প্যারিসের এক বৈদ্যুতিক প্রদর্শনীতে সর্বপ্রথম এই বিশেষ পরিষেবার নমুনা প্রদর্শন করেন ফরাসি উদ্ভাবক ক্লেমেন্ট অ্যাডার। প্যারিসে আয়োজিত একটি অপেরা অনুষ্ঠানের মঞ্চে তিনি স্থাপন করেছিলেন ৮০টি টেলিফোন ট্রান্সমিটার অর্থাৎ মাইক্রোফোন। সেখান থেকেই এই অনুষ্ঠান টেলিফোন মারফত লাইভ শোনানো হয় ২ কিলোমিটার দূরে আয়োজিত সংশ্লিষ্ট বৈদ্যুতিক প্রদর্শনীতে উপস্থিত দর্শকদের। বিশ্বের ইতিহাসে প্রাচীনতম লাইভ ব্রডকাস্টিং এটিই। 

সেদিন এই প্রদর্শনীতে হাজির ছিলেন পর্তুগালের রাজা প্রথম লুইস। ক্লেমেন্টের তৈরি এই প্রযুক্তিতে মুগ্ধ হয়ে, তিনি নিজের প্রাসাদে স্থাপন করেছিলেন একটি বিশেষ টেলিফোন। এই টেলিফোনের মাধ্যমেই সরাসরি থিয়েটার থেকে অপেরা শোনার ব্যবস্থা করা হয় তাঁর জন্য। 

অবশ্য এরও ৯ বছর পরে, ১৮৯০ সালে প্যারিসে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল বিশ্বের প্রথম টেলিফোন ভিত্তিক বিনোদন পরিষেবা, 'থিয়েট্রোফোন'। মূলত অপেরা এবং শ্রুতিনাটকই সম্প্রচারিত হত টেলিফোনের মাধ্যমে। তাছাড়াও শোনা যেত খবর। বিশেষত প্যারিসের বিভিন্ন হোটেল,ক্যাফে, ক্লাব এবং রেলস্টেশনে বসানো হয়েছিল এ-ধরনের টেলিফোন। ৫০ সেন্টের পরিবর্তে পাঁচ মিনিটের জন্য এই বিনোদনের স্বাদ নিতে পারতেন গ্রাহকরা। কয়েক বছর পর গৃহস্থদের জন্যও চালু হয়ে যায় এই পরিষেবা। ১৮৯৩ সালের নথি অনুযায়ী প্যারিসে সবমিলিয়ে ১৩০০ গ্রাহক ছিল থিয়েট্রোফোনের।

এই একই ধরনের পরিষেবা চালু হয়েছিল হাঙ্গেরি রাজধানী বুদাপেস্টেও। ১৮৯৩ সালে চালু হওয়া 'টেলিফোন হরমন্ডো'-খ্যাত এই পরিষেবা ছিল তৎকালীন ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় টেলি-সংবাদপত্র। সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু করে, রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত এই টেলি-সংবাদপত্রে চলত নানাবিধ অনুষ্ঠান। ঘণ্টায় ঘণ্টায় সংবাদ পরিবেশন তো ছিলই, সঙ্গে পরিবেশিত হত গান, শ্রুতি নাটক, গল্প ও কবিতাপাঠ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক নানা অনুষ্ঠান।

আধুনিক যে-কোনো সংবাদ মাধ্যমের মতোই, বেশ কিছু নিজস্ব সাংবাদিক ছিল হাঙ্গেরির এই টেলি-সংবাদপত্রের। ছিল সম্পাদক, লেখক এবং উপস্থাপক। ১৯০৭ সালের নথি অনুযায়ী সবমিলিয়ে  এই টেলি-সংবাদপত্রে কাজ করতেন ২০০ জন কর্মী। গ্রাহকের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৫ হাজার।

তবে এই ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া সত্ত্বেও 'টেলিফোন হরমন্ডো' বন্ধ হয়ে যায় ১৯৪৪ সালে। আসলে বিশের দশকের শুরু থেকেই ইউরোপ জুড়ে ব্যবহার বাড়তে থাকে রেডিওর। একদিকে যেমন রেডিওতে খবর শোনার জন্য আলাদা করে টাকা খরচ করতে হত না মানুষকে, তেমনই রেডিও-তে শোনা যেত বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান। ফলে সাধারণ মানুষের কাছে প্রাসঙ্গিকতা  হারায় টেলিফোন নিউজপেপার। মুছে যায় তার অস্তিত্বও।

Powered by Froala Editor