শেষ না হওয়া ছোটোগল্পের ব্যঞ্জনা মেনে নিতে বাঙালির একটা বিশেষ অস্বস্তি আছে। দক্ষিণারঞ্জনের ঠাকুরমার ঝুলির মতো ফিল গুড ক্লাইম্যাক্সে সে স্বচ্ছন্দ। তাঁর আশেপাশে কতগুলো গোল জীবন, চৌকো জীবনের চিত্রনাট্য সে দেখে আসছে একটা দীর্ঘ সময় ধরে। মূলধারার বাংলা সিনেমাই হোক, একুশ শতকে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠা মেগাসিরিয়াল কিংবা অধুনা ওয়েব সিরিজ - বাঙালি পঞ্চাশ ওভারের জেতা-হারার স্থির গন্তব্যকে যতটা আপন করেছে, টেস্ট ক্রিকেটের দীর্ঘ অনিশ্চয়তাকে পারেনি। সে তার রোম্যান্টিসিজমের কাছে বশ হলেও সেভাবে মাদুলির মতো শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষার সঙ্গী করতে পারেনি আজও। যদিও সেই অনিশ্চয়তাকে আবার ক্রিকেটীয় সাহিত্যের মার্গে উন্নীত করার মুন্সিয়ানায় সে সফল। এ তাঁর নিজস্ব ক্যারিশমা। তবে বাঙালি যে অবহেলিত এবং অবদমিত অবস্থা থেকে উত্থানের রূপকথাকেই রিল কিংবা রিয়েল লাইফের ব্লকবাস্টার হিসেবে গণ্য করে, এ-বিষয়ে প্রশ্ন থাকার কথা নয়।
ক্রিকেট একটা পিচ তৈরি করে দিয়েছিল মাত্র। এখানে আপাতত স্বমহিমায় খেলে চলেছেন ঋদ্ধিমান, যাঁর নামের আগে যদি বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উইকেটরক্ষক নামক শব্দবন্ধটি বসাই আশা করি ক্রিকেটবিশেষজ্ঞেরা খুব একটা দ্বিমত পোষণ করবেন না।
প্রবীর সেন, প্রথম বাঙালি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হিসেবে যখন জাতীয় দলে ঢোকার জন্য আপ্রাণ লড়ছেন তখন জাতীয় দলে ঢোকার লড়াইতে জোরদার প্রতিদ্বন্দ্বী মাধব মন্ত্রী ও নানা যোশী। কখনো ইব্রাহিম মাকা ও বিজয় রাজিন্দর। তবে এসবের থেকেও বড়ো ব্যঞ্জনাটা এসে গেল যখন অস্ট্রেলিয়া সফরে জেনি ইরানি থাকায় সেভাবে সুযোগ না পেলেও তৃতীয় টেস্টে টেস্ট ক্যাপ এলো প্রবীরের মাথায়। তার আগে অবশ্য ভিনু মাঁকড়ের বলে ডন ব্র্যা।ডম্যানকে স্টাম্প করে একেবারে হই হই ফেলে দিয়েছিলেন প্রবীর। তবে ১৪টি টেস্টের চেয়ে দীর্ঘ হয়নি প্রবীরের কেরিয়ার। পঞ্চাশের দশকে কিপিং টেকনিকে দুরন্ত হয়েও ব্যাটে সেভাবে সফল হননি প্রবীর, কোনোদিনই। রান সংখ্যা মাত্র ১৬৫। তবে ভারতীয় জলহাওয়ায় কিছুটা ব্যাটসম্যান-কিপারের যে ঝোঁক তা স্পষ্ট হয়েছিল হয়তো সে সময় থেকেই। এরপর ষাটের দশকে ফারুখ ইঞ্জিনিয়ার, সত্তরের মাঝামাঝি সৈয়দ কিরমানি আর আশির দশকে কিরণ মোরের আগমনের পর মোটামুটি বিষয়টা ফল্গুধারার মতো মিশে গেল ভারতীয় ক্রিকেটের মূলস্রোতে। তবে এই লাফিয়ে পেরিয়ে আসা দশকগুলোর মধ্যে কিপিং বা ব্যাটিং-এর ইতিহাস বিবর্তন বাদ দিলেও বাঙালি বঞ্চনার কিছু টুকরোকথা বাঙালিকে আজও পীড়িত করে। সে গোপাল বসুর টেস্ট ক্যাপ না পাওয়াই হোক, শুঁটে ব্যানার্জির একটি টেস্ট খেলার পর টেস্ট স্থগিত হওয়াই হোক। নব্বই-এর দশকে সৌরভের উত্থান বাঙালিকে যেন একটা আইডিয়াল টেমপ্লেট দিয়ে গেল। যেন কানে কানে কেউ বলে গেল- "এই যে, এই যে লোকটা লর্ডসে জামা ওড়াল, এই টাই হল দীর্ঘদিন প্রবঞ্চিত মানুষের গণ অভ্যুত্থান!"- ব্যাস! মনোজ তিওয়ারি ইস্যু থেকে কলকাতায় বাঙালি খেলোয়াড়ের না থাকা - বঙ্গ মিডিয়া যেন এতদিনের বাঙালির যে না-পাওয়া তা চলে এলো লাইমলাইটে।
কিন্তু যে প্রসঙ্গে এই এত দীর্ঘ ভূমিকা, সেই ঋদ্ধিমান কি আদৌ এই বাঙালি ও বাঙালি-বঞ্চনার দড়ি টানাটানিতে কোথাও আছেন? নাকি নরম মাটিতে লড়াই নয় বলে একটা ছোটোগল্পকে খুব দ্রুতই ক্লাইম্যাক্সে নিয়ে গেল বাঙালি? কলকাতার ক্রিকেটমহলে দক্ষিণবঙ্গের খেলোয়াড়দের ভিড়ে ঋদ্ধিমান এসেছিলেন সেই হেমন্তের অরণ্যে পোস্টম্যানের মতো। একা। হলদে পাতার মতো। ২০০৬-০৭ সালে ঋদ্ধির বাংলাদলে অভিষকটাও অদ্ভুতভাবে। দীপ দাশগুপ্তের আইসিএলে খেলার জন্য বাংলার তখন দরকার একজন উইকেটরক্ষক। ঋদ্ধি জলপাইগুড়ি থেকে এসে অখন অনুর্দ্ধ বাইশ খেলছেন বাংলায়। হায়দ্রাবাদের বিরুদ্ধে অভিষেকেই সেঞ্চুরি৷ ১৫ নম্বর বাঙালি হিসেবে রেকর্ড, প্রথম ফার্স্টক্লাসেই সেঞ্চুরি। সেই সময়ে ২২ বছরের ঋদ্ধিমান একেবারেই মিডিয়া লাইমলাইটে নেই, ২০০৯-১০ রঞ্জি মরশুমে ৩১৮ রান করার সময়ও তো কোনো বাঙালিকে সরব হতে দেখা যায়নি জলপাইগুড়ির ছেলেটার জন্য!
আরও পড়ুন
দুর্ঘটনায় পা হারালেও থামেনি ক্রিকেট, বঙ্গসন্তানের নেতৃত্বেই বাইশ গজে লড়াই ভারতের
আজ সূর্যকুমার যাদবের জন্য মুম্বই লবির যে বিশাল সওয়াল তার সিকিভাগও কি বাঙালি সে সময়ে দিয়েছিল দেশের শ্রেষ্ঠ টেস্ট কিপারকে? এই না দেওয়ার পিছনে সেই প্রেক্ষাপটের দুটো ঘটনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত সৌরভ গাঙ্গুলির অবসর, বাঙালির মিইয়ে যাওয়া ভাবাবেগে স্ফুলিঙ্গ জ্বেলে দেওয়া চণ্ডী গাঙ্গুলির ছোটো ছেলে তখন গনগনে আঁচের মধ্যে মাঠ ছাড়ছেন। আইপিএল আসছে বাজারে। অশোক দিন্দা আর মনোজ তিওয়ারি তখন বাঙালির পিদিমের আলো, সৌরভোত্তর জমানায় কলকাতা শহর যে দুজনকে ব্যাক করেছে প্রবলভাবে। দ্বিতীয়ত, মহেন্দ্র সিং ধোনি যেন হ্যালির ধূমকেতুর মতো এসে গেছেন ভারতীয় ক্রিকেট কুরুক্ষেত্রে৷ ২০০৭-এ লজ্জার বিশ্বকাপ হারের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপটা জোহানেসবার্গে জিতে মাহি তখন মধ্যগগনে। এই খাসকলকাতার বুকেই সৌরভ গাঙ্গুলির বিশাল ছায়া থেকে বেড়িয়ে কিছু মানুষ তখন থেকেই আঁকড়ে ধরছেন এই সেনসেশনকে। ঋদ্ধিমানের কেরিয়ারের যে সময়টাতে ভারতের জাতীয় দলের ক্যাপটা মাথায় আসার কথা সে সময়ে সত্যিই কি কেউ প্রশ্ন করতে পেরেছেন স্বয়ং মাহেন্দ্র সিং ধোনিকে? ২০১১-২০১২ সালে টেস্ট ক্রিকেটে শোচনীয় অধ্যায়ের পরেও মাহির দিকে আঙুল তোলা ছিল কার্যত অসম্ভব। বিশ্বজয়ের নায়ক নিজেও কি কোনোদিন বুকঠুকে বলতে পারবেন যে টেস্ট কিপিং-এ তাঁর জায়গাটা অনেক আগে থেকেই দাবি করে আসছিলেন বাংলার ঋদ্ধিমান? নাকি আজকের প্রতিবাদী হয়ে ওঠা বাঙালি দর্শক, মিডিয়া - চোখে চোখ রেখে বলতে পারবে সৌরভবঞ্চনার প্রতিবাদের থেকে মুখ তুলে অনেকবছর আগে তাঁরা যথেষ্ট চেষ্টা করেছিল এই বঙ্গতনয়ের হয়ে সওয়াল করার?
২০১৪ সালে কিংস ইলেভেন পঞ্জাবের ফ্র্যাঞ্চাইজি নিল ঋদ্ধিকে, ফাইনালে অতিমানবিক সেঞ্চুরি। টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক হয়ে যাওয়া ঋদ্ধির আইপিএলে স্ট্রাইকরেট ১৪৫ তখন। তারপর চেন্নাই হয়ে রেকর্ড দামে হায়দ্রাবাদ ফ্র্যাঞ্চাইজিতে।
আরও পড়ুন
দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেগস্পিনার তিনি, বোর্ডের সঙ্গে সংঘাতে ছেড়েছিলেন ক্রিকেট
কিন্তু এতকিছুর পরেও ঋদ্ধিমান কী বলছেন? এইখানে এসেই বাঙালির প্রিয় বঞ্চনা ও উত্থানের চিত্রনাট্যে একটা সমান্তরাল অক্ষ হয়ে ওঠেন ঋদ্ধিমান। তাঁকে কেরিয়ারের সবচেয়ে সোনালি সময়টাতেই লড়ে যেতে হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটের সবচেয়ে প্রভাবশালী চরিত্র মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে, টেস্টে কিপার-ব্যাট তত্ত্বকে কিছিদিনের জন্য ব্যাট-কিপারে পাল্টেওছিলেন তিনি। কিন্তু ঋদ্ধিমান অকপটে স্বীকার করেন মাহিভাই থাকলে আমার চান্স পাবার কিথা না, আমি জানি, তাতে আমার আক্ষেপ নেই। আমি শিখতে পেরেছি।
সৈয়দ কিরমানি, কিরণ মোরে আর ঋদ্ধিমানের সূক্ষ্ম ক্রিকেটীয় ব্যকরণ বিশ্লেষণ করলে কে ভারতের টেকনিকালি সবচেয়ে স্ট্রং উইকেটরক্ষক তা নিয়ে হালকা বিতর্ক থাকবে৷ কোহলি জমানায় শামি-বুমরা-ঈশান্ত ত্রিফলার যে ভয়াবহ প্রভাব তার পিছনে মেঘে ঢাকা তারার মতো থেকে গেছেন ঋদ্ধিমান। লালচেরি বলের টেস্ট ক্রিকেটের মিথ বলে চূড়ান্ত কেটে যাওয়া সুইং যদি ফার্স্ট স্লিপ অবধি কভার করে নেবার ক্ষমতা কিপারের থাকে তাহলে পেস বোলারের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, হয়েছেও তাই। ভারতের ঘূর্ণি পিচে অশ্বিন-জাদেজা কিংবা ওভারসিজে পেসত্রয়ীকে ঋদ্ধি সামলাচ্ছেন৷ ক্যাপ্টেন কোহলি থেকে রবি শাস্ত্রী, বিশ্বের তাবড় ক্রিকেট বিশ্লেষকরা বলে দিচ্ছেন এই মানের উইকেটরক্ষণ আন্তর্জাতিক মঞ্চে হয়তো আর নেই।
আরও পড়ুন
ক্রিকেটের বিতর্কিত ‘মানকাডিং’ তাঁর নামেই; সাদা চামড়ার রাজনীতির শিকার বিনু মানকড়?
তবু ঋদ্ধি নির্বিকার। আদ্যোপান্ত প্রফেশনাল৷ বাঙালির যে মুম্বাইতে ফ্লিনটফের জামা খোলা থেকে লর্ডসের দাদাগিরির রূপকথা তার কোথাও তিনি নেই। একেবারে মফঃস্বলের কবির মতো কবিতা জমা দিয়ে আসছেন প্রকাশকের কাছে। নিঃশব্দে। সেখানে হেমন্তের বিকেলে ঝরে যাচ্ছে তাঁর ক্রিকেট যৌবন। সোনালি রোদ এসে পড়ছে যখন স্বয়ং ক্রিকেটঈশ্বর নিজে ভিডিও বার্তায় মেনে নিচ্ছেন ঋদ্ধিমানের ব্যাটিং প্রতিভা প্রশ্নাতীত। এই ৩৬ বছরের তরুণের কাছে এ যেন এক সমান্তরাল পথ।
এখানে প্রতিযোগিতা ও তাতে জিতে জার্সি ওড়ানোর মতো রোমাঞ্চ নেই আছে বহমানতা। যতদিন পারব, দেশকে, দলকে দিয়ে যাব কিছু। বাঙালির এখানেই দাঁতের ফাঁকে আটকে থাকা খাবারের কুচির মতো অস্বস্তি, মাইক্রোস্কোপের তলায় ফেলা দোষগুণ আর বঞ্চনার ট্রাপিজকে। এসবের দিকে আঙুল তুললে বাকি চার আঙুল যে নিজের দিকেও ওঠে। ঋদ্ধিমানের ক্রিকেট, সাধনা এই সবকিছুর উর্দ্ধে৷ চিরকালই। যেদিন বাঙালি নাইট রাইডার্স আর সৌরভ কোন্দল নিয়ে পাতার পর পাতা ভরিয়ে দিচ্ছিল সেদিন নিভৃতেই জীবনের সর্বোত্তম ফর্মে থেকেও লাইমলাইটে আসেন নি ঋদ্ধি, আজ সেই মানুষটার নিভৃত ক্রিকেটযাপন এত কোলাহলের প্রত্যাশা করে না। ঋদ্ধির জীবন একটা ছোটোগল্প, যেখানে শেষ না হওয়ার ব্যঞ্জনা আছে, একটা দীর্ঘ টেস্টের দ্বিতীয় দিন যেখানে কেউ জানেনা গন্তব্যের কথা, সেশন থেকে সেশনে চলে যাচ্ছে সময়, দুটো শান্ত চোখ চেয়ে আছে বোলারের আঙুলের দিকে, ডানদিজে বাঁদিকে তিরতির করে কেঁপে উঠছে যাবতীয় তর্কবিতর্ক, বাকি গল্প দুটো গ্লাভসের ভেতর। তাতেই সে নিরাপদ। কোলাহল থেকে অনেক অনেক সযত্নে সেই গ্লাভস লালন করছে তাদের।
আরও পড়ুন
এদেশের প্রথম দলিত ক্রিকেটার তিনি, ‘লগান’ সিনেমার কাছরা চরিত্রটির অনুপ্রেরণা
আর আমাদের বঙ্গজীবনের সেই আগুনকে যদি একটিবার জ্বলে উঠতেই হয়, যদি মনে হয় একবার মিডিয়া থেকে জনমানসে ঋদ্ধিমানকে মুহূর্তের সুপারম্যান করে তুলতে হবে তবে আজ, আই পি এলের মহারণের আগে বাঙালির ক্যাচলাইন হোক, এই গানটাই -
"প্রতিদিন সূর্য ওঠে তোমায় দেখবে বলে
হে আমার আগুন, তুমি আবার ওঠো জ্বলে..."
তবে এরপরেও ঋদ্ধি প্রেস কনফারেন্সে এসে বলবেন না গা গরম করে দেওয়া কিছু। বড়োজোর বলবেন- "কিছু প্রমাণের জন্য খেলি না, দলকে জেতানোই আমার কাজ..."
হলুদ বসন্তের ভারতীয় ক্রিকেট, ঘন হয়ে আসা আষাঢ়ের ভারতীয় ক্রিকেট, প্রচণ্ড তেজে ঝলসে ওঠা ভারতীয় ক্রিকেটের বাইশ গজে ঋদ্ধিমান আসলে হেমন্তের অরণ্যের সেই একলা পোস্টম্যান। অবহেলিত বা অবদমিত অবস্থা থেকে উত্থানের রূপকথাকেই রিল কিংবা রিয়েল লাইফের ব্লকবাস্টার শো হিসেবে গণ্য করার স্টিরিওটাইপিক বাঙালি চেতনা এখানে সপাটে ধাক্কা খায় বৈকি!
Powered by Froala Editor