ধর্মশালা, ধরমশালা, কিছু কথা

মুছে যায়? — ৪২

আগের পর্বে

সত্তর ও আশির দশকে না ভাঙা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন কমলাপতি ত্রিপাঠী। ছিলেন কংগ্রেসের অবিসংবাদিত নেতা। কমলাপতির পুত্রবধূ ‘বহুরানি’ নির্বাচনে দাঁড়ান চন্দৌলি থেকে। সেই নির্বাচনী ক্ষেত্র কভার করতে গিয়ে চন্দৌলি কিংবা অন্য কোনো স্টেশনের পাশে একটি সরাইখানায় থাকা। বালিয়াতে দাঁড়িয়েছিলেন চন্দ্রশেখর। মাত্র কয়েকদিনের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধীর ‘ব্লু আইড বয়’। ভোড়সিতে ‘আশ্রম’ তৈরি করেছিলেন চন্দ্রশেখর। তারপর…

১৯৮৪ সালের ৩০ অক্টোবর নিজেরই শিখ দেহরক্ষীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলেন সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। তারপরই তো সাধারণ নির্বাচন। ইন্দিরা গান্ধী— জীবিত ইন্দিরা গান্ধীর থেকেও শক্তিশালী হয়ে উঠল তাঁর গুলিবিদ্ধ, মৃত শরীরের ছবি। তা জাতীয় কংগ্রেসকে সেই সাধারণ নির্বাচনে বিপুল সাফল্য এনে দিল। যাক সে সব কথা। নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন রাজীব গান্ধী। ইনি ফিরোজ গান্ধী ও ‘প্রিয়দর্শিনী’ ইন্দিরা গান্ধীর কনিষ্ঠ সন্তান। পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরুর প্রয়াণের পর খবরের কাগজে কাগজে পিতৃশোকাক্রান্ত ইন্দিরা গান্ধীর বিষণ্ণ ছবির সঙ্গে তাঁর দুই পুত্র সতানের তসবিরও ছাপা হত। সঞ্জয় ও রাজীব তখনও নেহাৎই বালক। সেই ছবির ক্যাপশনে অবশ্য সঞ্জয় আর রাজীব নয়, ছাপা হত সঞ্জীব আর রাজীব। দুই বালকের শকল-সুরত-চেহারা ইত্যাদি খুবই সুন্দর। এক ধরনের সারল্য— ইনোসেন্ট ইনোসেন্ট ব্যাপার তাঁদের দুই ভাইয়ের মুখে। সঞ্জীব কীভাবে সঞ্জয় হয়ে উঠলেন, সে এক অতি দীর্ঘ কথাপথ।

ফিরোজ গান্ধী ছিলেন অগ্নি-উপাসক। মহাত্মা জরাথুস্ট্র প্রবর্তিত পার্শি ধর্মের উপাসক ছিলেন তিনি। নেহরু-গান্ধী বিরোধীরা অনেকেই অপপ্রচার করতেন, এখনও করেন ফিরোজ গান্ধী ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এই তথ্য ভুল। অভিসন্ধিমূলক।

ফিরোজ ছিলেন সুবক্তা, খুব বড়ো মাপের সাংসদ। পার্লামেন্টের ভেতরে তাঁর কাটা কাটা ভাষণ— যা মূলত পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও তাঁর দল জাতীয় কংগ্রেসকে বিঁধেই বলা হত। 

শ্বশুরমশাই পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে তিনি অক্লেশে সম্বোধন করতেন ‘মাস্টার নেহরু’ বলে। আর সংসদ ভবনে নেহরুজির সামনাসামনি— মুখোমুখি হলেই ফস করে সিগারেট ধরাতেন ফিরোজ। ইন্দিরা গান্ধী থাকতেন দুই সন্তানসহ তাঁর পিতা ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর কাছে। ইন্দিরার দুই পিসি— বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত ও কৃষ্ণা হাতিসিং। বিজয়লক্ষ্মী সক্রিয় ছিলেন ভারতীয় রাজনীতিতে। পরে অখণ্ড সোভিয়েত ইউনিয়নে ভারতের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। অতি সুদর্শনা বিজয়লক্ষ্মীর সঙ্গে ইন্দিরার সম্পর্ক ছিল খুব খারাপ। ক্রমশ সেই সম্পর্ক খারাপ হওয়ার ফাটল আরও আরও তীব্র হয়। ভারতীয় রাজনীতিতে তার ছায়াপাত ঘটেছে বেশ কয়েকবার। পণ্ডিত নেহরু খুব ঘন ঘন সিগারেট খেতেন। প্রায় কেশশূন্য ন্যাড়া মাথায় শীর্ষাসন করতেন। সেই ছবি বার বার প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে।

আরও পড়ুন
কমলাপতি, চন্দ্রশেখর, বহুরানি

পণ্ডিতজির প্রেমিকার সংখ্যাও লোকমুখে অনেক, সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। নেহরুকে নিয়ে ডঃ মাথাইয়ের বইতে এর উল্লেখ আছে। লেডি মাউন্টব্যাটেন— এডুইনা ছাড়াও, পদ্মজা নাইডু, শ্রদ্ধামাতা এমন অনেককে নিয়ে নানা পল্লবিত কাহিনি। ডকটর মাথাই তো তাঁর কেতাবে লিখেছেন শ্রদ্ধামাতার ছবি থাকত নেহরুর শোয়ার ঘরে। গোপালের বইটি পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে অনেক অনেক দিক থেকে ধরা গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। পণ্ডিতজির প্রয়াণের পর তাঁর ছোট সহোদরটি— কৃষ্ণা হাতিসিংয়ের নাম আমরা অনেকেই জানতে পারি সংবাদ মাধ্যম মারফত। তখন তো মূল সংবাদ সূত্র বেতার— আকাশবাণী আর খবরের কাগজ। জওহরলাল নেহরুর প্রয়াণের পর বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক— পঞ্চাশ দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক ‘নেই’ নামে একটি গল্প লিখেছিলেন পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে নিয়ে।

আরও পড়ুন
গরুর গলায় তেত্রিশ কোটি দেবতা

কথা হচ্ছিল নেহরু জামাতা পার্শি ফিরোজ গান্ধীকে নিয়ে। তিনি নির্দল হিসাবে এম পি নির্বাচিত হতেন। ফিরোজ গান্ধী বহুদিনই বিস্মৃতির আড়ালে। আগেই বলেছি, তিনি তাঁর শ্বশুরজি পণ্ডিত নেহরুজিকে ‘মিস্টার নেহরু’ বলে সম্বোধন করতেন। এই তথ্য আমায় দিয়েছেন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা ও ‘সংবাদ প্রতিদিন’ সম্পাদক, তারও আগে ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়ার’ হয়ে নিয়মিত পার্লামেন্ট বিট করে বিশিষ্ট সাংবাদিক শঙ্কর ঘোষ। শঙ্করদা চমৎকার মানুষ ছিলেন। এছাড়াও নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ‘মেজদাদা’ শরৎচন্দ্র বসুর জন্ম শতবর্ষে হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের একটি অসামান্য বক্তব্য শুনেছিলাম শরৎচন্দ্র বসুকে নিয়ে, ধর্মতলায় কলকাতা পুরসভার ভেতরে অডিটোরিয়ামে। প্রায় দেড় ঘণ্টা বললেন তিনি। বসেই বললেন। কানে হিয়ারিং এড, তখনই তাঁর শ্রবণ ব্যবস্থায় কিছু অসুবিধে। হীরেনবাবুর পরনে র সিল্কের অফ হোয়াইট হাঁফ হাতা বুশ শার্ট আর ঢোলা-পায়া পায়জামা। কী চমৎকার যে বললেন! সেখানে সুভাষের ‘মেজদাদা’ কৃতবিদ্য জননায়ক শরৎচন্দ্র বসু সম্বন্ধে বলতে বলতে তিনি পেশ করলেন একটি বাক্য, দুটি বাক্য। এখন কী সব ‘অমুকজি, তমুকজি’ বলার রেওয়াজ সংসদে, সাংবাদিকতায়। আমরা কিন্তু পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে ‘মিস্টার নেহরু’ বলে সম্বোধন করতাম।

আরও পড়ুন
কমনের যে ইষ্ট করে ও অন্যান্য

পণ্ডিত নেহরুর শেরোয়ানির বাটন হোলে লাল গোলাপ— এই স্টাইল স্টেটমেন্ট খুব পছন্দ করতেন হীরেন্দ্রনাথ মুখার্জি আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সুভাষদার কবিতায় পণ্ডিত নেহরুর লাল গোলাপের উল্লেখ আছে।

আরও পড়ুন
ভোট, চোট, ফোট

‘তরী হতে তীর’-সহ আরও বহু গ্রন্থের লেখক হীরেন্দ্রনাথ ‘জেন্টল কলোশাস’ নামে চিহ্নিত করেছেন জওহরলাল নেহরুকে। এই নামে হীরেনবাবুর অতি বিখ্যাত গ্রন্থও আছে। এই তথ্য প্রায় সকলেরই জানা। ‘তরী হতে তীর’— এর প্রকাশক ছিল ‘মনীষা গ্রন্থালয়’। 

হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় শরৎচন্দ্র বসুর শতবর্ষ সংক্রান্ত বক্তৃতা পেশ করছিলেন দুপুরবেলা। তখন এ রাজ্যে বামফ্রন্ট শাসন। কেন্দ্রে জাতীয় কংগ্রেস সরকার। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা তনয় রাজীব গান্ধী। রাজীব গান্ধীর তখন অরুণ নেহরু, আরিফ মহম্মদ খান, স্যাম পিত্রোদা, জগদীশ টাইটলার এঁদের নিয়ে তৈরি করেছেন একটি নিজস্ব রাজনৈতিক ক্ষমতাচক্র। সেখানে সোনিয়া গান্ধীও ছিলেন। স্যাম পিত্রোদা ছিলেন আমাদের দেশে আধুনিক টেলি সংযোগ ব্যবস্থার অন্যতম নির্মাণ-পুরুষ।

হীরেনবাবুর সেদিনের বক্তব্যে ‘অমুকজি, তমুকজি’ রাজীব গান্ধীকে উদ্দেশ্য করেই বলা। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, কীভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামী ও অত্যন্ত বড়ো ব্যারিস্টার শরৎ বোস— শরৎচন্দ্র বসু তাঁর অতিদামি চামড়ার ব্যারিস্টারি ব্রিফকেসে ডিনামাইট ভর্তি করে নিয়ে চট্টগ্রাম গেছিলেন, জেলের পাঁচিল উড়িয়ে— ভেঙে দিয়ে সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার (ফুটু) সহ ১৯৩০-এর ১৮ এপ্রিলের চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহীদের মুক্ত করে আনতে। শরৎচন্দ্র বসুর হাত মারফত এক ব্রিফকেস ভর্তি ডিনামাইট পৌঁছল জেলের বাইরে থাকা চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহীদের— হিন্দুস্থান রিপাব্লিকান আর্মির কর্মী ও সদস্যদের কাছে। কিন্তু সেই ব্লাস্ট, বিস্ফোরণ করানো গেল না। লম্বা তার, সুইচ, ডিনামাইট স্টিক— সব জোগাড় হল, ফিটিংও হল কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। সব ধরা পড়ে গেল। সব।

শরৎচন্দ্র বসু স্বাধীন ‘আনডিভাইডেড বেঙ্গল বা জয়েন্ট বেঙ্গলের প্রবক্তা ছিলেন, ‘শের-ই-বঙ্গাল’ ফজলুল হকের সঙ্গে। তাঁর এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক— তকরার আছে আজও। পক্ষে, বিপক্ষে— দু ধরনের মতই।

চন্দৌলি বা চান্দৌলি থেকে কাশী-বারানসী বা বেনারস যাব, ভোট কভার করতে। তখন চান্দৌলির মাঠ ভরা— ক্ষেতজমি ভর্তি আখ— গন্না, গন্নেকা রস, গন্না থেকে তৈরি গুড়, শক্কর, চিনি। আমার এই নির্বাচনী যাত্রা— আরও সঠিকভাবে বললে নির্বাচনী— চুনাওয়ি সমাচার— ভোটের খবর যোগাড়ের অভিযান চান্দৌলি বা চন্দৌলি থেকে আবার গঙ্গা— উত্তরবাহিনী গঙ্গা কেন্দ্রিক কাশীর দিকে।

আজ থেকে সাঁইত্রিশ বছর আগে কাশীর গোধূলিয়া আর একটু অন্যরকম। সেখানে মনমোহন পাঁড়ে বা মনমোহন পাণ্ডের নামে তৈরি হওয়া ধর্মশালায় আমিষ খাওয়া যায়। নিজেরা রান্না করে বা বাইরে থেকে রান্নার ডিম-মাছ-মাংস কিনে এনে। তবে ঘরে রান্না করা যাবে না। রাঁধতে হবে কমন রান্নাঘরে, উনোনে, কাঠের আগুনে। সে বড় তকলিফির ব্যাপার।

মনমোহন পাঁড়ের নামে ছিল উত্তর কলকাতার মনমোহন থিয়েটার। সেই ঐতিহাসিক নাট্যশালা রাস্তা চওড়া করার নামে বা কারণে ভেঙে ফেলা হয়। প্রখ্যাত নট-নটীদের স্মৃতিধন্য, সেই থিয়াটার হল।

আমরা সাধারণত বেনারস গেলে দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছাকাছি হরসুন্দরী ধর্মশালায় উঠতাম। তিন রাতের তীর্থবাস। তার বেশি থাকা যাবে না ষাটের দশকে। হরসুন্দরী ধর্মশালার ম্যানেজারমশাই একমাথা কাশফুল, একই রঙের মোটা গোঁফ নিয়ে উপস্থিত। ঘোর কৃষ্ণবর্ণ তিনি। গরমে প্রায় সময়েই নগ্নগাত্র। শীটে মোটা সুতির চাদর। তিনি খুব গম্ভীর, একটু খ্যাটখ্যাটেও। অতি বিখ্যাত হোমিওপ্যাথি ওষুধ বিক্রেতা ও প্রস্তুতকারক মহেশ ভট্টাচার্যদের ধর্মশালা হরসুন্দরী। একতলায় সার সার পায়খানা। রাত দশটার পর সব আলো নিভে যায়। দোতলার ধর্মশালা ঘর থেকে নামতে গেলে প্রায় অন্ধকার সিঁড়ি। দু-এক পিস যা বাল্ব আছে এদিক ওদিক, ধর্মশালার মধ্যে, তাদের দেওয়া আলো অনেকটা যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নাৎসি বন্দি শিবিরের থেকেও কম। ক্ষমা করবেন, আমি কোনোভাবেই দানবীর মহেশ ভট্টাচার্য আর তাঁদের প্রতিষ্ঠান হরসুন্দরী ধর্মশালাকে ছোট করছি না। একেবারে অতি অল্প মূল্যে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের থাকার ব্যবস্থা করা। ইলেকট্রিক বিল, ট্যাক্স, সাফাইকর্মীদের মাস মাইনে, রজক খরচা— বালিশের ওয়াড়, চাদর ইত্যাদি কাচানোর ব্যয়। অত বড়ো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের বেতন। অনেক ধরনের ব্যয়।

কাশী বা বারানসীতে বহুবার যাওয়ার সূত্রে গোধূলিয়া, রামাপুরা, দশাশ্বমেধ ঘাট, বাঙালি টোলা, হাতি ফটকা, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় সবই বড্ড চেনা। বিশ্বনাথ গলি, বিশ্বনাথ মন্দিরও। কাশীতে উত্তরবাহিনী গঙ্গার ঘাট বলতে দশাশ্বমেধ ঘাট, দশাশ্বমেধে দাঁড়িয়ে উত্তরবাহিনী গঙ্গার দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডান দিকে শীতলা ঘাট, একেবারে গা লাগোয়া দশাশ্বমেধের। তারপর খানিকটা গেলেই কেদার ঘাট, যার পাথুরে সিঁড়ি অনেক, অনেক খাড়াই। বাঁদিকে রাজ ঘাট, অহল্যা বাঈ ঘাট, রানা চেত সিং ঘাট, দিঘাপতিয়া ঘাট, মনিকর্নিকা ঘাট— যে মহাশ্মশানে দিবারাত্র কাঠের চিতা জ্বলে। প্রচুর ধূম। মহামাংস দাহের কুবাস, হরিশ্চন্দ্র ঘাট, এটিও শ্মশানস্থল— দাহভূমি, অসসি ঘাট, মনে রাখতে হবে অতি প্রাচীন নদী অসসি ও বরুণা মিলে— তাদের সঙ্গমস্থলে বারানসী। অসসি, বরুণা— দুটি ধারারই দেখা পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

এছাড়াও আছে গাইঘাট। এরকম ঘাট অনেক, অনেক। এক সময় ঘাট থেকে ঘাটে ঘুরে, পা দিয়ে দিয়ে পুরো বারানসী পরিভ্রমণ করা যেত, বিশেষ করে শীত ও গ্রীষ্মে। বসন্তেও। বর্ষায় সম্ভব হত না এই ঘাট ধরে ধরে নগর প্রদক্ষিণ।

ষাট সত্তর দশকে কাশীতে অটোরিকশা নেই। আছে অনেক অনেক সাইকেল রিকশা, অনেক অনেক ইক্কা— এক্কা, তাঙ্গা বা টাঙা, দুটোই ঘোড়ায় টানে। দশাশ্বমেধের কাছাকাছি তাঙ্গা বা টাঙ্গার আড্ডা। সেখানে অনেক, অনেক ঘোড়ার গাড়ি, সবুজ, আধশুকনো ঘাস— চারা— খোল, ভুষি, ভেজান ছোলার এক ভারি হয়ে থাকা দুর্গন্ধ। সেই সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর ঘোড়ার গু। টাঙ্গা, ইক্কা টানতে টানতেই তাঁরা নাদেন— পেট পরিষ্কার করেন। অশ্ব বিষ্ঠা ক্ষতস্থানে লাগলে নাকি ধনুষ্টঙ্কার অবধারিত। ধনুষ্টঙ্কার হলে নাকি ধনুক হয়ে বেঁকে যায় শরীর। হাত, মুখ বেঁকে যায়। ষাটের দশকে ঘোটক বিষ্ঠা ভালো করে শুকিয়ে গুঁড়ো করে মেশানো হত সাদা জিরে গুঁড়োয়, যেমন গব্য ঘৃত— গাওয়া ঘিয়ে সাপের চর্বি, গোলমরিচে পাকা পেঁপের বীজ শুকনো করে, গমে, চালে ভাঙা কাঁচ, পাথর, কাঁকর। রেশনের চালের নামই তো ছিল কাঁকরমণি। তখন সর্ষের তেল শেয়ালকাঁটার তেল, যে থেকে বেরিবেরি অবধারিত। বেরিবেরি হলে ফুলে যায় হাত পা মুখ। ময়দায় মেশানো হত সাদা পাথরের গুঁড়ো। কত যে ভেজাল তখন, এখনও তা রয়েছে অবশ্যই। অন্যভাবে। আরও সূক্ষ্মতর পদ্ধতিতে।

শুধু কাশী কেন, সমস্ত ধর্মশালাতেই প্রায় রাত দশটার মধ্যে আলোর মেন সুইচ অফ করা থাকে। সাধারণের দানে চলে এইসব প্রতিষ্ঠান। মানে চলত তখনও। ফলে কাশীর হরসুন্দরী ধর্মশালা, মনমোহন পাঁড়ের ধর্মশালা, ভারত সেবাশ্রম সংঘ, রামকৃষ্ণ মিশন— সর্বত্র আলোর অবস্থা এক। পুরীর ভারত সেবাশ্রম সংঘ, ছাতামঠ— সর্বত্র এক ছবি। সেটা ষাট আর সত্তরের দশক।

ষাটের দশকে দেখেছি দিল্লির জৈন ধর্মশালা, গুরুদ্বার সংলগ্ন ধর্মশালায় একটু উজ্জ্বলতর আলো। নতুন দিল্লির কালীবাড়িতেও। হরিদ্বার বা হরদোয়ারের ভোলাগিরি আশ্রম, মেহেরচাঁদ খান্না— একদা জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রীসভায় উদ্বাস্তু ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন তিনি কেন্দ্রে। পণ্ডিত জবাহরলাল নেহরু সেই মন্ত্রীসভার প্রধান— প্রধানমন্ত্রী। তো সেই তাঁর নামেই— মানে মেহেরচাঁদ খান্নার নামেই হয়তো মেহেরচন্দ ধরমশালা। হর কে পৌড়ি— বাঙালিরা অনেক সময় যাকে হরকে পেয়ারির ঘাট বলেন, সেই হর কে পৌড়ির খুব কাছাকাছি ভোলাগিরির আশ্রম। একজন কাঁচাপাকা চুলদাড়ির মানুষ সেই ধর্মশালাটির প্রধান। বড় মাথা। দূর থেকে দেখলে অনেকটা যেন কার্ল মার্ক্সের আদল আসে। অতি সামান্য অর্থ দিয়ে সেখানে তীর্থযাত্রী হিন্দুদের তে-রাত্রির থাকার ব্যবস্থা। সেই ভদ্রলোক ধুতি, ছিটের শার্ট। দশনামী সন্ন্যাসী— আদি শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠিত দশনামী সন্ন্যাসীদের মধ্যে গিরি, পুরী, ভারতী, সরস্বতী এরকম উপাধিধারীরা আছেন। শ্রীচৈতন্য কেশবভারতী ও ঈশ্বরপুরী— দুজনের কাছেই দীক্ষা নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী বা বিবেকানন্দ শরীরে থাকাকালীনই দশনামী সন্ন্যাসী পথের পথিক। আগামী রোববার রোববারান্দায় কিছু ধর্মশালা, কিছু সন্ন্যাসী আর আমার চন্দৌলি বা চান্দৌলি থেকে ভোট কভার করতে বাসে বেনারস চলে আসা।

Powered by Froala Editor