ঘোড়ায় চেপে চিকিৎসা, প্রান্তিক ইতালিয়দের মসীহা ডাঃ আনফোসো

জঙ্গলে ঘেরা পাথুরে রাস্তার উপর দিয়ে ঘোড়ায় চেপে ছুটে চলেছেন এক প্রবীণ ব্যক্তি। পিঠে ঝুলছে সাইডব্যাগ। কিন্তু এই পথ ধরে কোথায় চলেছেন তিনি? পথের দু’পাশে যে মানুষের অস্তিত্বের চিহ্ন নেই কোনো। তবে কি তিনি কোনো অভিযাত্রী?

না, অভিযাত্রী নন। ইতালির দক্ষিণ পেডিমন্টের বাসিন্দাদের কাছে তিনি মসীহা। হ্যাঁ, এই দুর্গম পথ ধরেই অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা করতে চলেছেন তিনি। ডাঃ রবার্তো আনফোসো (Roberto Anfosso)। বিগত কয়েক দশক ধরেই ঘোড়ায় চড়েই এই অঞ্চলে চিকিৎসা করেন তিনি। তাঁর এই কর্মকাণ্ড যেন এক নিমেষে ফিরিয়ে নিয়ে যায় মধ্যযুগীয় সময়ে। আর তাঁর এই অদ্ভুত এবং অভিনব চিকিৎসা পন্থার কারণেই সে-দেশে তিনি পরিচিত ‘হর্সব্যাক ডক্টর’ (Horseback Doctor) নামে। 

ইতালি বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে মিলান, রোম, ভেনিস, ন্যাপেলসের কথা। তবে সেইসব শহরের সঙ্গে খুব একটা মিল নেই দক্ষিণ পেডিমন্ট অঞ্চলের। তুলনামূলকভাবে অনেকটাই নিরিবিলি এই অঞ্চল। জনবসতিও খুব কম। পাথুরে জমি, ছোটো ছোটো খামারবাড়ি, কৃষিক্ষেত্র ছড়িয়ে রয়েছে এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে। চার-পাঁচটি বাড়ি নিয়েই ছোটো ছোটো জনবসতি। তাদের মধ্যে দূরত্ব কয়েক মাইলের। স্বাভাবিকভাবেই এই দুর্গম অঞ্চলে আজও সেভাবে উন্নত চিকিৎসা পরিকাঠামো তৈরি হয়ে ওঠেনি, নেই ক্লিনিক কিংবা হাসপাতালের বাড়-বাড়ন্তও। তবে তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নন স্থানীয়রা। আর তাঁদের এই অপার ভরসার কারণ ডাঃ রবার্তো আনফোসো। ফোন করলেই ওষুধ-পত্র, চিকিৎসার সরঞ্জাম নিয়েই ঘোড়ায় চেপে হাজির হন তিনি। কখনও কখনও রোগী দেখতে ১০০ মাইল পথ পাড়ি দিতে হয় তাঁকে। 

কিন্তু একুশ শতকে এই প্রযুক্তির দুনিয়ায় দাঁড়িয়ে এখনও ঘোড়ায় চেপে চিকিৎসা করেন কেন তিনি? এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে অন্য এক রহস্য। ছোটো থেকেই ফুটবল খেলার সখ ছিল আনফোসোর। বছর পনেরো বয়স পর্যন্ত বেশ দাপটের সঙ্গেই অপেশাদার ফুটবল খেলেছেন তিনি। বিস্তর ট্রফি ও মেডেলও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তবে অ্যাসমার জেরে হঠাৎ করেই থমকে যায় তাঁর বিজয়রথ। দৌড়াতে নিষেধ করেন চিকিৎসক। 

এই ঘটনার পর অশ্বারোহণের প্রশিক্ষণ নেন রবার্তো। নিজে দৌড়াতে না পারলেও, অশ্বারোহণ খানিকটা শান্তি এনে দিত তাঁকে। সেইসঙ্গেই তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বড়ো হয়ে চিকিৎসক হবেন তিনি। প্রান্তিক মানুষদের পাশে দাঁড়াবেন। হ্যাঁ, আজ ৬৬ বছর বয়সে পা দিয়েও সেই লক্ষ্যে অবিচল রয়েছেন তিনি। লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন গ্রামবাসীদের জন্য। তবে অশ্বারোহণের প্রতি মোহো আজও কাটেনি তাঁর। বরং, ঘোড়াই তাঁর প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছে। ফলে, অর্থ থাকলেও মোটরগাড়ি কিংবা মোটর-সাইকেল কেনেননি তিনি। পাশাপাশি যানবাহন ব্যবহার না করলে যে পরিবেশও স্বস্তি পায় খানিক।

শুধু ডাঃ আনফোসোই নন, ইতালির এই প্রান্তিক গ্রামে রীতিমতো খ্যাত রয়েছে তাঁর ঘোড়া অ্যাম্বারেরও। স্থানীয়দের ভাষা, অ্যাম্বার আসলে চিকিৎসকের নার্স। রবার্তোর অভিমত, অনেক সময় যন্ত্রণায় কাতর রোগীরা অ্যাম্বারকে দেখে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েন। তাতে চিকিৎসা করতে আখেরে সুবিধা হয় তাঁরই। তবে সমস্যা একটাই। কোথায় মলমূত্র ত্যাগ করতে হয়, মানুষের মতো ঘোড়াদের যে সেই বোধ নেই। তার জন্য মাঝেমধ্যেই রোগীদের বাড়িতে গিয়ে খানিক বিড়ম্বনায় পড়তে হয় প্রবীণ চিকিৎসককে। অবশ্য তা নিয়ে পেডিমন্টসদের অভিযোগ নেই এতটুকু…

Powered by Froala Editor