আজ কোথায় যেন বেসুর বাজল সব

শঙ্কর সরণি - ২৮
আগের পর্বে
উদয়শঙ্করের দলে যোগ দিয়ে ইউরোপের নানা দেশ ঘুরলেন অমলা। দর্শকদের কাছে তখন উদয়শঙ্কর মানুষ নন। তিনি নৃত্যের ভগবান। অমলাও দলের মধ্যে নিজের দায়িত্ব গুছিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু এর মধ্যেই দেশে ফিরতে চাইলেন হেমাঙ্গিনী। সঙ্গে অমলাকেও নিয়ে আসবেন তিনি। অমলার বাবা তো তাঁর হাতেই তুলে দিয়ে গিয়েছেন মেয়েকে। দীর্ঘ প্রবাশের পর দেশের মাটির গন্ধ পেলেন দুজনেই। হেমাঙ্গিনী অমলাকে বলেছিলেন, কেন তাকে ফিরিয়ে আনা হল সেটা পরে বুঝতে পারবে। ছোট ছিলেন, তবু কথাটা বুঝেছিলেন অমলা।

ইউরোপে এমন কিছু প্রখ্যাত, অভিজাত  রঙ্গালয় ছিল, যেখানে অনুষ্ঠানের অধিকারী ছিলেন শুধুমাত্র খাস শিল্পীরা। সেই মঞ্চের দাবিদার শুধু তাঁরাই। সে সব মঞ্চে নিজের অনুষ্ঠান করতে চাওয়া অসম্ভব এক স্বপ্নের মতো ছিল হাজার-হাজার শিল্পীর কাছে। সেই সমস্ত জায়গা থেকে অনুষ্ঠানের অনুরোধ জানিয়ে উদয়শঙ্করের কাছে এল আমন্ত্রণ। বুদাপেস্টের অপেরা হাউস তেমনি এক রঙ্গালয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর একমাত্র আনা পাভলোভা পেয়েছিলেন সেই ছাড়পত্র। সেই সম্মান পেলেন উদয়শঙ্করও। অদ্ভুত কাণ্ড, কোপেনহেগেনের রয়্যাল থিয়েটার অনুমতি দেয়নি এমনকি আনা পাভলোভাকেও। ১৯৩২-এর ৩০ মে ডেনমার্ক পৌঁছন উদয়শঙ্কর। রয়্যাল থিয়েটারে দু-দিন পরপর অনুষ্ঠিত হল তাঁর দলের নৃত্যাভিনয়। শুধু অনুষ্ঠানই হল না, সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত রইলেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। ভূয়সী প্রশংসা লাভ করলেন শিল্পীরা। দীর্ঘ সময় নিয়ে করতালিতে ধন্য ধন্য করল দর্শক।

দর্শকের ধন্য ধন্য করার একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল হামবুর্গে। সেকথা জানিয়েছিলেন তিমিরবরণ। নৃত্যানুষ্ঠান শেষ হল, শিল্পীরা দাঁড়ালেন মঞ্চে। অভিবাদন শেষে ক্লান্ত তাঁরা ফিরবেন স্বক্ষেত্রে। দর্শকের উল্লাস তাঁরা টের পাচ্ছেন তাঁদের করতালিতে। আনন্দোচ্ছ্বাসে ছেয়ে আছে চারপাশ। তাঁরা কৃতজ্ঞ, আনন্দিত। গ্রহণ করছেন তাঁদের মুগ্ধতা। প্রতীক্ষা করছেন, ওই প্রবল হর্ষধ্বনি থামলে প্রস্থান করবেন তাঁরা। কিন্তু কই? দর্শক তো থামেই না। আরো কিছুক্ষণ। তারপর আরো কিছুক্ষণ। তারপর আরো। প্রায় কুড়ি মিনিট নিরবিচ্ছিন্ন করতালির পর দর্শক নিরস্ত হলেন। সমস্ত জিনিসপত্র গুছিয়ে যখন তাঁরা বেরিয়ে আসছেন রঙ্গালয় থেকে তখন গভীর রাত্রি। শুধু রাত্রি নয়, গভীর শীতের রাত্রি। বেরোনো মাত্রই অবাক বিস্ময়ে তাঁরা চেয়ে দেখলেন দর্শক তখনও অপেক্ষায় রয়েছে আরো একবার তাঁদের দেখবে বলে। শুধু সাধারণ দর্শক নয়, এমনকি গুণী, বিত্তশালী বিশিষ্টজনেরাও দাঁড়িয়ে আছেন শীতকে উপেক্ষা করে। তাঁদের দেখা মাত্রই পুনরায় ছড়িয়ে পড়ল, সেই স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দধ্বনি।    

এইরকম ঘটেছিল আরো একবার। ১৯৩২ সালের ২৪ জানুয়ারি বার্লিনে গিয়েছিল উদয়শঙ্করের দল। সকাল দশটায়, অসময়ে অনুষ্ঠান। সকলেরই একটু-একটু দ্বিধা। প্রেক্ষাগৃহে আসন হয়তো বা খালিই থাকবে। রঙ্গালয়ে পৌঁছে স্তম্ভিত শিল্পীরা, অবর্ণনীয় ভিড়ে ছয়লাপ চারপাশ। অস্বাভাবিক রকমের জনসমাগম হয়েছিল সেবার। উদয়শঙ্কর এবং তাঁর দলকে দেখতে উন্মুখ দর্শক। পরিস্থিতির দাবি রাখতে সন্ধ্যাবেলায় দিতে হয়েছিল আরো একটি শো।

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিমিরবরণ ও ভাই শিশিরশোভন।

 

আরও পড়ুন
ছোটো ছিলেন তবু কথাটা বুঝেছিলেন অমলা

অথচ তা সত্ত্বেও ঘনিয়ে এল ছায়া। এই যশ, খ্যাতি এই উত্তুঙ্গ শিখরে পৌঁছতে চাওয়ার প্রবল ইচ্ছা, ধীরে ধীরে হয়ে এল স্তিমিত। বড়ো ক্লান্ত বোধ করলেন তিমিরবরণ। নতুন দেশ, নতুন মানুষ, মানুষের উন্মাদনা সব সত্যি। সব সুন্দর। তবু কী এক বিষণ্ণতা যেন ঘিরে ধরল তাঁকে। চিরটাকাল অস্থির তিনি। আশৈশব ছুটেছেন নতুন নতুন যন্ত্রের খোঁজে। সুরের হদিশে উৎসুক থাকাই তাঁর আজন্মের ধ্যান। মুহূর্ত কি তবে স্থবির এখানে? জীবনের বাইরে দিকে অনেকখানি চাঞ্চল্য, দৌড়-ঝাঁপ। কিন্তু সুরের এষণায় যে আত্মমগ্ন থির-অস্থিরতা তার অভাববোধ করলেন তিমিরবরণ। তাঁর গুরু আমির খাঁ সাহেব, তাঁকে দিয়েছিলেন ধ্রুপদি সুরের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। আরেক ফরিশতের কাছে মাইহারে চলছিল তাঁর তালিম। আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব, স্বয়ং সুরের মহাসিন্ধু। সেই মাইহার ঘরানারও ভগীরথ তিনি।  সেইসব সংসর্গে দুরূহ, দুর্জ্ঞেয় সাধনায় অতিবাহিত হয়েছে তাঁর দিন। অতি দুর্গম অথচ অতি সূক্ষ্ম অতি কাঙ্ক্ষিত অতি দুর্লভ সেই পথ পরিহার করে কোথায় ছুটছেন তিনি? শিল্পধারার সম্মুখভাগে উড়ত তাঁর নিশান, তিনি রয়েছেন শিল্পের নেপথ্যভূমিতে। হোতা নন তিনি। তিনি রচনা করেন নৃত্যের প্রেক্ষাপট। তাঁর সৃষ্টিক্ষেত্র সীমাবদ্ধ এ পরিসরে।

আরও পড়ুন
সুরের কাছে হার মেনেছে হাজার কথার হল্লা

১৯২৮-এর গোড়ায় তিমিরবরণ তখন কলকাতায়। কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র সংগীতজ্ঞ, সাধক দিলীপকুমার রায় মঞ্চস্থ করলেন ‘মীরাবাঈ’ নাটক। সেখানে আলাপ হল দুজনের। একদিন দিলীপকুমারের গায়ক-বন্ধু অম্বিকাচরণ মজুমদার তিমিরবরণকে নিয়ে গেলেন দিলীপকুমারের গৃহে। তিনি শুনলেন তিমিরবরণের বাজনা। ‘ভারতবর্ষ’, পত্রিকায় ১৯৩১ অর্থাৎ মাঘ ১৩৩৭-এ, দিলীপকুমার লিখলেন, ‘এই অল্প বয়সে যে সরোদের মতন দুরায়ত্ত যন্ত্রকে দিয়ে সুর মীড় মুর্চ্ছনা ও ছন্দের কথা কওয়ানো যায়… প্রাণশক্তির এতখানি সাবলীল উৎসারিত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে—এ আমি তিমিরবরণের বাজনা না শুনলে কখনো কল্পনাই করতে পারতাম না’। ফিলাডেলফিয়ার প্রখ্যাত সংগীত নির্দেশক লিওপোলড স্কটকি তখন কলকাতায়। তিমিরবরণের বাজনা শুনে অভিভূত স্কটকি তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়ে গেলেন আমেরিকায়।

আরও পড়ুন
পিছনে ফিরে উদয়শঙ্কর সজোরে মারলেন এক ঘুঁষি

বাঁদিকে সরোদ হাতে তিমিরবরণ।

 

আরও পড়ুন
রবিশঙ্কর: প্যারিস তাঁকে গড়েছে, করেছে বিভ্রান্তও

দিলীপকুমার এও বলেছিলেন, এমন ‘সঙ্গীত-উদাসী দেশে, এ সাধনার দরদী মিলবে, কি না মিলবে’—সেসব না ভেবেই এই সুরপ্রেমিক ডুব দিয়েছিলেন সাধনায়।’ যে উচ্চমার্গের প্রতিভা এবং সাধনা তিমিরবরণের, তার যথাযথ স্বীকৃতি বা যথার্থ সমঝদার লাভ ঘটবে কিনা, সে বিষয়ে নিজের সংশয় প্রকাশ করেছিলেন দিলীপকুমার। নিজে সংগীতশিল্পী ছিলেন বলেই প্রতিভাকে ঘিরে এদেশের শ্রোতাদের কখনও প্রবল উচ্ছ্বাস আবার কখনও তীব্র অবহেলার বিপরীতমুখী বাস্তবদিকটিকে নিশ্চয়ই বিস্মৃত হতে পারেননি তিনি। তদুপরি, এ ঘরানার বাদ্যযন্ত্রে তখনও তো শ্রোতাও যৎসামান্য।

মাইহারে গুরু আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কাছেই পরে নাড়া বাঁধবেন স্বয়ং রবিশঙ্করও। কিন্তু মাইহার ঘরানার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় তিমিরবরণের বাজনার সূত্রেই। জানিয়েছিলেন তিনিও, ‘সে সময়ে তিমিরদার স্তরের সরোদিয়া আর কোনো বাঙালি ছিলেন না।…তিমিরদাই প্রথম মানুষ যাঁর হাতে প্রথম উচ্চস্তরের ক্লাসিকাল শুনলাম এবং খুব ভালও লাগতে লাগল।’ ভুবনমোহিনী প্রতিভা ছিল গিটারিস্ট আন্দে সেগোভিয়ার। প্যারিসের বাড়িতে তিনি তন্ময় হয়ে শুনতেন তিমিরবরণের বাজনা। উদয়শঙ্করের নৃত্যদলের অংশীদার হলেও স্বকীয় শক্তির জোরে তিনি চিহ্নিত হয়েছেন সর্বত্র। হয়েছেন সম্মানিত। তাঁর প্রকাণ্ড প্রতিভাকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখেছে পশ্চিম। গ্রহণ করেছে পরম গুণমুগ্ধতায়। কৌতুককর এ খবরটিও জানাতে ভোলেননি রবিশঙ্কর, যে, ইউরোপ আমেরিকাতে উদয়শঙ্করের পরেই শ্বেতাঙ্গিনী মহলে যদি কারোর ডিমান্ড থাকে, তা তিমিরবরণের।

তা সত্ত্বেও, সংগীতের ক্ষেত্রভূমিতে এই রাজকীয় আবির্ভাবেও অতৃপ্ত রইলেন তিমিরবরণ। বিস্ময়কর প্রতিভার সঙ্গেই তিমিরবরণের মধ্যে ছিল দুর্নিবার এক শৈল্পিক অস্থিরতা এবং এক তীব্র ঔদাসীন্যও। নিজের সুরসাধনার সঙ্গে নিজের ঔৎসুক্যকে যতটা জুড়ে দেখেছেন তিনি, বোধকরি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি আমল পায়নি ততখানি। জরুরি আরো একটা বিষয় হয়তো ভাবিয়ে থাকতে পারে তিমিরবরণকে। শিল্পগত এক দ্বৈরথ হয়তো তাঁর ভেতর কাজ করত উদয়শঙ্করের দলে। তিমিরবরণকে দলে পাবার পর উদয়শঙ্কর বিদেশীয় যন্ত্র আর সুরকে পরিহার করেন সর্বৈবভাবে। বিশুদ্ধ ভারতীয় সুরের আধারেই তিনি গড়ে তোলেন তাঁর নৃত্যলোক। অন্যদিকে  ধ্রুপদি কলাকার হওয়া সত্ত্বেও, সুরের বিচিত্রতার খোঁজে তিমিরবরণের কাছে কখনও গুরুত্ব পায়নি মানচিত্রের সরহদ্দ। দেশি-বিদেশি সমস্ত সুরই তাঁকে আকৃষ্ট করেছে সমানভাবে। ভারতীয় অর্কেস্ট্রার জনক পাশ্চাত্যে তখন পরিচিত হচ্ছেন আরো আরো সুর, সুরকার আর যন্ত্রের সঙ্গে। সে দেশের অর্কেস্ট্রার চল প্রচুর। সেখানে অর্কেস্ট্রায় একসঙ্গে যুক্ত হন শয়ে-শয়ে মানুষ। খুব স্বাভাবিকভাবেই সেইসব যন্ত্র আর সুরের নিরীক্ষার আকাঙ্ক্ষাও যদি বিচলিত করে থাকে তাঁকে, তবে সেকথাই বা অগ্রাহ্য করা যায় কী করে?

উদয়শঙ্করের নাচের অনুষ্ঠানে মাঝখানে সরোদ হাতে তিমিরবরণ।

 

সদ্য বিবাহ সেরে সুরসৃষ্টির অনিবার আকর্ষণে তিনি ছুটে এসেছিলেন উদয়শঙ্করের সঙ্গে। সম্মতি ছিল স্ত্রীর। স্বামীর ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন মণিকা। আমেরিকা সফরের পর দেশে ফিরে আসতে চাইলেন তিমিরবরণ। সেই সময়ই চিঠি এসে পৌঁছল দাদা মিহিরকরণের। নিউ থিয়েটার্স অত্যন্ত সম্মাননীয় এক পদে আহ্বান জানাতে চায়  তিমিরবরণকে।

উদয়শঙ্করের দল তৈরি হয়েছে বহু মানুষকে নিয়ে। নানান পরিস্থিতি থেকে এসে যুক্ত হয়েছেন তাঁরা। সেইসূত্রেই দলের অন্দরে অতি ধীর পদার্পণে জমছে নানা জনের নানারকম অনুযোগ। আমেরিকা যাত্রা সেই ক্ষতে জোগাল ইন্ধন। নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থাপনা ছিল সলোমন হ্যুরকের। নিখুঁত কিন্তু অনান্তরিক সেই বন্দোবস্তে আহত বোধ করলেন কেউ কেউ। এতদিন দল ছুটেছে স্বমহিমায়। নাচ-গান-আমোদ-আয়েস সমস্তকিছু ঘটেছে একত্র। এমনকি স্থানে-কালে উৎপাত-উপদ্রবের প্রতিরোধে প্রতিবাদ-প্রহারেও সঙ্ঘবদ্ধ ছিলেন সকলে। আজ কোথায় যেন বেসুর বাজল সব। আমেরিকায় উদয়শঙ্করের জন্য ব্যবস্থা করা হল অভিজাত, বৃহৎ হোটেল। বাকিরা রইলেন অন্যত্র। তুলনামূলক সাধারণ বন্দোবস্তে। ব্যবস্থাপনার মান নিয়ে ভাবিত ছিলেন না কেউ, কিন্ত এই বিভাজন ব্যথিত করল বাকিদের। বিষয়টি যে অনাপত্তির আওতায় রইল, অনেকে দুঃখবোধ করলেন সেইখানটিতেই।

তবে খোদ শিল্পী হাঁটেন এসব এড়িয়ে-পেরিয়ে। উদয়শঙ্কর সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে তিমিরবরণ বলেছিলেন, উদয়শঙ্করের জন্য অর্কেস্ট্রা তৈরি করে আমি যেমন তাঁর সৃষ্টিকে পূর্ণতা দিয়েছিলাম, তাঁর সঙ্গে থেকে আমিও তেমনই সংগ্রহ করেছিলাম আমার পরবর্তী জীবনে সাফল্যের সমস্ত রসদ। তবু দল যে তাঁকে গভীর সৃষ্টির উল্লাস থেকে বিরত রেখেছে, আড়ালে রইল না সেই কথাখানাও। তিমিরবরণ জানিয়ে দিলেন উদয়শঙ্করকে, আমেরিকা সফরের চুক্তির পর তিনি ত্যাগ করতে চান দল।

Powered by Froala Editor