বাবার পাঠানো উপহার হাতে পেলেন না উদয়

শঙ্কর-সরণি – ৩

আগের পর্বে

উদয়শঙ্করের মা হেমাঙ্গিনী দেবী ছিলেন সুন্দরী। কিন্তু পিতৃগৃহে প্রথাগত লেখাপড়ার সুযোগ তেমন হয়নি। অন্যদিকে বাবা শ্যামশঙ্কর ছিলেন উচ্চশিক্ষিত, সেইসঙ্গে সাহেবি আদব-কায়দায় অভ্যস্ত। দুজনের দাম্পত্য জীবন খুব সহজ ছিল না। শ্যামশঙ্কর এর মধ্যে এক মেমসাহেব ডাক্তারকে বিয়ে করলেন। হেমাঙ্গিনী দেবী এই অপমান সহ্য করতে পারলেন না। কিন্তু আবারও স্বামীগৃহে ফিরতেই হল। অবশ্য তিনি পৃথক সংসার পাতলেন। শ্যামশঙ্করের দ্বিতীয়া স্ত্রী বেশিদিন বাঁচেননি। তাঁদের কোনো সন্তান ছিল না। অন্যদিকে হেমাঙ্গিনী দেবী ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই রত্নগর্ভা। যদিও ছেলেরা কেউই বাবাকে খুব বেশি কাছ থেকে পাননি। তারপর…


৮ ডিসেম্বর উদয়শঙ্করের জন্মদিন। ১৯০০ সাল। কিশোরী বয়সেই মা হয়েছিলেন উদয়শঙ্করের মা হেমাঙ্গিনী। উদয় তাঁর প্রথম সন্তান। নসরতপুরে হেমাঙ্গিনীদের বিশাল বড়ো বাড়ি। লোক-জন-আত্মীয়-স্বজন-দাস-দাসী-তে গমগম করত চারদিক। এলাহি আয়োজনের বেড়া-লাগানো চারপাশ। লেগেই থাকত রোজকার পালাপার্বণ। প্রায়ই বসত ভিয়েন। ঢাউস উনুনে চড়ত রকমারি রান্না। ময়রা আর রাঁধুনিদের ছুটোছুটিতে তোলপাড় হত বাড়ি। প্রকৃতিও অঢেল হয়ে  থাকত বারোমাস। রঙবাহারি ফুলে-ফুলে উজাড় ছেয়ে থাকত পথ-ঘাট।

সক্কাল-সক্কাল স্নান সেরে হেমাঙ্গিনীর বাবা অভয়চরণ সুর করে পড়তেন তুলসীদাসের রামায়ণ। কখনও-কখনও চোখ যেত এদিক-ওদিক। অনিয়ম দেখলে হাঁক পারতেন। পড়া থামিয়ে ঠাকুর-চাকর-লেঠেল-গাড়োয়ান-পালকি বেহারাদের হুকুম দিতেন। ফরমাশ মতো কাজ চলছে বুঝে নিয়ে ফের মন দিতেন পড়ায়। কর্ত্রীহীন ছিল সংসার, কিন্তু শ্রীহীন হতে দেননি তাকে।

নসরতপুর, কাশী আর ঝালোয়ার--- মূলত এই তিনটি জায়গা জুড়েই উদয়ের বড় হওয়া। নসরতপুরে যখন রয়েছেন তখন সাত-আট বছর বয়স হবে তাঁর। জমিদারি আদব-কায়দা মেনে শুরু হল  পড়াশোনা। কিন্তু বই-পত্র-ছড়া-নামতা-যোগ-বিয়োগ মাথামুণ্ডু কিচ্ছু ভালো লাগে না তাঁর। ভারি ভালো লাগে ছবি আঁকতে। গাছের ওপর আলো-পাখি, রোদ-ছায়া আর ভেতর আঙিনায় হন্ত-দন্ত মানুষ তার হরেক কাণ্ড-কারখানায় হাঁ হয়ে থাকতেন তিনি। দৃশ্য তাঁকে টানত। যত্রতত্র সেইসব এঁকে ফেলার চেষ্টা চলত দুদ্দাড় । ছেলের এই স্বভাবের খোঁজ রাখতেন হেমাঙ্গিনী।

দেউড়ির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত টো টো ছুটে বেড়ানোয় তার বিরাম নেই। হেঁশেলের বাইরে বারকোশ বিছিয়ে মেঠাই তৈরির পাক চলছে। ঢাউস লোহার কড়াইতে ঘন দুধের সর পড়েছে অ্যাইয়া মোটা হয়ে। তার মধ্যেই পাটকাঠি ডুবিয়ে চোঁ-চোঁ খানিক দুধ টেনে একছুট সে তল্লাট থেকে। অভয়চরণ প্রতি বছর লিচু বাগানের মরসুমি স্বত্ব বিক্রি করতেন কুজড়াদের। পাখি এসে লিচু নষ্ট করে বলে গাছের ঝোপে-খোপে তারা দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখত টিন। সারাদিন দড়ি ধরে পাখি তাড়ানো ভারি ঝক্কির কাজ। কিন্তু উদয় মুগ্ধ হয়ে এক মনে তাদের কাজ দেখে, হাতে হাতে  জুড়ে যায় তাদের সঙ্গে। খুশি হয়ে ওরাও লিচু দিয়ে হাত ভরে দেয় তার।

ছেলের এইসব দুরন্তপনায় একরকম সস্নেহ দৃষ্টি ছিল হেমাঙ্গিনীর। স্বভাবকে নিয়ে জোরাজুরি এ থেকে চিরদিন যথাসম্ভব নিজেকে দূরে রেখেছেন তিনি। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি উদয়ের এই তীব্র অবহেলা আর অমনোযোগকে মেনে নিলেন না অভয়চরণ। বাড়ির বাকি অভিভাবকরাও, বিশেষত তাঁর তিন মামা। ফলে কারণে- অকারণে নেমে এল শাসন। আর শাসনের প্রতিরোধে উদয় ক্রমশ হয়ে উঠল চঞ্চল, জেদি, খানিক বেপরোয়া।

একদিন কী একখানা পাখি দেখে তখনই আঁকতে শুরু করলেন উদয়। জমিদার বাড়ির পরিপাটি গৃহসাজ, সাফ-সুতরো সফেন-সাদা দেওয়াল। কয়লার টুকরো দিয়ে সেখানেই শুরু হয়ে গেল তাঁর শিল্পকর্ম। ঘরের পাশ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবার সময় মামা দেখলেন চকিতে, এই বেআক্কেলে কাণ্ড। উত্তরোত্তর ক্রোধে ফেটে পড়লেন তিনি। ধাঁ করে এসে একটা চড় কষিয়ে দিলেন তার গালে। হেমাঙ্গিনীর কাছে পৌঁছল কথাখানা। তিনি নিশ্চুপ রইলেন। পিতৃগৃহে ছিলেন কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে সসংকোচ কাটাতে হয়েছিল জীবন।

পরে কোনোসময় হয়তো এমন আরো কিছু ঘটে থাকবে। তখনও হেমাঙ্গিনী আর শ্যামশঙ্করের দাম্পত্য শুধু দুজনেরই। চিঠির দেওয়া-নেওয়া চলত। হয়তো বা সন্তানকে নিয়ে এমনই কোনো বেদনার কথা চিঠিতে জানিয়ে থাকবেন স্বামীকে। শ্যামশঙ্কর তখন কলকাতায়। স্ত্রীকে লিখলেন,  হোয়াইটওয়ে লেইড’ল থেকে খোকার জন্য একটা উপহার কিনেছি। ওর নামেই পার্শেল পাঠালাম। পার্শেল এসে পৌঁছল অভয়চরণের বাড়িতে। আনন্দ-অপেক্ষা-আগ্রহ-কৌতূহলে ভেসে যাচ্ছে উদয়। উদগ্রীব উদয় চেয়ে দেখে মোড়কের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল, মস্ত বিলিতি পেইন্টিং বক্স। এমন জিনিস কেউ দেখেনি কখনও। কল্পনাও করেনি। অভয়চরণ ক্রোধ প্রকাশ করলেন, যা তাঁর বয়সোচিত নয়। তাঁর সম্ভ্রমের ক্ষেত্রেও একান্ত বেমানান। তবুও। প্রশ্ন করলেন, এটা কী? ভয়ে, লজ্জায় সন্ত্রস্ত হেমাঙ্গিনী জবাব দিলেন, খোকার ছবি আঁকার শখ। তাই উনি পাঠিয়েছেন। শীতল-কাঠিন্যে শান্তস্বরে অভয়চরণ বললেন, খোকা কি পটুয়া হবে, না কুমোর? অভয়চরণ চলে গেলেন। যাবার সময় সঙ্গে নিলেন বাক্সটা। উদয় অথবা হেমাঙ্গিনী সে বাক্স আর কখনও দেখবার সুযোগ পাননি।

বহুদিন পর বিদেশ থেকে ফিরলেন শ্যামশঙ্কর। প্রথমে উঠলেন কাশীর চক অঞ্চলে অভয়চরণেরই একটি বাড়িতে। ছেলেদের নিয়ে হেমাঙ্গিনী তখন সেখানেই রয়েছেন। সেখান থেকে পরিবার নিয়ে তিনি এলেন তাঁর কর্মস্থল রাজস্থানের ঝালোয়ারে। এখন  আরো একটু বড়ো হয়েছেন উদয়।  সঙ্গে পাঁচ বছরের ছোটোভাই রাজেন্দ্র আর সাত বছরের ছোটৌ দেবেন্দ্রও আছে। এমন সাজানো, পরিচ্ছন্ন শহর ভালো লাগল তাঁর। কী বর্ণাঢ্য পরিবেশ। পোশাকে, গৃহনির্মাণে, রোজকার জিনিসপত্রে সর্বত্র রঙের কী কারুকাজ। কী মাতামাতি কী খেলা রঙ নিয়ে। খুব কাছ থেকে রাজার বাড়িকে দেখলেন উদয়।  ঝালোয়ারের মহারাজা ছিলেন শিল্পরসিক। তাঁর ছিল এক রাজকীয় অভ্যাস। বড়ো বড়ো গাইয়ে-বাজিয়ে ছিল তাঁর রাজবাড়িতে। তারা-ধরা নিঝুম রাত্রে  রাজা ঘুমোবার সময় তাঁরা গাইতেন সময়োচিত গান, আবার ভোরের আকাশে রঙ ধরতে-না-ধরতেই তাঁরাও ধরতেন ঘুম-ভাঙানিয়া সুর। সেই আবহে ঘুম ভাঙত রাজার।  

রাজস্থান যেন চলমান ছবির মতো ভেসে চলেছিল তাঁর চোখের সামনে। এইখানেই রাজঘরানার এক বিচিত্র উৎসবকে প্রথম দেখলেন তিনি। গঙ্গৌর উৎসব। চৈত্র মাসে পার্বতীর মূর্তি নিয়ে রাজবাড়ি থেকে শুরু হবে শোভাযাত্রা। প্রদক্ষিণ সেরে ফিরবে সন্ধে-শেষে। রাজবাড়ির চত্বরে মশালের আলো। ময়ূরপুচ্ছের চামর হাতে দাঁড়িয়ে আছেন পূজারিরা। শ্বেত-শুভ্র চামর তাঁরা মেলে দিচ্ছেন আকাশের দিকে। তারপর নেমে আসছে ঠিক তেমনই লয়ে। হাতির পিঠে স্বয়ং রাজা।  মণি-মুক্তো-জহরত গাঁথা গহনায় তাঁকে আরো সুন্দর লাগছে। সেই মুহূর্ততে বিভা ছড়িয়ে দিয়েছে বিচিত্র বাদ্যের সমাহার। রাজনর্তকীর নৃত্যের সঙ্গে বেজে চলেছে সারেঙ্গি, ঘড়া, একতারা, মুরালি, খঞ্জনি আর ঘুঙুর। রাতের অন্ধকারে মানুষের তৈরি এই স্বর্গীয় উৎসব, সেই মোহময় পরিবেশে বালকের মুগ্ধতার যেন সীমা রইল না।

রাজপুতদের আরো একটা উৎসব ছিল। অস্ত্রপুজো। দুর্গার মূর্তির সামনে রাজপুরোহিত পাঠ করবেন শক্তিরূপিনী দশভুজার মন্ত্র। রাজপুতরা যুদ্ধ-করা-জাতি। তখন তো আর যুদ্ধের প্রয়োজন নেই কিন্তু শৌর্য-বীর্যকে নিজেদের মধ্যে জাগ্রত রাখাই ছিল অস্ত্রপুজোর রীতি। আরো একটা মজার ব্যাপার ছিল তাঁদের, সে হল তলোয়ার খেলা। খাপ থেকে তলোয়ার খুলে নিয়ে নিজের মাথার আর শরীরের চারপাশে ঘোরাতে হবে নির্বিঘ্নে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিচিত্র সংস্কৃতি আর বিবিধ জনমানসের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়েছিল উদয়শঙ্করের বাল্য আর কৈশোর। আর সেইসূত্রেই বোধকরি যা কিছু দেশীয় সম্পদ, আচার-আচরণ, উৎসব-পার্বণ তা অতি সন্তর্পণে গ্রহণ করছিল তাঁর মন।

রাজপরিবারের সংলগ্ন হয়ে থাকতে-থাকতেই আরেকটা দুর্লভ বিষয়কে লাভ করেছিলেন শঙ্কর। সে হল বই। রাজার গ্রন্থাগার ছিল চেয়ে দেখবার মতো। এমনকি, রাজার শয়নকক্ষ জুড়েও নাকি থাকত বই। যুদ্ধনীতি, চিত্রকলা, দর্শন, ইতিহাস, খেলা, নৃতত্ত্ব বিচিত্র জগতের রাজকীয় সংগ্রহ। রাজা শৌখিন ছিলেন, পণ্ডিতও। জাহাজে করে নানা দেশ থেকে পার্সেল করে সেরা সব বই আসত তাঁর জন্য। চোখের সামনে সমস্ত পৃথিবীর দরজা খুলে রাখার মতো সেইসব আশ্চর্য অভিজ্ঞতা বড় সামান্য কথা নয়।

নসরতপুরে ফেরবার সময় হল। কিন্তু যা অদ্ভুত, তা হল পিতার সান্নিধ্যেও তাঁকে পাওয়া হল না সন্তানদের। প্রবাসে থাকতেও তাঁর কর্তব্যবোধ অথবা বাৎসল্য কোনোটাই নিরবিচ্ছিন্ন ধারাবহিক হতে দেখেনি কেউ। তবু সম্পর্কের একটা আভাস বুঝি পাওয়া যেত। কিন্তু এখানে ঘরের মধ্যে থেকেও তিনি যেন বহু দূরের। তাঁর পড়াশোনা-কর্মব্যস্ততার বলয় ডিঙিয়ে উঁকি দেবার সাধ্য কি? বরং কাছে এসে দূরত্ব হয়ে উঠল দুর্লঙ্ঘনীয়। তাঁর পাণ্ডিত্য আর কঠিন আভিজাত্যের অনুশীলন যেন চির লক্ষ্মণরেখা টেনে দিল সংসার আর সন্ততিদের অনুপ্রবেশে।

Powered by Froala Editor