হেমাঙ্গিনী দেবী: মনের দিক থেকে একলা রেখেছিলেন নিজেকে

শঙ্কর-সরণি – ২
আগের পর্বে

যশোরের বাটাযোর গ্রামে জন্ম অমলার। বাবা অক্ষয়কুমার নন্দী ছিলেন পেশায় স্বর্ণকার। ঋষি অরবিন্দের ভক্ত ছিলেন তিনি। বিলেতি জিনিস তাই বাড়ির চৌহদ্দিতে প্রবেশ করত না। গ্রামের মেয়েদের কাঁচের চুড়ি পরাতেও বাধা দিয়েছিলেন তিনি। বাড়ির উঠোনে চাল ছড়িয়ে দিয়ে বলতেন দেশের ছবি গড়ে তুলতে। মেয়েদের শিক্ষার বিষয়ে অক্ষয়কুমারের বিশেষ আগ্রহ ছিল। গ্রামীণ ধর্মবিশ্বাস রীতিনীতির সঙ্গে বাবার প্রগতিশীল চিন্তার মিশেলেই অমলার বেড়ে ওঠা। নৃত্যশিল্পের পাশাপাশি ছবি আঁকতে শিখেছিলেন নিজে নিজেই। অক্ষয়কুমার দেশের হস্তশিল্পকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে বিদেশযাত্রা করেছিলেন। তাই নিয়ে গ্রামে শুরু হয়েছিল ধুন্ধুমার কাণ্ড। শেষে স্ত্রীর মধ্যস্থতায় সব শান্ত হল।

হেমাঙ্গিনী দেবী ছিলেন উদয়শঙ্করের মা। গায়ের রঙ ছিল ফর্সা। তাই হেমাঙ্গিনী। দেখতে সুন্দর ছিলেন খুব। উদয়শঙ্করের মাতামহ অভয়চরণ চক্রবর্তী, ওঁরা ছিলেন জমিদার। গাজিপুরের নসরতপুরে ছিল তাঁদের বাস। আরো একটা বাসা ছিল। কাশীতে। জমিদার কিন্তু সেতার বাজানোয় এঁর ছিল ভারি সুনাম। হেমাঙ্গিনীর যখন নয় আর শ্যামশঙ্করের যখন একুশ বছর বয়স, তখন তাঁদের বিবাহ হয়।

শ্যামশঙ্কর ছিলেন খুব উঁচুদরের পণ্ডিত। সংস্কৃত আর দর্শন নিয়ে তাঁর ছিল গভীর পড়াশোনা। ব্যারিস্টারি পড়েছিলেন অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি-তে। তবে শুধু পড়াশোনা নয়, উচ্চাঙ্গ সংগীতের ওপর তাঁর দখল ছিল সুবিদিত। পড়াশোনা শেষ করে তিনি হলেন উদয়পুরের মহারাজার পারিবারিক শিক্ষক। শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি ছিল। সে যুগেও সে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দূর-দূরান্তে। পরে তিনি হলেন ঝালওয়ার-এর মহারাজার দেওয়ান।

ঝালওয়ারের মহারাজার সঙ্গে একবার গিয়েছেন ইংল্যান্ডে। এসে পৌঁছল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের খবর। বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে মহারাজা ফিরলেন কিন্তু সহায়-সম্বলহীন শ্যামশঙ্কর আটকে গেলেন ওই বিদেশ-বিভুঁয়ে। স্বজনহীন-সংকটে জীবন নির্বাহের জন্য ইংরেজি সাময়িক পত্রিকায় লিখতে শুরু করলেন ভারতবর্ষকে নিয়ে। ইংরেজিতেই প্রকাশ করলেন দুটি বইও। 

উদয়শঙ্করের পিতামহ বরদাশঙ্কর চৌধুরীও ছিলেন যশোরের জমিদার। ব্রাহ্মণ। শঙ্কররা আদতে ছিলেন চট্টোপাধ্যায়, ওঁরা উপাধি পেয়েছিলেন হরচৌধুরী। হর আর শঙ্কর সমার্থক হওয়ায়, চৌধুরীটুকুই ব্যবহার করতেন তাঁরা। কিন্তু একবার বিলেত যাবার সময় পাসপোর্টে শ্যামশঙ্কর ব্যবহার করলেন শুধু শঙ্করটুকুই। সেই সময় থেকে ওই মিডল নেম বা মধ্যনামটাই ধীরে ধীরে হয়ে উঠল পদবি। শঙ্কর।

শ্যামশঙ্কর যে পড়তে ভালোবাসতেন সেই কারণেই চিরদিন তিনি ছিলেন ঘরের বাইরে-বাইরে। সবই দেখতেন-শুনতেন কিন্তু তবু ঘর যেন তাঁকে টানেনি সেভাবে। সেই সঙ্গে জীবনকে নিয়ে তাঁর ছিল গভীর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সন্তানরা বাবার মেধা-প্রতিভার উত্তরাধিকার পেয়েছিল, সান্নিধ্য পায়নি। রবিশঙ্কর বাবাকে পেয়েছিলেন সবচেয়ে কম। উনি বলতেন, সব মিলিয়ে তিনি বাবাকে পেয়েছেন দেড় মাস মতো, বড়োজোর দুমাস। টানা নয়। দিন গুনে গুনে। দিন জুড়ে জুড়ে। শুধু পড়াশোনাই নয়, শ্যামশঙ্করের বাইরের প্রতি আকর্ষণের অন্য একটা কারণও ছিল। খুব অল্প বয়সেই  শ্যামশঙ্কর দেখেছিলেন পশ্চিমকে। তারপর ফিরে রাজা-রাজড়াদের ঘরই হয়ে উঠল তাঁরও ঘর। সেখানে তিনি পেলেন তাঁর যোগ্য সম্মান। গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে তাঁকে সারাক্ষণ ঘুরতে হত রাজা-রাজড়াদের সঙ্গে। লন্ডন, জার্মানি, সুইটজারল্যান্ড, কখনও-বা ভারতের পাহাড়েই রইলেন রাজাদের সঙ্গে। রাজার ঘর বলে নয়, কিন্তু বোধ করি জীবনের এই রাজকীয়ত্ব স্পর্শ করেছিল তাঁর মন।

চার পুত্রের সঙ্গে শ্যামশঙ্কর

 

বারো বছর বয়সে প্রথম মা হলেন হেমাঙ্গিনী। উদয়শঙ্করই তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান। তিনি রত্নগর্ভা ছিলেন, ঠিক কথা। সন্তানরা পিতার মেধা আর প্রতিভার অধিকারী হয়েছিল, সেকথাও ঠিক। তবু  তাঁদের গড়ে তোলার ব্যাপারে হেমাঙ্গিনীর পরিশ্রম ছিল নিঃসঙ্গ এবং নিঃশব্দ। মূলত পিতৃগৃহেই হেমাঙ্গিনী লালন-পালন করেছেন সন্তান তা সত্ত্বেও মসৃণ ছিল না পথ।

হেমাঙ্গিনী সাত পুত্রের জননী। উদয়শঙ্করের পরের জন জন্মেই মারা যান। এরপর রাজেন্দ্রশঙ্কর, দেবেন্দ্রশঙ্কর, ভূপেন্দ্রশঙ্কর। ভূপেন্দ্রর পরের জন জীবিত ছিলেন মাত্র ন মাস। ভূপেন্দ্রও মারা যান নিতান্ত কিশোর বয়সে। প্লেগে। সর্বকনিষ্ঠ সন্তান রবিশঙ্কর।         

হেমাঙ্গিনীর মা ছিলেন না। অভয়চরণের সংসারে তাঁর শাশুড়িমাতাই ছিলেন গৃহকর্ত্রী। তিনিই আগলে রেখেছিলেন অভয়চরণের সন্তানদের। মাতৃহীন এই বালিকার পড়াশোনার তেমন সুযোগ ছিল না পিতৃগৃহে। প্রথামতো শিক্ষা তাই তাঁর ছিল না। অন্যদিকে শ্যামশঙ্কর পণ্ডিত তায় বিদেশের আদব-কায়দায় অভ্যস্ত আর তার ওপর রাজা-রাজরাদের জমজমাট জীবন। হেমাঙ্গিনীকে যেন তিনি দূরে-দূরেই রাখলেন। কাজের সূত্রে শ্যামশঙ্করকে সর্বদা বাইরে-বাইরে ঘুরতে হত বলে বিবাহের পরেও হেমাঙ্গিনী সন্তানদের নিয়ে থাকতেন বাবার কাছে। নসরতপুরে।

একবার স্বামীর ফেরবার সংবাদে হেমাঙ্গিনীও বাবার কাছ থেকে ফিরলেন ঝালওয়ারে। দুই সন্তানকে নিয়ে স্বামীর গৃহে পৌঁছবেন, পথে পেলেন এক সংবাদ। ঝালওয়ারের রাজবাড়িতে রানিমার জন্য ছিলেন এক মেমসাহেব ডাক্তার। হেমাঙ্গিনী যখন গাজিপুরে তখন শ্যামশঙ্কর তাঁকে বিবাহ করেন। খবর পেলেন তাঁরই সংসারে স্বামী পেতেছেন নতুন সংসার। চরম শোক আর প্রবল অসম্মানের সামনে নিথর দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। অমলা জানিয়েছিলেন, চিরজীবন এই শোক সম্পর্কে এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ্যকেই বহন করতেন তিনি। শ্যামশঙ্কর লক্ষ করেছিলেন কি না কে জানে, তবে নিজের অমন অমর্যাদাতেও স্বভাবের রাজকীয়ত্বকে কীভাবে ধরে রাখতে হয়, তা প্রকাশ পেয়েছিল তাঁর ব্যবহারে। প্রথাগত পড়াশোনা হয়তো করেননি, কিন্তু শিক্ষা আর আত্মমর্যাদার অভাব ছিল না তাঁর চরিত্রে। পথ থেকেই ফিরে গেলেন গাজিপুরে।

চার পুত্রের সঙ্গে মা হেমাঙ্গিনী

 

কিন্তু ফিরবেন কোথায়? স্বামীর ঘর বলে কথা। হেমাঙ্গিনী পিতার আদুরে ছিলেন খুব। তবু তাঁকে ফিরতে হল স্বামীর ঘরেই। তাঁর মন বুঝতে চাইলেন না অভয়চরণ আর গৃহকর্ত্রী তাঁর দিদিমা-ও। ফেরত পাঠালেন তাঁকে ঝালওয়ারে। ফিরলেন বটে কিন্তু স্বামীর গৃহে গেলেন না। ছেলেদের নিয়ে সংসার পাতলেন স্বতন্ত্র। অদ্ভুত ছিল এঁদের দাম্পত্য। হেমাঙ্গিনী ক্ষোভ প্রকাশ করলেন না। ক্রোধ-ও না। শ্যামশঙ্করের যাতায়াত রইল উভয়ত্র। নিজের সংসারেই হেমাঙ্গিনী পালন করলেন স্ত্রীর কর্তব্য।

শিক্ষার অভাব বলেই তাঁকে সরে সরে থাকতে হয়েছিল দাম্পত্য থেকে। অথচ তাঁর চরিত্রের গভীর সম্ভ্রমের কথাটি খেয়াল করলে মনে হয়, আগাগোড়া শিক্ষাই তো ছিল তাঁর স্বভাব জুড়ে। উদয় বড়ো হয়ে মা-কে নিয়ে গিয়েছিলেন প্যারিস। বিদেশে আশ্চর্য সহজ ছিল তাঁর গতিবিধি। ফরাসি শিখে নিয়েছিলেন দ্রুত। ফরাসি পরিচারিকাকে সঙ্গে নিয়ে বিদেশে দিব্যি সামলাতেন ছেলেদের সংসার। এতটুকু অপ্রতিভ ছিলেন না কোনো বিষয়ে। ঈশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল, কিন্তু নিয়ম করে পুজো আর আচারের মধ্যে জীবনকে জড়াননি কখনও। দরাজ ছিল তাঁর গানের গলা। ছেলেদের সঙ্গে পার্টি-তে যেতেন। অল্প-স্বল্প ওয়াইন খেতেও তাঁর দ্বিধা ছিল না কোনোরকম। গভীর ছিল তাঁর মন। বিদেশে যখন তাঁকে প্রথম দেখেন অমলা, তখন এয়োতির চিহ্ন ছিল তাঁর শরীরে। সিঁদুর, শাঁখা। কিন্তু বিদেশ থেকে জাহাজে ফিরছেন যখন দেশে, পরিজন থেকে বহুদূর বহুদিন, সেইসময় সুখ-দুঃখের নানা কথার মাঝে একদিন জানিয়েছিলেন অমলাকে, সিঁদুর পরি কিন্তু ইচ্ছে কখনও হয়নি পরতে। অমলার মা তাঁকে একবার উপহার দিয়েছিলেন একটা শাড়ি আর একটা রুপোর সিঁদুর কৌটো। তিনি গ্রহণ করেছিলেন শুধু শাড়ি-টাই। তাঁর মনের থই পেতে এ যুগেও বিস্মিত হতে হয়। শ্যামশঙ্করের দ্বিতীয় স্ত্রী দীর্ঘজীবী হননি। প্যারিসে শ্যামশঙ্কর-ও কখনও থাকতেন এই সংসারে। স্বামীর প্রতি তাঁর যত্ন ছিল ত্রুটিহীন। সেবাও। কিন্তু মনের দিক থেকে নিজেকে একলা রেখেছিলেন তিনি। নিজের গর্ভের অধিকার দিয়েছিলেন স্বামীকে, বোধ করি মনের অধিকার নয়।

Powered by Froala Editor