২২ দিন ডিঙিতে 'সমুদ্রবন্দি' কিশোরী

প্রতিদিনের মতো সেদিনও আটল্যান্টিক মহাসাগরের উপর নজরদারি চালাচ্ছিল একটি স্প্যানিশ হেলিকপ্টার। হঠাৎ সেখান থেকে কয়েকজন দেখতে পান, সমুদ্রের বুকে ইতস্তত ভেসে বেড়াচ্ছে একটি ছোট্ট মোটর বোট। বাইনোকুলারের সাহায্যে যতদূর দৃষ্টি যায়, তার একেবারে শেষ প্রান্তে দেখা গিয়েছিল নৌকাটিকে। তবে সেটি যে যথেষ্ট বিপদের মধ্যে আছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয়নি উদ্ধারকারী বাহিনীর সেনানীদের। তৎক্ষণাৎ সেখানে পৌঁছে দেখলেন নৌকোর মধ্যে অসংখ্য মৃতদেহ। তার মধ্যেই কোনোরকমে প্রাণটুকু নিয়ে বেঁচে আছেন তিনজন। তাঁদের মধ্যেই আছে ১৭ বছরের এক আফ্রিকান কিশোরী।

আফ্রিকার রাজনৈতিক জটিলতার মধ্যে বেঁচে থাকার শেষ ভরসাটুকু হারিয়ে ফেলে অনেকেই দুস্তর সমুদ্র পেরিয়ে ইউরোপ পৌঁছে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবশ্য সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কয়েক সপ্তাহ আগে তেমনই আইভরি কোস্ট থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন ৫৯ জন মানুষ। সম্বল বলতে ছোট্ট একটি মোটর বোট আর সামান্য খাবারদাবার। সেই দলের মধ্যেই ছিল ১৭ বছরের আইচা। কিন্তু ইউরোপ কতদূর, তার কোনো স্পষ্ট ধারণা ছিল না কারোর কাছেই। দুদিন যেতে না যেতেই সমস্ত খাবার ও পানীয় জল শেষ হয়ে গেল। আরও পাঁচদিনের মাথায় শেষ নৌকোর পেট্রোলও। তখন মাঝ সমুদ্রে শুধুই সমুদ্রের ভরসায় ভেসে চলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। ঠিক কতদিন এভাবে ভাসতে হয়েছিল, মনে করতে পারে না আইচা। দেখতে দেখতে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় এক একজন প্রাণ হারাতে থাকেন। তখন তাঁদের সমুদ্রের জলেই ফেলে দেওয়া হয়। শেষে এমন অবস্থা হল, জীবিত মানুষদের শরীরেও আর মৃতদেহ তুলে সমুদ্রে ফেলার মতো ক্ষমতা নেই। নৌকোর মধ্যেই জমতে থাকল মৃতদেহের স্তূপ।

যতক্ষণ জ্ঞান থাকত, ততক্ষণ প্রাণপণে অপেক্ষা চলত যদি কোনো জাহাজ বা বাণিজ্যিক নৌকোর দেখা মেলে। কিন্তু বাণিজ্যপথ থেকে ততক্ষণে বহু দূরে এসে পড়েছে নৌকো। এরকম পরিস্থিতিতে যখন বাঁচার আর কোনো আশাই ছিল না, তখনই, ২৬ এপ্রিল, দেবদূতের মতো হাজির হলেন স্প্যানিশ বাহিনীর সামরিক আধিকারিক কার্লস সেরানো ও তাঁর দল। জীবিত তিনজনকে হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে আসা হল স্পেনে। তবে চিকিৎসার পরেও দুজনকে বাঁচানো গেল না। ১০ দিন চিকিৎসার পর কেবলমাত্র আইচা সুস্থ হয়ে উঠল। অচেনা, অজানা দেশে একা এক ১৭ বছরের কিশোরী। এই অবস্থায় আবারও এগিয়ে এলেন সেরানো। আইচাকে নিয়ে পৌঁছে গেলেন নিজের বাড়িতে। সেখানেই তার থাকার ব্যবস্থা হল। নিজের দুই সন্তানের মতোই আইচাকে গ্রহণ করলেন কার্লসের স্ত্রী। সেখান থেকেই ভিডিও কলের মাধ্যমে আইভরি কোস্টে নিজের আত্মীয়দের সঙ্গে কথাও বলেছে আইচা। স্প্যানিশ বাহিনীর মতে, ক্যানারি দ্বীপের কাছে ঘটা সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এটিই। একসঙ্গে এতজন মানুষের মৃত্যু সত্যিই অভূতপূর্ব। আর এই মর্মান্তিকতার মধ্যেই নতুন করে মানবিকতার নজির তৈরি করল সেরানো পরিবার। আইচাও খুশি এই নতুন পরিবারে। এখন আর নিজের দেশে ফিরে যেতে চায় না কোনোভাবেই।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষাক্ত জল ফেলা হবে সমুদ্রে, বিতর্কিত সিদ্ধান্ত জাপানে