হারিয়ে যায় জাহাজ, বিমান— বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের যমজ ‘ডেভিল সি’-র কাহিনি

অতলান্ত নীল জলরাশি। তার মধ্যে দিয়েই এগিয়ে চলেছে প্রকাণ্ড একটি জাহাজ। কয়েকশো সওয়ারিও রয়েছেন সেখানে। গন্তব্যে পৌঁছাতে আর দিন দুয়েক বাকি। রেডিও-র মাধ্যমে সে-খবর বন্দরে পৌঁছে দিয়েছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেন। কিন্তু দু’দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বন্দরে ফেরার নাম নেই তার। যোগাযোগ করা যাচ্ছে সম্ভব হচ্ছে না রেডিও-র মাধ্যমেও। তবে কি সমুদ্রপথে কোনো দুর্ঘটনার শিকার হল জাহাজটি? কিন্তু তা-ই যদি হয়, তবে ধ্বংসচিহ্ন ছড়িয়ে থাকার কথা সমুদ্রের একটি বিশেষ এলাকাজুড়ে। উদ্ধারকারী দলের চোখে ধরা পড়েনি তেমন কোনো চিহ্নই। যেন সমুদ্রের বুক থেকে স্রেফ উধাও হয়ে গেছে আস্ত জাহাজ।

চিরপরিচিত এই গল্প শুনে অনেকে হয়তো আন্দাজ করেছেন এই গল্প বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের। না, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নয়। বরং, একই দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত এই অঞ্চলটি পরিচিত ‘ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেল’ (Dragon's Triangle) বা ড্রাগনের ত্রিভুজ নামে। রহস্যের দিক থেকে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের থেকে কোনো অংশেই কম যায় না এই অঞ্চল। জাহাজ তো বটেই, এই অঞ্চল দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানও হামেশাই উধাও হয়ে যায় রহস্যময়ভাবে। কিন্তু কোথায় অবস্থিত এই অঞ্চল?

উত্তরে জাপানের টোকিও শহর থেকে সুদূর দক্ষিণের গুয়াম দ্বীপপুঞ্জ এবং পূর্বে তাইওয়ান— এই তিনটি অঞ্চলে সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করা হলে যে ত্রিভুজ গঠিত হয়, সেটিই মূলত পরিচিত ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেল নামে। আর প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত এই অশুভ অঞ্চলটির মধ্যবর্তী জলরাশি স্থানীয়দের কাছে পরিচিত ‘ডেভিলস সি’ (Devil's Sea) বা শয়তানের সাগর নামে। 

হ্যাঁ, ‘অশুভ’-ই বটে। অন্তত চিন, জাপান কিংবা ফিলিপাইনের ইতিহাস ও মাইথোলজিতে ‘অশুভ’ বলেই উল্লেখিত হয়েছে এই অঞ্চল। এই তিনটি দেশেরই পৌরাণিক কাহিনি এবং লোককথায় কম-বেশি উল্লেখ পাওয়া যায়, এই অঞ্চলে নাকি লুকিয়ে রয়েছে এক দৈত্যাকার ড্রাগন। সমস্ত বিপর্যয়ের মধ্যমণি এই প্রাণীটিই। সমুদ্রের নিচে তার চলাফেরাই আন্দোলিত করে জলরাশি, তার নিঃশ্বাসে ওঠে ঘূর্ণিঝড়, ঘন কুয়াশায় ছেয়ে যায় গোটা অঞ্চল। খিদে পেলে আস্ত জাহাজ কিংবা ওই অঞ্চলের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানকেও গিলে খায় সে। 

আসলে এই কিংবদন্তির নেপথ্যে রয়েছে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আশ্চর্য আবহাওয়া এবং ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। ভৌগোলিক দিক থেকে দেখতে গেলে ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেল অবস্থিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অগ্নিবলয় কিংবা প্যাসিফিক রিম অফ ফায়ারের ওপরই। ফলে, সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে মাঝে মধ্যেই ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে বিভিন্ন ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি। তাদের অগ্ন্যুৎপাতে কখনও কখনও রাতারাতি জন্ম নেয় আস্ত দ্বীপ, আবার কখনও এইসব দ্বীপ আকস্মিকভাবেই হারিয়ে যায় সমুদ্রগর্ভে। পাশাপাশি মাঝে মাঝে ঘন কুয়াশা তৈরি হয় এই অঞ্চলে। ক্রান্তীয় অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় শক্তিশালী টাইফুন বা ঘূর্ণিঝড়েরও জন্মস্থান ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেল। এইসকল ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যই ‘ড্রাগন’ হয়ে উঠেছে নানান দেশের পৌরাণিক কাহিনিতে। 

ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেল সম্পর্কিত নথির প্রাচীনতম নিদর্শন পাওয়া যায় দশম শতাব্দীতে। বর্ণনা অনুযায়ী, তারও আগে থেকে এ-ধরনের ঘটনা, থুড়ি দুর্ঘটনা ঘটে আসছে এই অশুভ অঞ্চলে। তবে ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেল ইতিহাসের অন্যতম চর্চিত অধ্যায় হয়ে ওঠে ত্রয়োদশ শতকে। চেঙ্গিস খানের রাজত্বকালে অধুনা মঙ্গোলিয়া ছাড়িয়ে মঙ্গোল সাম্রাজ্য ছড়িয়ে পড়েছিল প্রায় গোটা চিনেই। মধ্য এশিয়াতেও প্রভাব বিস্তার করেছিলেন চেঙ্গিস। সেনা বাহিনীর পাশাপাশি বিশাল নৌবহরও ছিল তাঁর। পরবর্তীতে এই নৌবহর নিয়ে জাপান অধিগ্রহণের চেষ্টা করেন তাঁর উত্তরসূরি কুবলাই খান। তবে ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেল অতিক্রম করতে গিয়েই ধ্বংস হয়ে যায় কুবলাই খানের গোটা নৌবাহিনী। দুটি ভিন্ন ভিন্ন অভিযানে সবমিলিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন প্রায় ৬০ হাজার নৌসেনা। কথিত আছে, প্রচণ্ড শক্তিশালী এক টাইফুন নাকি লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল কুবলাই খানের নৌবাহিনীকে। তৎকালীন চিনা এবং মঙ্গোল সাহিত্যিকরা এই ঘটনার জন্য হিংস্র ড্রাগনকে দায়ী করলেও জাপানিদের লেখায় এই ঘটনা বর্ণিত হয়েছে ‘ডিভাইন উইন্ড’ নামে। তাঁদের বিশ্বাস প্রকৃতি বা কোনো ঐশ্বরিক শক্তি এই বিপর্যয়ের মাধ্যমেই রক্ষা করেছিল জাপানকে।


এ তো গেল পুরাণের কথা। এবার আবার ফিরে আসা যাক বাস্তবে। ১৯৫২-৫৬ সাল। সে-সময় ফের চর্চায় উঠে এসেছিল ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেল। আসলে ১৯৫২ সালে এই অঞ্চলের রহস্যভেদের জন্য কাইয়ো মারু নামের এক জাহাজে চড়ে পাড়ি দিয়েছিলেন জাপানের ২২ জন গবেষক। তাছাড়াও জাহাজে উপস্থিত ছিলেন বেশ কিছু ক্রু-মেম্বার এবং কর্মী। রহস্যময়ভাবে উধাও হয়ে যায় এই জাহাজটি। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই জাহাজ থেকে ধারাবাহিকভাবে রেডিও মারফত গবেষণাকেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন জাহাজের গবেষকরা। তবে আকস্মিকভাবেই বন্ধ হয়ে যায় যোগাযোগ। এমনকি দুর্ঘটনার জন্য কোনোরকম সাহায্যের আবেদনও পাওয়া যায়নি এই জাহাজ থেকে। পাশাপাশি ১৯৫২-৫৬— এই চার বছরের মধ্যে ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেলে নিখোঁজ হয়ে যায় আরও ৫টি রণতরী। 

তাৎক্ষণিকভাবে কোনো সমাধান না-পাওয়া গেলেও পরবর্তীতে গবেষকরা তুলে আনেন একাধিক সম্ভাবনা। কারোর অভিমত আকস্মিক অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল জাহাজগুলি। আবার এও প্রমাণ মেলে যে ওই অঞ্চলে সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে রয়েছে মিথেনের বিরাট ভাণ্ডার। টেকটোনিক পাতের চলাচলের কারণে সেই ভাণ্ডার থেকে কখনও কখনও বেরিয়ে আসে সেই গ্যাস। বিপুল পরিমাণ গ্যাসের এই ঊর্ধ্বগতি অনায়াসেই উল্টে দিতে পারে যে-কোনো বড়ো জাহাজকে। এমন ঘটনারই শিকার হয়েছিল সংশ্লিষ্ট জাহাজগুলি, ধারণা অনেকের। 

পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে মার্কিন গবেষক ল্যারি কুশ সামনে আনেন আরও একটি আশ্চর্য সমীক্ষার ফলাফল। ল্যারি দেখান, বিশ্বের মধ্যে মোট ১২টি রহস্যজনক অঞ্চল লুকিয়ে রয়েছে, যেখানে ম্যাগনেটিক এবং গ্র্যাভিটেশনাল অ্যানিমালি লক্ষ করা যায়। কী এই ম্যাগনেটিক অ্যানিমালি? ল্যারির কথায় এইসকল অঞ্চলে আকস্মিকভাবে বদলে যায় প্রাকৃতিক চৌম্বকক্ষেত্র এবং অভিকর্ষ ক্ষেত্রের মান। আর সেই কারণেই ধাতুর তৈরি জাহাজ বা বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে আচমকা। কাজ বন্ধ করে দেয় তাদের বৈদ্যুতিন যন্ত্রাংশও। 

মজার বিষয় হল, এই ১২টি অঞ্চলের তালিকায় ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেলের পাশাপাশি রয়েছে বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের নামও। সেই অঞ্চলের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে একইরকম কিংবদন্তি। তবে ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গেলের বৈশিষ্ট্য হল, সেখানে বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া জাহাজ বা বিমানের ধ্বংসাবশেষ মাঝে মাঝে ভেসে আসে সমুদ্রতটে। কখনও আবার জনহীন ভগ্নপ্রায় জাহাজকে ভাসতে দেখা যায় সমুদ্রের ওপর। তার কারণ এখনও অস্পষ্ট গবেষকদের কাছে। হয়তো নিতান্তই সমুদ্রস্রোত দায়ী এই ঘটনার জন্য, কিংবা হয়তো এখানেও লুকিয়ে রয়েছে বৃহত্তর কোনো রহস্য।

Powered by Froala Editor