অহঙ্কারের ইনজেকশন চলেচে, বললেন রবীন্দ্রনাথ

শঙ্কর সরণি - ২৯
আগের পর্বে

ইউরোপজুড়ে উদয়শঙ্করের দলের সম্মান দিন দিন বাড়তে থাকল। এমন নানা রঙ্গালয়, যেখানে খোদ ইউরোপের শিল্পীরাও অনুষ্ঠানের অনুমতি পান না, সেখান থেকেও ডাক এল তাঁর দলের। কোথাও কোথাও দর্শকের চাহিদা মেটাতে একদিনে একাধিক অনুষ্ঠান করতে হল। তবু এই যশের মধ্যেও হঠাৎই ঘনিয়ে এল বিষাদের ছায়া। উদয়শঙ্করের দলকে পূর্ণতা দিয়েছিল তিমিরবরণের সুর। কিন্তু সেই সুরসম্রাট আবারও চঞ্চল হয়ে উঠলেন। নৃত্যের আসরে তিনি তো হোতা নন। তাঁর সৃষ্টিও সেখানে পূর্ণতা পায় না। তাছাড়া, তিমিরবরণকে পেয়ে সমস্ত বিদেশী বাদ্যযন্ত্র পরিহার করেছিলেন উদয়শঙ্কর। কিন্তু সঙ্গীতপিপাসু তিমিরবরণ কাছ থেকে সেইসমস্ত যন্ত্র দেখে তৃপ্ত হচ্ছিলেন না। চাইছিলেন তার মধ্যেই সূরের পূর্ণতার সন্ধান করতে। অবশ্য উদয়ের প্রতি আন্তরিকতায় ছেদ পড়েনি কোনোদিন। কিন্তু আমেরিকা সফর থেকে ফিরে আর উদয়ের দলে থাকবেন না তিনি, স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন তিমিরবরণ।

উদয়শঙ্কর তখন ইংল্যান্ডে গিয়েছেন মাত্র সাত দিনের জন্য। লন্ডনের অল্প কয়েকটি জায়গাতেই আয়োজিত  হয়েছে তাঁর দলের নৃত্যপ্রদর্শনী।সেদিন বেশ ছোটো একটি প্রেক্ষাগৃহে চলছে অনুষ্ঠান। টিকিট না-পেয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছে বহু দর্শক। আর সেইদিনই অভাবিত এক সৌভাগ্য অপেক্ষা করে আছে উদয়শঙ্করের জন্য। অনুষ্ঠানের শেষে ধীমান এক ব্যক্তি এলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। উদয়শঙ্করের নৃত্যশৈলির প্রতি তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর মুগ্ধতা। তারপর দিলেন নিজের পরিচয়। জানালেন তাঁর নাম লেনার্ড এলমহার্স্ট। সঙ্গে রয়েছেন তাঁর স্ত্রী ডরোথি এবং ডরোথির কন্যা বিয়াত্রিচে। সপার্ষদ উদয়শঙ্করকে তিনি আমন্ত্রণ জানালেন, দক্ষিণ ডেভেনশ্যায়ারে তাঁদের এস্টেট টটনেস-এ। এলমহার্স্টকে ভালো লাগল উদয়শঙ্করের। ডরোথিকেও। স্মিতহাস্য, নম্র চেহারায় বিয়াত্রিচে দাঁড়িয়ে রয়েছেন অদূরে। প্রখর, তীব্র, অতলের থই না-পাওয়া রূপ তাঁর। উদয় দেখলেন, শ্বেতাঙ্গিনী নাগরিক বিয়াত্রিচের সৌন্দর্যের ওপর যেন বিছিয়ে রাখা ধীর গভীর নির্জন এক ছায়া। কালক্রমে এই বিয়াত্রিচেই হয়ে উঠবেন ডাকসাইটে অভিনেত্রী। নৃত্যের সঙ্গে কোনদিনই কোনো সম্পর্ক নেই তাঁর, তবু আসন্ন ভবিষ্যতে উদয়শঙ্করের সঙ্গে তিনি  পেরোবেন এক অমলিন যাত্রাপথ।

উদয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা হওয়ার অনেক আগেই, এলমহার্স্টের পরিচয় হয় ভারতবর্ষের সঙ্গে। সম্বন্ধ তৈরি হয় রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। ১৯১৫-তে ভারতবর্ষে এসেছিলেন এলমহার্স্ট। দুর্দশাগ্রস্ত চাষিদের দেখে তখনই স্থির করেন, ভবিষ্যতে কাজ করবেন তাদের উন্নতি প্রকল্পেই। এলমহার্স্ট পড়াশোনা করেছিলেন ইতিহাস নিয়ে। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে। আবার নতুন করে শুরু করলেন পড়াশোনা। কৃষিবিজ্ঞান নিয়ে, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯২০-২১ সাল নাগাদ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলাপ হয় লেনার্ড নাইট এলমহার্স্টের (১৮৯৩-১৯৭৪)। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে তাঁকে আহ্বান জানালেন ।

বিয়াত্রিচে।

 

পড়াশোনা শেষ করে যথাসময়ে এলমহার্স্ট এলেন শান্তিনিকেতনে। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সন্তোষচন্দ্র মজুমদার, কালীমোহন ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে শুরু হল তাঁর গ্রামোন্নয়ন এবং পল্লীপুনর্গঠনের কাজ। কাজে যোগ দিয়ে এলমহার্স্ট বাংলা শিখতে আশ্রয় নেন হেমলতা দেবীর। আর রবীন্দ্রনাথের ভাষণ বুঝতে দ্বারস্থ হতেন পিয়র্সনের কাছে। গ্রামকে উজ্জীবিত করে তোলার বিষয়ে অদ্বিতীয় ছিল তাঁর ভূমিকা। অদৃষ্টপূর্ব ছিল তাঁর পরিশ্রমের ধরন। পল্লীপুনর্গঠনে তাঁর ভাষণও লাভ করে অতুলনীয় গুরুত্ব। ঐতিহাসিক ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে কৃষির অবনতির কারণ ও তার প্রতিকারের উপায় বিষয়ে অসামান্য সব বক্তৃতা দেন তিনি। তবে শুধু ভাষণ আর পরিকল্পনা নয়, সাহেব কাজ করতেন মাঠে নেমে। গাছ কাটা, মাটি খোঁড়া, ড্রেন তৈরি, ছাত্র-কর্মীদের গৃহনির্মাণ, মুরগি-ছাগল-গরু পালন, ডেয়ারি প্রস্তুতি সমস্ত কিছুকে গড়ে তুললেন নিজের হাতে। এলমহার্স্টের কাজের হালহকিকত জানলে শুধু যে শ্রদ্ধাবনত হতে হয়, তাই-ই নয়, কখনও-কখনও অশ্রুমেদুর হয়ে ওঠে মন। গ্রামে সার নির্মাণ প্রকল্পে এলমহার্স্ট স্বয়ং বহন করতেন বিষ্ঠা। তটস্থ বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়ে তাঁকে দেখত গ্রাম। ঘৃণা, অস্বস্তি আর সংস্কার ভুলে তাঁর ব্যবহারে অনুপ্রাণিত হয়ে, পরবর্তী সময়ে এ-কাজে হাত লাগায় ছাত্ররাও। গ্রামকে সার্বিকভাবে রক্ষা করতে চেয়ে বিদেশি মানুষের এই আত্মত্যাগে নজির গড়েছিলেন এলমহার্স্ট।

আরও পড়ুন
আজ কোথায় যেন বেসুর বাজল সব

এলমহার্স্টের চরিত্র আর তাঁর কর্মপ্রকৃতির আরো একটি  মজার বিষয় খুব আশ্চর্য করে আমাদের। ছাত্র হিসেবে শান্তিনিকেতনে, তখন মূলত যারা, বিদ্যাসাগরের ভাষায়, ‘রাখাল’ গোত্রীয়, কাজের গোড়ার দিকেই তিনি সন্ধি পাতিয়ে ছিলেন সেইসব ‘অত্যুৎসাহী’ কিশোরদের সঙ্গে। দুষ্টু প্রকৃতির ছাত্রদের উৎপাত-উপদ্রবের সমস্ত শক্তিকে তিনি জুড়ে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন, পল্লীপুনর্গঠনের কাজে।

আরও পড়ুন
ছোটো ছিলেন তবু কথাটা বুঝেছিলেন অমলা

ডরোথি এলমহার্স্ট আগে ছিলেন ডরোথি স্ট্রেইট। ছিলেন, ধনীর কন্যা এবং ধনীর ঘরণী। প্রথম স্বামী স্ট্রেইটের মৃত্যুর পর উদ্যমী, বিচক্ষণ, দরদী এই যুবক এলমহার্স্টের প্রতি প্রণয়াসক্ত হন তিনি। এলমহার্স্টের মধ্যস্থতায় বিশ্বভারতীতে, একটি বিশাল পরিমাণ অনুদানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন ডরোথি।

আরও পড়ুন
সুরের কাছে হার মেনেছে হাজার কথার হল্লা

রবীন্দ্রনাথ ও এলমহার্স্ট।

 

আরও পড়ুন
পিছনে ফিরে উদয়শঙ্কর সজোরে মারলেন এক ঘুঁষি

১৯২১-২২ সালে এলমহার্স্ট নিয়মিত লিখতেন শ্রীনিকেতনের দিনপঞ্জি। লিখেছেন, ‘The Robbery of the Soil’ নামে সুচিন্তিত বক্তৃতা। পরিবর্তমান সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বীরভূমের মাটির প্রকৃতিগত পরিবর্তনের বিষয় সম্পর্কিত সেই লেখায় আমরা লক্ষ করি এক উদ্বিগ্ন পরিবেশবিদকে।  এইসব লেখা তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশ করে বিশ্বভারতী। ‘Poet and Plowman’ সেই বিখ্যাত বই।

কাজ করার পাশাপাশি প্রখর সচেতন এক ইতিহাসবিদের ভূমিকাও পালন করেন এলমহার্স্ট। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথের চিন ও দক্ষিণ আমেরিকা ভ্রমণকালে এলমহার্স্ট সামলান কবির সচিবের দায়িত্ব। সেই যাত্রার প্রাক্কালে সুরুলের কাজের সজীব পরিচয় উপস্থাপনার জন্য তিনি উদ্যোগ নেন একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের। গৃহীত হয় রবীন্দ্রনাথের চলমান চিত্রমালাও। এলমহার্স্টের বিদায় সংবর্ধনায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে সম্মানিত করেন ‘দেশিক’ উপাধিতে। আর অনেক পরে ১৯৬০ সালে বিশ্বভারতী তাঁকে বরণ করে নেয়, ‘দেশিকোত্তম’ শিরোপায়। শান্তিনিকেতন থেকে ইংল্যান্ডে ফেরার পর রবীন্দ্রনাথের পল্লীপুনর্গঠনের আদর্শে, তিনি ও তাঁর স্ত্রী ডরোথি, ডার্টিংটন এস্টেটে নির্মাণ করেন এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। রবীন্দ্রনাথের পল্লীপুনরুজ্জীবন চিন্তার এ এক আশ্চর্য আন্তর্জাতিক সীমানা বিস্তার। সেই ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন উদয়শঙ্করও। পরে তিনিও আলমোড়ায় গড়ে তুলবেন তাঁর সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যার সমস্ত আর্থিক দায়দায়িত্ব স্বেচ্ছায় গ্রহণ করবেন ডরোথি ও এলমহার্স্ট। 

১৯৩৩-এর মে মাসের শেষের দিকে উদয় তাঁর দল নিয়ে ফিরলেন ভারতবর্ষে। এবার সঙ্গে এলেন সিমকি। এতদিন তিনি ভারতবর্ষকে দেখেছেন উদয়ের মধ্যে দিয়ে। আজ তিনি দেখলেন সত্য ভারতবর্ষকে। অমলাশঙ্কর, রবিশঙ্কর থেকে শুরু করে প্রায় সকলেই উদয় আর সিমকির যুগলবন্দি নিয়ে প্রকাশ করেছিলেন তাঁদের অপার বিস্ময়। সুর-তাল-লয়ের ছন্দোবন্ধনে নিখুঁত ছিল তাঁদের বোঝাপড়া। নির্ভার, অনায়াস ছিল তাঁদের যৌথ পরিবেশন। সিমকির নৃত্য যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা সকলেই আশ্চর্যবোধ করেছেন আরো একটি বিষয়ে। তা হল, সিমকির নৃত্যে যে-ভাব, যে-আবেদন তার মধ্যে গভীর হয়ে রয়েছে একটা ইন্ডিয়াননেস। একটা ভারতীয় ছাঁদ। ভারতবর্ষকে, এই দেশের মানুষকে গাঢ় আন্তরিকতায় লক্ষ করলেন সিমকি বারবিয়ে।     

ডরোথি ও লেনার্ড এলমহার্স্ট।

 

দেশে উদয়শঙ্করের প্রতিষ্ঠার  বিষয়টিকে অত্যন্ত সন্তর্পণে গড়ে তুলছিলেন যিনি, তিনি হরেন ঘোষ। পরিকল্পিত, মেধাবী ছিল তাঁর পর্যবেক্ষণ। উদয়শঙ্করের প্রত্যাবর্তনকে ঘিরে জনমানসে তিনি তৈরি করলেন, এক আগ্রহ। প্রচারে-বিজ্ঞাপনে-প্রথিতযশা মানুষদের জুড়ে নিয়ে উদয়শঙ্করের স্থায়ী একটা ভাবমূর্তি তৈরি করতে চাইলেন তিনি। জুন মাস থেকেই শুরু হল অনুষ্ঠান। ১৩, ১৪, ১৬ তারিখে অনুষ্ঠান হল এম্পায়ার থিয়েটারে। টিকিট নিয়ে পড়ে গেল হাহাকার। শহর মাতিয়ে দিল উদয়শঙ্করের দল। ১৮ জুন টাউন হলে উদয়শঙ্করকে দেওয়া হল সংবর্ধনা। সভাপতিত্ব করলেন শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ। সেদিন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের লেখা গান গাইলেন, যুবক শচীন দেববর্মণ। সতী দেবী গেয়েছিলেন, রবি ঠাকুরের গান।

দল নিয়ে উদয় ঘুরবেন আরো কতক জায়গায়। যাবেন বর্মা। তারপর ঢাকা। তাছাড়া কয়েকটা প্রদেশেও। তারপর ফিরবেন কলকাতা। সলোমান হ্যুরকের সঙ্গে রয়েছে তাঁর চুক্তি। দ্রুত তাঁকে ফিরতে হবে আমেরিকাতে। তবে ফিরে যাবার আগে, রয়েছে, একান্ত একটি ইচ্ছা। বিশ্বচরাচরকে যিনি বেঁধেছেন তাঁর কারুবোধে। মানবের অস্তিত্বের সমস্ত প্রাঙ্গণে যিনি প্রোথিত করেছেন সংবেদনা। মানুষের মনের ওপর আধিপত্য বিস্তারের চেয়ে বড়ো অধিগ্রহণ আর কী আছে? শিল্পের সেই রাজাধিরাজ রবীন্দ্রনাথের সামনে তিনি পরিবেশন করতে চান তাঁর নৃত্য।

উদয়শঙ্করের খ্যাতি ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছিল কলকাতায় তথা অবিভক্ত ভারতের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও। কিন্তু হরেন ঘোষের মতো প্রখর দূরদৃষ্টিসঞ্জাত বুদ্ধিদীপ্ত মানুষ, ভাবছিলেন অন্য একটি বিষয়। উদয়শঙ্করের প্রতিভা কোনো পূর্বপরম্পরাকে ধারণ করেনি। তখনও তৈরি হয়নি তাঁর শৈলির তাত্ত্বিক প্রেক্ষিত। ঐতিহ্যকেই আশ্রয় করেছে তাঁর কলা। ভারতীয় পুরাণকে চলমান আর চিত্রময় করে তুলেছে তাঁর নৃত্য। দেশীয় লোকধারার এক মিশেলও তাকে বেঁধেছে অভিনব প্রকরণে। যুক্ত হয়েছে দেশীয় পালা আর অভিনয়ের ছাঁচ। আনন্দ কুমারস্বামীর গ্রন্থ আদি ভারতকে গেঁথেছে তাঁর মুদ্রায়, তবু গুরু আর ঘরানা-বিনা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে তাঁর সাবেকি পরিচয় নির্মাণ। ধীর অনুধ্যানে হরেন বুঝলেন, এই সমস্ত আপাত অপূর্ণতা মুহূর্তে হয়ে যেতে পারে বিলীয়মান, উদয়শঙ্করের নৃত্য যদি তৃপ্ত করতে পারে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে। দিগ্বিদিক থেকে ধেয়ে আসা অগণিত প্রশ্নকে নিমেষে করে দিতে পারে স্তব্ধ। রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতিতেই সম্ভব সেই কৌলীন্যের নির্মাণ। এই আকাঙ্ক্ষাকে মনের মধ্যে ধারণ করে প্রস্তুত হলেন হরেন ঘোষ। 

ডার্টিংটন হলের সামনে উদয়শঙ্কর।

 

৬ জুলাই ১৯৩৩, বৃহস্পতিবার, কলকাতার, ম্যাডানের প্যালেস অব ভ্যারাইটিসে আয়োজন করা হল উদয়শঙ্করের নৃত্যানুষ্ঠানের। সসম্মান আমন্ত্রণ জানানো হল রবীন্দ্রনাথকে। ১৯২০-তে লন্ডনের রয়্যাল আর্ট কলেজে উদয়শঙ্কর প্রথম দেখেছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য আর তাঁর কর্মের সঙ্গে উদয়কে প্রথম পরিচিত করিয়েছিলেন তাঁর গুরু অম্বিকাচরণ মুখোপাধ্যায়। তারপর আরেক গুরু উইলিয়ম রটেনস্টাইন তাঁকে জানিয়েছিলেন মানবসভ্যতায় তাঁর উপমারহিত অবদানের কথা। সশ্রদ্ধচিত্তে চিরদিন উদয় জেনেছেন তাঁকে, মেনেছেনও।     

রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এবং উদয়শঙ্করের জীবনীরচয়িতা সুধীরঞ্জন মুখোপাধ্যায় দুজনেই এই নৃত্যানুষ্ঠানের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু এর আগে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথ এবং উদয়শঙ্করের দেখা হয়েছিল কিনা সে বিষয়ে জানাননি কোনো তথ্য। ১৯৩৩-এর ৩ জুলাই, (১৯ আষাঢ় ১৩৪০) প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ ও সাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে একটি দীর্ঘ পত্র লেখেন রবীন্দ্রনাথ। যেখানে আগাগোড়া উদয়শঙ্করের বিনীত চরিত্রের প্রতি প্রকাশ পেয়েছে তাঁর স্নেহ, মুগ্ধতা। এই চিঠি পড়লে নিঃসন্দেহ অনুমান করা যায়, এর আগে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুনিশ্চিত যোগাযোগ ঘটেছিল উদয়শঙ্করের। রবীন্দ্রনাথ সেই চিঠিতে লিখেছিলেন, উদয়শঙ্কর ‘সম্পূর্ণ নিরহঙ্কার। সেটা আশ্চর্যের বিষয়। ওর মধ্যে বাইরে থেকে অহঙ্কারের ইনজেকশন চলেচে বারে বারে, খুবই তীব্র ঝাঁঝের। আর কারো হলে কনভালশনের উৎপত্তি হতো। ওর চিত্তে খুব একটা জোরালো বিনয় আছে—সেটা ওকে নিরাময় করে রেখেছে। আমার মনে হয় এইটি খাঁটি ওস্তাদের লক্ষণ।’ ঠিক এর তিনদিন পর ৬ জুলাই রবীন্দ্রনাথ দেখলেন উদয়ের নৃত্য। মানুষ উদয়কে ভালো লেগেছিল রবীন্দ্রনাথের, কিন্তু নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্করকে?

Powered by Froala Editor