কবিতার ‘শিক্ষক’ বুদ্ধদেব বসু

তিনি কবি। ‘বন্দীর বন্দনা’য় তিনি নারীর প্রেমে মুক্ত হতে চান প্রতি অঙ্গের পাপের দাগ থেকে। আবার ‘কঙ্কাবতী’র চুলে হাওয়ার বুলবুল কেটে দিয়ে পৌঁছে যান প্রেমের স্বর্গে। তিনি কথাসাহিত্যিক। ‘গজদন্ত মিনার’-নিবাসী বলে একসময় ব্যঙ্গ হলেও স্পন্দিত গদ্যরীতির স্বচ্ছন্দ ভাষাপ্রয়োগের এক বিচিত্র পথে তাঁর হেঁটে চলা। ‘রাত ভরে বৃষ্টি’-র বিতর্ক কি মুছে দিতে পারে ‘তিথিডোর’, ‘উত্তর-তিরিশ’-এর জীবনচিত্র? আবার তিনিই ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন পরিবর্তমান বাংলা কবিতার ধারাকে। তিনি বুদ্ধদেব বসু (Buddhadeb Basu)। ‘কালের পুতুল’-এর মতো প্রবন্ধগ্রন্থ কিংবা ‘প্রথম পার্থ’-এর কাব্যনাট্যেও আশ্চর্যজনকভাবে গতিশীল তাঁর লেখনী। হয়তো এত আয়োজনের মধ্যে কোথাও ঢাকা পড়ে যায় রম্যরচনায় বুদ্ধদেব বসুর কৃতিত্ব। 

বাংলা সাহিত্যের ‘সব্যসাচী’ তকমা দিলেও ভুল বলা হয় না তাঁর সম্বন্ধে। অন্তত রবীন্দ্রপরবর্তী যুগে তো বটেই। শুধু সাহিত্যচর্চা নয়। পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের প্রভাবিত করেছেন বহুভাবে। ‘কবিতা’র মঞ্চ তো ছিলই, মুক্তকণ্ঠে প্রশংসা করেছেন নতুন ধারার সৃষ্টিকে। বিগত দশকের কবি সযত্নে পরীক্ষানিরীক্ষার পথ খুলে দিচ্ছেন নব্যদের জন্য, এমন দৃশ্য দেখা যায় না সচরাচর। অথচ, মন বা মতের মিল হওয়ার কথা তো নয় কোনোভাবেই। সময় বদলেছে, চারের দশকের পর থেকে দ্রুত বদলাতে শুরু করেছে জীবনদর্শন। বিতর্কেও জড়িয়েছেন একাধিকবার। কখনও সেটা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে প্রবন্ধের সূত্রে, কখনও ‘হাংরি জেনারেশন’-এর কবিতা সংক্রান্ত মন্তব্যে। আবার একটা প্রচলিত কাহিনি ছিল তাঁর কবিতা সম্পাদনা নিয়ে। কবির পরামর্শ ব্যতীত বদলে দিতেন কবিতার অংশ বিশেষ। তাতে হয়তো কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন চেহারা নিত সেই কবিতা।

পাঁচের দশকের কবিরা যখন যাত্রা শুরু করছেন, তখন বহুভাবে চর্চিত বুদ্ধদেব বসুর নাম। খানিক পাল্লা ভারি মন্দের দিকেই। এমনকি বেশ কিছু গুজবও ছিল তাঁকে নিয়ে। যেমন, তিনি খুব অহংকারী, বাড়িতে গেলে বিলেতি কুকুর লেলিয়ে দেন ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “বিলেতি কুকুর কখনো দেখিনি। তবে একটি শান্ত ও কবি কবি মুখের দেশী কুকুর আছে, প্রতিভা দেবীর পোষ্য।” এই মানুষটাই কিন্তু ‘কবিতা’-র প্রত্যেকটি চিঠির উত্তর দিতেন নিজে হাতে। সেই সব গুজব-অপবাদ সত্ত্বেও সুনীল একবার কবিতা পাঠালেন তাঁর পত্রিকায়। চিরাচরিতভাবে খানিকটা পরিবর্তিত রূপেই প্রকাশিত হল সেটি। ক্ষুণ্ন ও ক্ষুব্ধ হলেন সুনীল। দু’তিন বছর আর কবিতা পাঠালেন না তাঁর পত্রিকায়। সংকলনে প্রকাশ করলেন নিজস্ব সংস্করণটিই। একদিন দুজনের ফের দেখা হল একটি সভায়। বুদ্ধদেব বসু যেচে প্রশ্ন করলেন সুনীলকে, কেন পছন্দ হয়নি তাঁর সংশোধন? নীরব হয়ে রইলেন সুনীল। যুক্তিসম্মত উত্তর ছিল না তাঁর কাছে। কবিতার রূপ পরিবর্তনের জন্য নয়, কবির ‘জেদ’ থেকেই অভিমান করেছিলেন তিনি। 

কিছুদিন পরে আরেকটি কবিতা পাঠালেন বুদ্ধদেব বসুর কাছে। এবার আর সংশোধন নয়, ফেরত এল কবিতাটি। সঙ্গে একটি ছোট্ট লেখা, কবিতায় কিছু কিছু বদল দরকার। বদল করেননি সুনীল, কবিতাটি আর পাঠাননি পত্রিকার উদ্দেশ্যে। বছরখানেক পরে আবার দেখা। সেই পুরনো হাসি হেসেই প্রশ্ন করলেন ‘কবিতা’সম্পাদক, কেন আর লেখা পাঠায় না সুনীল? বাড়ি ফিরে ওই কবিতাটিই অপরিবর্তিতভাবে পাঠালেন বুদ্ধদেব বসুকে। ছাপা হল সেটি। না ছাপালেও পারতেন। অনায়াসে দরজা বন্ধ করে দিতে পারতেন নতুন কবির জন্য। করেননি, বরং পরে সুনীলকে শিখিয়েছিলেন কবিতায় ক্রিয়াপদ প্রয়োগের খুঁটিনাটি বিষয়। 

আরও পড়ুন
এক চিলতে ঘরে কবি অরুণ মিত্র, ডাক দিলেন আকাশের তারাদের

আবার শিক্ষক হিসেবে ছিলেন সম্পূর্ণ বিপরীত প্রকৃতির। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তিনি। শোনা যায়, ছুটি পাওয়া সংক্রান্ত গণ্ডগোলে ইস্তফা দেন কর্মক্ষেত্র থেকে। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যে কখনই খুব ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল তা নয়। বরং কখনও কখনও অত্যন্ত কঠোর বলেই মনে হত তাঁকে। কলমের আঁচড়ে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতেন পরীক্ষার খাতা। সাহিত্যের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কীভাবে ‘সামান্যতম ভাষাজ্ঞান’ হয়নি ছাত্রছাত্রীদের, সেই নিয়ে প্রায়ই তিরস্কার করতেন। সেই তালিকায় ছিল দিব্যেন্দু পালিত। কথাসাহিত্যিক হিসেবে ততদিনে পরিচিতি পেতে শুরু করেছেন। তাঁকে বললেন বুদ্ধদেব বসু, “তুমি ইতিমধ্যেই গ্রন্থকার হয়েছ, কিন্তু গদ্য লিখেছ ক্লাস সিক্সের ছাত্র।” নির্মম প্রহার! অনেকেই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তাঁর ভাষাপ্রয়োগে। এই বুদ্ধদেব বসুকেই কিন্তু বহু পরে বলতে শোনা যায়, “আমার ছাত্ররা কেউই খারাপ গদ্য লেখে না”। 

আরও পড়ুন
মোরগ নিয়ে কবিতা লিখলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সেই সূত্রেই জন্ম ‘পরিচয়’ পত্রিকার

তিরস্কারের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল পুরস্কার। গ্রহণের মধ্যেই তিলে তিলে বাড়তে থাকে ঋণের পরিমাণ। তিনি তো লিখেছিলেন, ‘যা-কিছু লিখেছি, সব, সবই ভালোবাসার কবিতা’। অসংখ্য পরিচয়ের আবরণের বাইরে জেগে থাকে শুধু তাঁর কবিসত্তা। আসলে তো সবটাই ভালোবাসার নামান্তর। শিক্ষকতার জীবনেও। তা সে কবিতায় হোক, বা ব্যক্তিগত সংসর্গে। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More