দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেগস্পিনার তিনি, বোর্ডের সঙ্গে সংঘাতে ছেড়েছিলেন ক্রিকেট

আইপিএল হোক অথবা টেস্ট, ক্রিকেটের ভরা বাজারে লেগ স্পিনারদের কদর সবসময়ই ছিল। কিন্তু ভারত তথা ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনারের কথা বললে সুভাষ গুপ্তের নামটা হয়তো হঠাৎ করে মাথায় আসবে না তুখোড় ক্রিকেট পণ্ডিত ছাড়া কারোরই। অথচ তাঁর সম্বন্ধেই বলা হয়েছিল, “আধুনিক ক্রিকেটাররা যে ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকে মাঠে ফিল্ডারদের থেকে, সেটা যদি সুভাষ গুপ্তে পেতেন তাহলে টেস্ট ক্রিকেটে ১৮০০ উইকেট হত তাঁর!” বোমার মতো এই কথাটি যিনি বলছেন, তিনি একটু-আধটু খেলেছেন ক্রিকেট খেলাটা, স্পিন বোলিং ব্যাপারটা মোটামুটি বোঝেন এবং দুনিয়া তাঁকে চেনে এরাপল্লি প্রসন্ন নামে। কিন্তু যাঁর সম্বন্ধে বলা হচ্ছে, সেই সুভাষ গুপ্তে অনেকটাই হারিয়ে গিয়েছেন বিস্মৃতির আড়ালে। অথচ বরাবর নিজের নিয়মে বেঁচেছেন মানুষটা। নিজস্ব ‘সোয়্যাগ’ দেখিয়েই ক্রিকেটটা খেলেছেন শেষদিন অবধি। কিন্তু এত অদ্ভুত ভাবে ক্রিকেট কেরিয়ার শেষ হয়েছিল সুভাষ গুপ্তের, যে সময়ে সময়ে বলিউড সিনেমার চিত্রনাট্য বলেও মনে হতে পারে সেটাকে।

স্যার গারফিল্ড সোবার্স একাধিকবার বলেছিলেন, শেন ওয়ার্ন অসম্ভব ভাল বল ঘোরাতে পারলেও (সোবার্সের কথায় “আ গ্রেট টার্নার অফ দ্য বল”), তাঁর থেকেও ভাল বোলার ছিলেন গুপ্তে। “...বাট সুভাষ গুপ্তে ওয়াজ আ বেটার বোলার।” এর সঙ্গেই যোগ করেছিলেন, গুপ্তে হয়ত খুব বেশি দিন ক্রিকেট খেলেনি, কিন্তু অনেক বেশি ভাল উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। “আ লট অফ গুড উইকেটস্।” অর্থাৎ বলতে চেয়েছিলেন যে, অনেকেই হয়ত ৫০০ বা তারও বেশি উইকেট পাবে, কিন্তু তার কতগুলো প্রথম ৫ জন ব্যাটসম্যানের উইকেট হবে? বিপক্ষের ‘টপ ফাইভ’কে গুঁড়িয়ে দেওয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল সুভাষ গুপ্তের মধ্যে। এভারটন উইকসের মতো প্রবাদপ্রতিম ব্যাটসম্যানও যে কারণে বলেছেন, সুভাষ গুপ্তে তাঁর খেলা সেরা লেগ স্পিনার। এভারটন উইকস মারা গেছেন এই বছরেরই জুলাই মাসে। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৮, ১০ বছরের মতো খেলেছেন ক্রিকেটটা; ৪৮ টেস্টে করেছেন ১৫টা সেঞ্চুরি আর ১৯টা হাফ সেঞ্চুরি। সুতরাং কথাটার একটা আলাদা তাৎপর্য এখান থেকেই বোধহয় আন্দাজ করা যায়।

১৯৫৩। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ট্যুর। ঘাসে ভরা উইকেট। কিন্তু তাও সেই সিরিজে পঞ্চাশটা উইকেট ঝুলিতে ভরেছিলেন সুভাষ গুপ্তে। যোগ্য সঙ্গ দিয়েছিলেন বিনু মানকড়ও। কিন্তু গুপ্তেকে চিনে নেওয়া গিয়েছিল আলাদাভাবে। সেই দলে তখন কনরাড হান্ট, গ্যারি সোবার্স, রোহন কানহাই-এর মতো তারকাই শুধু নয়, ক্রিকেটের হল অব ফেমে বাঁধিয়ে রাখার মতো ক্যালেন্ডার হতে পারে যাঁদের নিয়ে, তাঁদের একেকজন। কিন্তু এই দলের বিরুদ্ধেও ফের ঝলসে উঠলেন গুপ্তে। এবার দেশের মাটিতে কানপুরে। তার বছর দুই আগে, ১৯৫৬ সালে টেস্টের এক ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছেন ইংল্যান্ডের জিম লেকার। সেই রেকর্ড ছুঁয়েছিলেন আর এক প্রবাদপ্রতিম ক্রিকেটার ভারতেরই অনিল কুম্বলে। ১৯৯৯ সালে, দিল্লির ফিরোজ শাহ কোটলায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। কিন্তু কানপুর টেস্টেই সেই রেকর্ড স্পর্শ করতে পারতেন গুপ্তে। ১০২ রান খরচ করে তুলে নিয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের ন’টা উইকেট। শেষ ব্যাটসম্যান ল্যান্স গিবস ক্যাচও তুললেন গুপ্তের বোলিংয়ে। কিন্তু উইকেটের পিছনে গিবসের ক্যাচ মিস করেন উইকেট কিপার নরেন্দ্র তামানে। পরের ওভারেই অপরপ্রান্তের বোলার বসন্ত রঞ্জনে আউট করে দিলেন গিবসকে। ১০ উইকেট পাওয়া হল না গুপ্তের। বিরল কৃতিত্বের অংশীদার না হতে পারার আক্ষেপ ভুলতে পারেননি তিনি। বহু বছর পর সখেদে জানিয়েছিলেন, যদি অপরপ্রান্ত থেকে বিনু মানকড় বোলিং করতেন, তাহলে বুদ্ধির পরিচয় দিয়ে নিশ্চিতভাবেই ‘ওয়াইড অফ দ্য অফ স্টাম্প বোলিং’ করতেন তিনি। সেই ভারতীয় ফিল্ডিংয়ের বেহাল দশা বদলে ছিলেন মনসুর আলী খান পতৌদি। কিন্তু ততদিনে আরও কত উইকেটকে ফসকে গেছে এইভাবে তার ইয়ত্তা নেই।

কিন্তু সেই সময়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেগস্পিনারের কেরিয়ারটাও শেষ হয়েছিল আচমকাই। ফর্মের তুঙ্গে তখন গুপ্তে। টেস্ট সিরিজ খেলতে ভারতে এসেছে ইংল্যান্ড দল। দিল্লিতে টেস্ট ম্যাচ উপলক্ষে রাজধানীর ইম্পিরিয়াল হোটেলে উঠেছে ভারতীয় দল। সুভাষ গুপ্তের রুম পার্টনার ছিলেন এ জি কৃপাল সিং। পাঞ্জাবি স্পিনার অলরাউন্ডার। সেখানেই হোটেলের রিসেপশনিস্ট মহিলাকে হঠাৎ একদিন রুম থেকে ফোন করে বসলেন কৃপাল সিং। প্রস্তাব খুবই সামান্য, “আমরা কি বাইরে কোথাও একটা ড্রিঙ্কস নিয়ে কিছুক্ষণ বসতে পারি?” কিন্তু রিসেপশনিস্ট মহিলা ভালোভাবে নিলেন না বিষয়টাকে। ফোন রেখেই তিনি অভিযোগ জানালেন হোটেলের ম্যানেজারকে, যিনি ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। সঙ্গে সঙ্গে ফোন গেল ভারতীয় দলের ম্যানেজারের কাছে। জল গড়াল অনেক দূর। ভারতীয় দলের ম্যানেজমেন্টের কাছে নির্দেশ এল বোর্ড থেকে। ডেকে পাঠানো হল সুভাষ গুপ্তে এবং কৃপাল সিংকে। ঘটনাচক্রে কৃপাল সিং যখন ফোন করছেন, গুপ্তে তখন অন্য ঘরে তাস খেলায় ব্যস্ত। বোর্ডের সামনে সেই কথাই জানালেন গুপ্তে। বললেন, ফোনটাও তো তিনি করেননি; তাহলে তাকে প্রশ্ন করার যুক্তি কোথায়? বোর্ড কর্তারা উল্টো প্রশ্ন করলেন, “কিন্তু তুমি তো ওকে থামাতে পারতে?” সুভাষ গুপ্তে উত্তর দিলেন নিজের গুগলির মতোই সপাট, “আরে ও পাঞ্জাবি লোক! আমার থেকে চেহারাতেও অনেক বড়ো। ওকে থামানো আমার কম্ম কী করে হতে পারে!” অসম্ভব বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে।

গুপ্তের এমন ব্যবহারকে ঔদ্ধত্য হিসেবেই দেখেছিলেন ভারতীয় বোর্ড কর্তারা। শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে সেই টেস্ট সিরিজ থেকে তো বটেই, পরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ থেকেও সাসপেন্ড করা হয় গুপ্তে এবং কৃপাল সিংকে। সিদ্ধান্ত শোনার পর গুপ্তেও পাল্টা জানিয়ে দেন, ভারতের হয়ে খেলতে আর ইচ্ছুক নন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পরের সিরিজের জন্য তাঁকে হিসেবের খাতা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হলেও, তার আগেই স্ত্রীকে নিয়ে ক্যারিবিয়ান দেশে পাড়ি দিলেন সুভাষ গুপ্তে। আর ফিরে আসেননি ত্রিনিদাদ থেকে। মাত্র ৩৬টা টেস্ট ইনিংসে ১৪৯ টেস্ট উইকেট। আরও উড়ানের আগেই থেমে যায় এক অনাবিল ক্রিকেট রূপকথা। এক লাইনে যে জার্নিটা যথার্থই লিখে গিয়েছেন ক্রিকেট লেখক মিহির বসু তাঁর ‘হিস্ট্রি অফ ইন্ডিয়ান ক্রিকেট’ বইতে: 'ভারতের প্রথম মহান স্পিনারের কেরিয়ার শেষ হয়ে গিয়েছিল, কারণ তিনি এমন একটা মানুষের সঙ্গে রুম শেয়ার করেছিলেন যিনি একটা মেয়েকে শুধুমাত্র ড্রিঙ্কে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন!'

সত্যি, ‘রয়্যাল গেম অব আনসার্টেনিটি’ এই কারণেই বোধহয় ক্রিকেটকে বলা হয়!

আরও পড়ুন
ক্রিকেটের বিতর্কিত ‘মানকাডিং’ তাঁর নামেই; সাদা চামড়ার রাজনীতির শিকার বিনু মানকড়?

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More