প্রমথ চৌধুরী মনে করতেন, বাংলার সঙ্গে ফরাসি ভাষার বেশ সাদৃশ্য আছে। তিনি নিজেও ছিলেন ছিলেন ফরাসি গদ্যের ঋজু, ছিপছিপে চলনের ভক্ত। গত শতকের তিনের দশকের কবিতায় বহুভাবে মিশে গেছিল শার্ল ব্যোদলেয়রের ‘নির্জনতার অনুভূতি’। আর মলিয়েরের নাটকের অনুবাদ তো চলেছে বাংলা থিয়েটারের জন্মকাল থেকেই। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে গিরিশচন্দ্র ঘোষ, প্রত্যেকেই ছিলেন মলিয়েরের ভক্ত। ফরাসি সাহিত্যের যে ‘স্পষ্টভাষী’ রিয়ালিস্টিক ভঙ্গি, তা পরবর্তীতে প্রভাবিত করেছে আরো বহু সাহিত্যিককে। বাংলার সঙ্গে ফরাসির হরগৌরীর মিলন ঘটাতে যাঁরা উৎসুক ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম লোকনাথ ভট্টাচার্য (Lokenath Bhattacharya)। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদসাহিত্য—সম্ভবত এই পদক্ষেপে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনি। অথচ তাঁর ‘নির্বোধ সরল মন’ আজীবন অপেক্ষা করেছে উপযুক্ত বাঙালি পাঠকের। ফ্রান্সে উদযাপিত, অথচ বাংলায় বিস্মিত এক প্রতিভা লোকনাথ ভট্টাচার্য।
তার একটা বড়ো কারণ, বাংলার পাঠকের প্রস্তুতির অভাব। শাসক ইংরেজের সুবাদে সাহিত্য যতটা আলোচিত, সেই তুলনায় বাংলায় ফরাসিচর্চা নিয়ে বিস্তৃত গবেষণার সংখ্যা সীমিত। বিশ শতকে কিছুটা ব্যক্তিগত সদিচ্ছা, কিছুটা ইংরেজ ছাড়া অন্যান্য বিদেশি সংস্কৃতকে স্বেচ্ছায় গ্রহণ করার ফলে অনেকেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন ফরাসি সাহিত্যে। বিষ্ণু দে, অরুণ মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ মুজতবা আলী প্রমুখরা ফরাসি চর্চা করতেন নিয়মিত। শান্তিনিকেতনে আসতেন জঁ রেনোয়াঁ, লেভি-সহ বিখ্যাত পণ্ডিতরা। এই পরিমণ্ডল নিশ্চিতভাবে প্রভাবিত করেছিল লোকনাথ ভট্টাচার্যকে। তিনি নিজেও ছিলেন শান্তিনিকেতনের ছাত্র। ১৯৫৩ সালে ফরাসি সরকারের বৃত্তি নিয়ে গবেষণার জন্য যান ফ্রান্সে। আলাপ হয় লুই আরাগঁর সঙ্গে। সেই সময়ই বুদ্ধদেব বসুর ‘কবিতা’ পত্রিকার সুবাদে লোকনাথ ভট্টাচার্য ‘স্বরবর্ণ’, শাশ্বতী’, ‘মাতাল তরণী’ নামে প্রথম অনুবাদ করেন আর্তুর র্যাঁবোর (Arthur Rimbaud) তিনটি কবিতা। ১৯৫৪ সালে প্রকাশিত হয় র্যাঁবোর কাব্যগ্রন্থের বাংলা অনুবাদ ‘নরকে এক ঋতু’। ফ্রান্সেই প্রেম ও বিবাহ হয় ফ্রাঁস মতেরুর সঙ্গে। ১৯৬৫ সালে সম্পাদক হন সাহিত্য আকাদেমির ‘ইন্ডিয়ান লিটারেচর’ পত্রিকার। পরে দায়িত্বপালন করেন ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের ডিরেক্টরের।
‘মায়াবী কবি’ র্যাঁবোর তরলতাহীন গদ্যকবিতার মতো ছিল লোকনাথের লেখনী। ভারতীয় দর্শনের প্রবল প্রাচুর্য সেখানে, তবু উচ্চারণে ধরা পড়ে ফরাসি সাহিত্যের স্পষ্ট সত্যচেতনা। অতিদূর সমুদ্র পারে ছড়িয়ে থাকা দ্বন্দ্বমুখর সবুজ রাত্রির কথাই বলতে চাইতেন রোজকার অভিজ্ঞতার সান্নিধ্যে। ভাবাবেগহীন স্থির সত্যে একরৈখিক পথে দেখা মেলে পুনরাবৃত্তে ঘেরা এক ধ্বস্ত সমাজের। শুধু অনুবাদে নয়, তার প্রমাণ মেলে ‘ঘর’, ‘হাঁটুতে হাঁটুতে নহবৎ’, ‘গোধূলিতে জ্যামিতি’ কাব্যগ্রন্থেও।
“সে মরে গেল—তার ও আকাংখার সমাধি নিয়ে আমরা বেঁচে রইলাম;
তবু ফুল ফুটল, তবু গাইল পাখি
যারা স্বপ্ন দেখেছিল উজ্জ্বল সূর্যের, অক্ষত বীর্যের, যারা চেয়েছিল চুম্বন করতে শিশুর স্বর্গীয় মুখ, কেন তারা শুনে গেল শুধু প্রলাপোক্তি, শুধু আর্তনাদ অন্ধকার অরণ্যের, কেন তারা নিজেদের ছায়াকে নিজেরাই ভয় পেল।”
‘তার মৃত্যুর পরে’ কবিতার এই ভাবনা বাংলা সাহিত্যে অপ্রতুল নয়, কিন্তু যে গদ্যরীতির সাহায্যে এরকম আরো অসংখ্য কবিতা তিনি রচনা করেন, তা বাঙালি পাঠক কতটা গ্রহণ করেছে সেটাই প্রশ্নের। বরং কিছু ক্ষেত্রে যেন ফরাসি বাকরীতিতে অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ শোনায় তাঁর যাতায়াত।
“ফিটফাট কোট-প্যান্টে, মুখে খই-ফোটা কাফকা কাম্যুতে, অসভ্য সভ্যতার ধোপে দুরন্ত আমি এক গোঁয়ার গাধা, বাচাল—ঝকঝকে চকচকে, অপূর্ব অমানুষ। কিছুই বুঝিনি।”
আরও পড়ুন
সাহিত্যিক নয়, ‘পাঠক’ হতে চেয়েছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ী
তাঁর একাধিক কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে ফরাসি ভাষায়। নিজে তো বটেই, সহায়তা করতেন ফ্রান্সের বিখ্যাত কবিরা। এবং অবশ্যই তাঁর স্ত্রী।
আরও পড়ুন
জীবনসায়াহ্নে রবীন্দ্র পুরস্কারে সম্মানিত ফ্রাঁস ভট্টাচার্য
একই সঙ্গে আছে তাঁর নাটক, উপন্যাস ও প্রবন্ধ। বিশেষত ১৯৬৩-তে তাঁর অনুবাদে মলিয়েরের ‘তার্তুফ’ নাটকটি একসময়ে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বাংলায়। তাঁর পূর্ববর্তী অনুবাদকরা বিদেশি সাহিত্যের ঐতিহাসিক সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে যে শব্দগুলি নিয়ে ইতস্তত করতেন, লোকনাথ সেখানে সাবলীল। আবার একই সঙ্গে ফরাসি গদ্যের মূলের প্রতি অনুগত।
‘এক দিগন্ত দিনান্তের’ প্রবন্ধগ্রন্থটি সাক্ষ্য দেয় ফরাসি সাহিত্যে তাঁর বিরাট পাণ্ডিত্যের। ব্যোদলেয়র, র্যাঁবো, মালার্মে, ভালেরিসহ আরো বেশ কয়েকজন কবির বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচিত গ্রন্থটি ফরাসি কবিতা চর্চার একেবারে গোড়ার পাঠ। এরকম স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা বাংলা সাহিত্যে বিরল। ‘ভোর’, ‘যত দ্বার তত অরণ্য’, ‘বাবুঘাটের কুমারী মাছ’, ‘অশ্বমেধ’, ‘গঙ্গাবতরণ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। এর মধ্যে শেষ দুটি উপন্যাস সহধর্মিনী ফ্রাঁস মতেরু (ভট্টাচার্য) দ্বারা অনূদিত হয়েছিল ফরাসি ভাষায়। মধ্যবিত্ত জীবনের চিরাচরিত কাহিনি নয়, এক অনিশ্চিত পথে ঘুরে ঘুরে অরণ্যের মাঝে অভিশাপ আর মৃত্যুর ফিসফাস শোনা যায় কাহিনিতে।
জীবনের শেষ দশকের প্রায় পুরোটাই কেটেছে ফ্রান্সে। ২০০১ সালে মিশরে এক ভয়াবহ দুর্ঘটনায় নীলনদের জলে মৃত্যু ঘটে তাঁর। এ যেন এক অদ্ভুত পরিসমাপ্তি। ভাটপাড়ার এক রক্ষণশীল পরিবার থেকে উঠে এসে ফ্রান্সের সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার বিরল কৃতিত্ব তাঁর। ফ্রান্সের বহু তরুণ কবিকে করেছিলেন প্রভাবিত। ১৯৯৯ সালে ফরাসি সরকার তাঁকে ভূষিত করেন ‘কমান্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস’ উপাধিতে। অথচ বাঙালির জন্য এক বিরাট বিশ্বের সন্ধান দিয়েও সম্পূর্ণ উপেক্ষিত তিনি। দুর্ঘটনা? নাকি এটাই বাঙালির ভবিতব্য? বাঙালির বিস্মৃতি প্রবণতার গভীর নদীতে বিলীন হয়ে গেছে লোকনাথ ভট্টাচার্যের নাম।
ঋণস্বীকার : ফরাসি কবিতার বাঙালি রাজকুমার, চিন্ময় গুহ, আনন্দবাজার অনলাইন
Powered by Froala Editor