দেখা করতে চাইলেন খোদ আনা পাভলোভা

শঙ্কর সরণি - ৭
আগের পর্বে

সংসারের প্রতি বরাবর উদাসীন ছিলেন শ্যামশঙ্কর। হেমাঙ্গিনী দেবীর কষ্ট দেখে বাবার প্রতি ছেলেদের মন তেমন প্রসন্ন ছিল না। তবে তা বাইরে প্রকাশ পায়নি কোনোদিন। এর মধ্যেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধে লন্ডনে আটকে পড়েন শ্যামশঙ্কর। উদয়শঙ্কর আর্ট কলেজে পড়ার সূত্রে লন্ডনে। সেখানেই বিদেশিনী ভেরার সঙ্গে আলাপ জমে উঠেছে। শ্যামশঙ্করকে কাছ থেকে দেখে তাঁর পাণ্ডিত্যের পরিচয় পেলেন উদয়। দেখলেন, তাঁর বক্তব্য শুনতে লন্ডনের মানুষ ছুটে আসছেন কাতারে কাতারে। সেই বক্তৃতামালারই অংশ হয়ে থাকত কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ব্রিটিশ যুবতীদের দিয়েই ভারতীয় নৃত্য করাতেন শ্যামশঙ্কর। ছেলেকে কাছে পেয়ে তাঁকেও ডেকে নিলেন। ইন্ডিয়া ডে-র অনুষ্ঠানেই প্রথম মঞ্চে উঠলেন। খালি গা, সোনার আভূষণ। শিব সেজেছেন উদয়। নতুন করে জন্ম হল তাঁর।

বন্ধু ভেরাকে উদয় শোনাতেন ভারতীয় নাচের কথা, ভেরা তাঁকে শেখাতেন বলরুম ডান্সিং। কিছুদিন পরে সহপাঠী হিঞ্চ্ ক্লিফ্ আর তাঁর দুই বন্ধুর সঙ্গে তিনি ঘর ভাড়া নিলেন শেফার্ড বুসে।  এই সময় বিরাট এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করছিল ব্রিটিশ সরকার। সরকারের ইচ্ছা, যেসব রাজা-মহারাজার নিয়মিত আসা-যাওয়া এখানে, তাঁরাও যুক্ত হোন এই পরিকল্পনায়। শোনা গেল, স্বয়ং পঞ্চম জর্জ উপস্থিত থাকবেন এই অনুষ্ঠানে। ইতিমধ্যে মহারাজ ফিরেছেন লন্ডনে। শ্যামশঙ্কর ইচ্ছা প্রকাশ করলেন উদয় এতে পরিবেশন করুন তাঁর নৃত্য।

অনুষ্ঠানের সঙ্গে জুড়ে আছেন, দেশি-বিদেশি রাজা-মহারাজা-মন্ত্রী-সান্ত্রী। তায় পঞ্চম জর্জ। যুদ্ধ বিষয়টা যাঁদের জীবনযাত্রার অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। উদয়ের মনে পড়ল, ঝালোয়ারে দেখা অস্ত্রপূজার কথা। শরীরকে অক্ষত রেখে শরীরের চর্তুদিকে ঘুরতে থাকত তলোয়ার, নির্দিষ্ট গতি আর বিভঙ্গে। তিনি স্থির করলেন, সেইটিই হবে তাঁর নাচের বিষয়। শক্তির অনুশীলনের মধ্যেও প্রতীয়মান হয়ে রয়েছে রিদম্, শৈল্পিক মুদ্রা তাকে আবিষ্কার করে তুলল উদয়ের অর্ন্তদৃষ্টি। অনুষ্ঠানের নাম ঠিক হল শোর্ড-ডান্স, অসি নৃত্য।

ভেরাকে মহড়া দিয়েছিলেন তিনি। তাকে সাজালেন ওড়না, চোলি-ঘাগড়া আর সাবেকি অলংকারে। রামস্বামী ধরলেন তাল। রাজস্থানের গড়নকে রাখা হল প্রতিবেশে। সে অনুষ্ঠান এক বিভা তৈরি করে দিল। স্বয়ং পঞ্চম জর্জের তরফ থেকেও এসে পৌঁছল তারিফ।

নৃত্যের প্রথাগত শিক্ষা, তালিম তাঁর ছিল না। ক্ষণজন্মা ছিলেন, শিল্পকে লাভ করেছিলেন অনুভবের মধ্যে দিয়ে। যে কোনো দৃশ্যের মধ্যে রূপময় আধারটিকে নিষ্কাশিত করে নেওয়ার দুর্লভ প্রতিভা ছিল তাঁর। নৃত্যের ভঙ্গিতে তারই একটা চেহারাকে যেন পুনঃ-সৃজন করতেন তিনি। ধ্রুপদিধারা মেনে শিক্ষালাভ হয়নি বলেই তাঁর নৃত্যভাবনার সূচনায় উপাদান হিসেবে যুক্ত হয়েছে লোকাচার-পালা-পার্বণ অথবা পুরাণের অনুষঙ্গ। ক্রমশ এইটিই আরো বহুধা ধারায় সম্পৃক্ত হয়ে জন্ম নিয়েছে তাঁর অভিনব নৃত্যশৈলী। সেইজন্যই উদয়শঙ্করের নৃত্যধারা পূর্বসূরিবিহীন, তিনিই এর ধাত্রী, এর জনক। অথচ বিবিধ নৃত্যরীতিকে আহরণ করবার সৃষ্টিকৌশলে তা নিত্য-সমকালীন, নিত্য-আধুনিক। যদিও সেই নৃত্যশৈলীরও রয়েছে নিজস্ব ব্যাকরণব আর তার ভিত্তিভূমিও গ্রন্থিত হয়ে রয়েছে তার নিজস্ব নৃত্য- দর্শনের সুরক্ষিত শৃঙ্খলা-বলয়ে।

ঝালোয়ারের মহারাজা ভবানী সিং

 

জীবনের উপান্তে এসে পৌঁছেছেন তখন উদয়শঙ্কর। দূরদর্শন থেকে সম্প্রচারিত হয়েছিল তাঁর একটি সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন নাট্যাচার্য, আরেক কিংবদন্তি, শম্ভু মিত্র। জিজ্ঞাসা করেছিলেন তাঁকে, নাচ কীভাবে প্রথম এসেছিল তাঁর কাছে। মৃদু হেসে তিনি বলেছিলেন, সেকথা শুনলে হয়তো হেসে উঠবেন প্রশ্নকর্তাও। বলেছিলেন, নাচের কৃতিত্বটি সম্পূর্ণতই তাঁর মায়ের। কারণ একটি কন্যা সন্তানের ভারি ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু  ইচ্ছাপূরণের আশু সম্ভাবনা নেই বুঝে তিনি করেছিলেন অন্য ব্যবস্থা। উদয় একটু বড়ো হতেই তিনি কখনও কখনও তাঁকে সুন্দর করে পরিয়ে দিতেন শাড়ি, নিজের হাতের বালা দিয়ে কানের গহনা করে সাজিয়ে দিতেন তাঁকে। গ্রামোফোন চালিয়ে তাঁকে উৎসাহিত করতেন। মায়ের বাৎসল্যে না-জানি কত অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড। মা তাঁকে নাচের বিষয়েই উৎসাহিত করতেন। বাইরে থেকে যা দেখে আসতেন তাই নাচতেন তিনি, মনের ভেতর থেকেও যা আসত তাও নাচতেন। খেলাচ্ছলে মায়ের আহ্লাদে তৈরি মুহূর্তগুলি হয়তো স্পর্শ করে থাকবে অর্ন্তলোকে প্রচ্ছন্ন কারুবাসনাকে।  হতেও পারে সন্তানের সত্তাকে নিবিড়ভাবে জরিপ করেছিল মায়ের মন। শেষ বয়সে এসে এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে  নজর করার মতো এক নথি।      

আরও পড়ুন
সাজলেন শিব, খালি গা, নকশা-তোলা আভূষণ

রটেনস্টাইন তখন উদয়কে রোমে একটি কর্মশালায় পাঠাবার উদ্যোগ করছেন। পৃথিবীর সেরা চিত্রকরদের পুরস্কৃত করা হয় যেখানে। ইতিমধ্যে উদয় তাঁর দুটি ছবির জন্য পেয়েছেন স্পেনসার ও জর্জ ক্লাউসন পুরস্কার। উদয়ও শুরু করেছেন প্রস্তুতি নিতে, ঠিক তখনই ঘটল তাঁর নৃত্যজীবনের আশ্চর্য ঘটনাটি। খবর এল, রানি মৃণালিনীর কাছে শুনে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চান খোদ আনা পাভলোভা। আনার প্রতিভা ছিল বিস্ময়কর। ব্যালে-ডান্সে তাঁর অতুলনীয়, একচ্ছত্র অধিকারে তখন স্তম্ভিত ইউরোপ। রাশিয়ান আনা ছিলেন মূর্তির মতো সুন্দর। স্টেজে তাঁর ব্যালে চলাকালীন মনে হত, তিনি যেন ভেসে বেড়াবার অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছেন।

উদয় গেলেন তাঁর কাছে। আনা তখন কিংবদন্তি। কিন্তু তাঁর কথা, মেশবার সহজভাব স্থায়ী হতে দিল না নবীন যুবকের জড়তাকে। উদয় একটি নৃত্য পরিবেশন করলেন। সপ্রশংস দৃষ্টিতে ধৈর্য নিয়ে তিনি দেখলেন সবটা। তারপর  বললেন, তাঁদের নৃত্য দেহকেন্দ্রিক। কিন্তু ভারতীয় নৃত্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আধ্যাত্মিকতা।  ব্যালেতে তিনি যোগ করতে চান প্রাচ্যের সেই গুণটিকে। সেইজন্যই তাঁর আগামী ব্যালের বিষয় ঠিক করা হয়েছে অজন্তার কথা ভেবে। সিদ্ধার্থর জীবন যার উপজীব্য। সিদ্ধার্থ তাঁর সমস্ত বাসনাপাশকে ছিন্ন করে গৃহত্যাগ করতে চান আর রাজসভা নৃত্যের উৎসব আয়োজন করে তাঁকে ফিরিয়ে আনতে চায় সংসারের সেই মোহমায়াতেই। এর পরিকল্পনা করেছেন সুখ্যাত ব্যালে রচয়িতা ক্লুস্টিন। উদয় তন্ময়চিত্তে এই কৃতী বিদেশিনীর কাছে শুনলেন তাঁর দেশের শিল্প আঙ্গিকের স্বাতন্ত্র্য। কয়েকদিনের মধ্যেই আনা উদয়কে আমন্ত্রণ জানালেন তাঁর দলে যুক্ত হওয়ার জন্য।

উদয়শঙ্করের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন শম্ভু মিত্র।

 

আরও পড়ুন
রয়্যাল আর্ট কলেজ, রটেনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথ

রটেনস্টাইন শুনলেন সব কথা। দুঃখও পেলেন। উদয়ের মধ্যে তিনি দেখেছেন একজন চিত্রকরের চূড়ান্ত সম্ভাবনাকে। এইভাবে মাঝপথে সমস্ত কিছু ছেড়ে-দেওয়া, তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া কঠিন। শ্যামশঙ্কর, রটেনস্টাইন, আনা সবাই দিলেন মতামত। এ ব্যাপারে স্বয়ং মহারাজও পাঠালেন তাঁর বার্তা। যাঁর জীবন তাঁর মতামতের গুরুত্ব যেন দেওয়া হয় সর্বাগ্রে। রাজা তিনি, দূরদর্শী হওয়া যে রাজার স্বভাব, ধর্ম। উদয় যোগ দিলেন আনার দলে, সঙ্গী হলেন ভেরা। ১৯২২ সালের শেষ থেকে শুরু হল তাঁর নতুন যাত্রা।

আগেরবার উদয়ের নৃত্যের বিষয়ভাবনায় জায়গা করে নিয়েছিল একটা উৎসব। এবার এল আচার। তিনি আনাকে বললেন, নাচের বিষয় হতে পারে হিন্দুবিবাহ। আর বললেন রাধা-কৃষ্ণও হতে পারে নাচের উপাদান। রাধা-কৃষ্ণকে ব্যাখ্যা করলেন মূলত, দেশীয় ওরাল ট্রাডিশন বা মৌখিক পরম্পরায় যেভাবে তা উঠে এসেছে, সেইভাবে। পুরাণকে করে তুললেন সমকালীন। উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন আনা। শুরু হল প্রস্তুতি। ভারতীয় ধারার অংশগুলি সৃষ্টি করে তুললেন আর শিখিয়েও তুললেন উদয়। আনা তাঁকে এ ব্যাপারে দিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা। হিন্দুবিবাহ আনা বা উদয় নন, পরিবেশন করবে দল। রাধা-কৃষ্ণতে আনা রাধা, উদয় কৃষ্ণ। আর অজন্তা ব্যালেতে ভারতীয় নৃত্যেরই একটি খণ্ডাংশে, ভূমিকা থাকবে উদয় আর ভেরার।

১৯২২। লন্ডনের স্টেজ। নাচের ধারা ইউরোপিয়ান। নাচের বিষয় ওরিয়েন্টাল। নাচবেন রুশ আনা পাভলোভা। ইন্ডিয়ান উদয়শঙ্কর। আইরিশ ভেরা সোয়ান। বাজল শাঁখ। উলুধ্বনি।  মাধুর্যমণ্ডিত সেইসব আচারে ধীরে ধীরে দেখা দিল বরণ, শুভদৃষ্টি, সাতপাক, হোমাগ্নি। কভেন্ট গার্ডেন রয়্যাল অপেরা হাউস ধন্য ধন্য করল। টাইমস অফ লন্ডন পত্রিকা লিখল, আনার ব্যালেতে তাঁরা প্রথম লক্ষ করলেন বর্ণাঢ্যতা। যদিও উদয়-ভেরার নাচ প্রশংসিত হল, কিন্তু অজন্তা ব্যালে নিয়ে সমালোচকরা ঈষৎ অসন্তুষ্ট রইলেন। কৌতূহল তৈরি হল উদয়শঙ্করকে ঘিরে।

আরও পড়ুন
একটা ফোটোগ্রাফ, গ্লানিবোধ আর মাস্টারমশাই

আনা পাভলোভা ও উদয়শঙ্কর

 

আনা পাভলোভার দল আস্তে আস্তে হয়ে উঠল উদয়শঙ্করেরও দল। বন্ধু-কাজ-আনন্দ-স্বীকৃতি সব মিলিয়ে তৈরি করল এক পূর্ণতার স্বাদ। উদয়াস্ত সুর-তাল পরিবেষ্টিত মহলাকক্ষ যেন পর্যবসিত হত গন্ধর্বনগরে। আরো দুজন বন্ধু হয়ে উঠল খুব। শকি আর অ্যাডলেড। নৃত্যে পারঙ্গম দুই বোন। ইটালিয়ান। আনার ট্রুপ পাড়ি দেবে আমেরিকায়। তিনি আহ্বান করলেন উদয়কে।

আনা বড় হয়েছিলেন এক নিঃস্ব শৈশবে তারপর প্রতিভার সংস্পর্শ জীবনকে করেছিল উপচীয়মান। তবে শিল্পীর অন্দরে শুধু প্রতিভাই তো থাকে না। থাকে সুখে-দুখে, শোকে-সন্তাপে, স্তুতি-ঈর্ষায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা এক সাধারণ মানুষও। নিজের জনপ্রিয়তা নিয়ে সংবেদনশীল ছিলেন আনা। স্টেজে শকিকে খেয়াল করলেন তিনি। ইটালিয়ান শকি দীর্ঘাঙ্গী, সুন্দর। তেমনই অপূর্ব তার দেহের গঠন। তার নৃত্যের নৈপুণ্য অনুশীলনের সময় তেমন চোখে পড়ে না। কিন্তু স্টেজে সে অন্য মানুষ। শকি স্টেজে আসতেন আনার আগে। দর্শকরা বিভ্রান্ত হতেন। কিছুক্ষণ তাঁরা শকিকেই আনা ভাবতেন। প্রবল করতালিতে তাঁকে অভিবাদন জানাতেন। খানিকটা আনা ভেবে, কিন্তু অনেকটা তাঁর নৃত্যগুণেও।

ব্যস্ততা তুঙ্গ মুহূর্তে। চলছে জোগাড়-যন্ত্র। যেন এক দেশ জয় করে অন্য দেশে পাড়ি দেওয়া। যাত্রার প্রস্তুতি মিটে এলে, স্তম্ভিত হয়ে গেল সকলে। দল থেকে নির্বাচনে বাদ পড়েছে শকি। দলের শৃঙ্খলা মেনে নিঃশব্দ রইল সকলে। বোনকে বাদ দেওয়ায় নিজেকে সরিয়ে নিলেন অ্যাডলেড। সেই বেদনা বাজল উদয়ের মনে।

Powered by Froala Editor