বিতর্কটা উঠেছিল গত আইপিএল থেকেই। পাঞ্জাব বনাম রাজস্থানের ম্যাচ। নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে দাঁড়িয়ে থাকা রাজস্থানের ব্যাটসম্যান জস বাটলার এগিয়ে গিয়েছিলেন বেশ খানিকটা। বল করতে এসে আচমকাই থমকে গেলেন পাঞ্জাব ক্যাপ্টেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন। ভেঙে দিলেন বোলিং প্রান্তের উইকেট। বিতর্কের ঝড় উঠল অশ্বিনের আউট করার ধরণ নিয়ে। কারণ মানকাডিং তো খেলার আত্মা বিরোধী। অথচ যার নাম জড়িয়ে গেছে এই আউটের ধরনের সঙ্গে তার থেকে বেশি হয়তো এই খেলাটাকে সম্মান অনেকেই করেনি...
বিনু মানকড়। ভারতের প্রথম ‘গ্রেট অলরাউন্ডার’ বলাই যায় তাকে। তবু মানকড়কে নিয়ে সেরকম কথা কোথায় আর হল ভারতীয় ক্রিকেটে? বরং খেলার স্পিরিট বিরোধী একটা বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে গেল তাঁর নাম। কিন্তু ইতিহাস কি সব সত্যি কথা বলে? নাকি বাদামী চামড়ার মানুষ বলে, সেই ইতিহাস মনে রাখতে বাধ্য করা হয় অন্যভাবে?
ভারতের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের তালিকা করতে বসলে হয়তো প্রথম দু’য়ের মধ্যেই আসবে কপিল দেব আর বিনু মানকড়ের নাম। এবং স্বয়ং কপিল দেব জানাচ্ছেন, ভারতের প্রথম প্রফেশনাল ক্রিকেটার ছিলেন কিন্তু বিনু। ইংলিশ কাউন্টিতে খেলতে গিয়েছিলেন। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনেকগুলো বছর স্রেফ ঘরোয়া ক্রিকেটই বিনুর প্রতিভার সাক্ষী থাকতে পেরেছিল। তারপর ১৯৪৬। নবাব ইফতিকার আলী খান পতৌদির নেতৃত্বে ইংল্যান্ড সফরে গেল ভারতীয় দল। দেশ তখনও পরাধীন। কিন্তু ঘরে-বাইরে চাপ বোধ করছে ব্রিটিশরা। সেই দলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন বিনু। বিদেশের মাটিতেই অভিষেক হয় বিনু মানকড়ের। এবং তার পরের ইতিহাসটা দাঁড়াল এইরকম যে, শেষ কুড়ি বছরের মধ্যে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ইংল্যান্ডের মাটিতে এক হাজার রান আর একশো উইকেট শিকার করার বিরল কৃতিত্ব তালুবন্দি করে নিলেন সহজাত দক্ষতাতেই। মোট ১১২০ রান এবং ১২৯ উইকেট, ইংলিশ সামার যে বিনুর নামেই জ্বলে উঠেছিল সেটা বলাই যায়। ইংল্যান্ড দলে তখন ডেরিক কম্পটন, ওয়ালি হ্যামন্ডের মতো তারকা ক্রিকেটার। সেই সিরিজের পর ‘ক্রিকেটার ম্যাগাজিন’ লিখল, “বিনু যদি ইংল্যান্ডের হত, তাহলে এতক্ষনে ওকে নিয়ে আমরা অস্ট্রেলিয়া রওনা দিয়েছি!” কারণ, তার পরেই শুরু হতে চলেছিল ঐতিহ্যবাহী অ্যাশেজ টেস্ট সিরিজ।
কাট টু, ১৯৫২। ততদিনে ভারতীয় স্পিনের জাদুকর উজ্জল হয়ে উঠেছেন আরও। বোলিংয়ের পাশাপাশি বিনু মানকড় তখন ব্যাটিংয়েও স্বচ্ছন্দ যে-কোনো পজিশনে। বাঁহাতি স্পিনে উইকেট তুলছেন। ব্যাট হাতে নামলে উপহার দিচ্ছেন ধৈর্যের সঙ্গে বড় রান। ক্রিকেট পিচের বিনু মানকড়ের ঘাম ঝরছে পুজোর অঞ্জলির মতো। সেইসময়ই আবার ইংল্যান্ড ট্যুর। দল তৈরি হওয়ার সময় প্রথম নামটাই লেখা হল বিনু মানকড়ের। এবং তখনই ঘটে গেল অদ্ভুত একটা ঘটনা। ল্যাঙ্কাশায়ার ক্রিকেট টিমের হয়ে সে বছর ইংল্যান্ডে খেলার কথা মানকড়ের। সই তখনও করেননি বটে, কিন্তু বিসিসিআইকে খোলাখুলি জিজ্ঞেস করলেন, দলে নাম থাকলেই হবে না; প্রথম একাদশে জায়গা নিশ্চিত তো? জায়গা নিশ্চিতই ছিল; তবু মানকড়ের এই কথাকে ঔদ্ধত্য হিসেবেই নিয়েছিলেন বিসিসিআই কর্তারা। দলের সেরা ক্রিকেটার হলেও মানকড়কে বলা হল, দলে জায়গা কারোরই পাকা নয়। মানকড়ও বলে বসলেন, “আমিও তবে ভারতের হয়ে এই সিরিজটা খেলছি না।” ব্রিটিশ ক্লাবের হয়ে খেলতে পাড়ি দিলেন তিনি।
ইংল্যান্ড সফররত ভারতীয় দল ঘোষণা হল। বিনুকে ছাড়াই দল পৌঁছে গেল ইংল্যান্ডে। পৌঁছানোর পরেই শুরু হল আতঙ্ক। দলের দুই নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় চোট পেয়ে ছিটকে গেলেন প্রথমেই। ভারতীয় দল বুঝতে পারল, মানকড়কে চাই। বিসিসিআই-এর কাছে টেলিগ্রামের পর টেলিগ্রাম আসতে লাগল ইংল্যান্ডে ভারতীয় দলের ম্যানেজারের থেকে। বক্তব্য বিন মানকড়কে অনুরোধ করা হোক ভারতীয় দলে যোগ দেওয়ার জন্য। ল্যাঙ্কাশায়ার লিগ টিম থেকে অনুমতি পেলেন বিনু। যোগ দিলেন ভারতীয় দলের সঙ্গে। ভারতীয় দলের প্রদর্শন আহামরি না হলেও, বিনু মানকড় আবার মন কেড়ে নিলেন সকলের।
কিন্তু তার বছর কয়েক আগেই সবথেকে বিতর্কিত অধ্যায়টা ঘটে গেছে তাঁর সঙ্গে। ব্যাটসম্যান ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গেলে, বোলার আউট করতেই পারে তাঁকে। ক্রিকেটের নিয়ম মেনেই সেটাকে ‘রানআউট’। কিন্তু খেলার ‘স্পিরিট’ এটাকে সমর্থন করে না বলে, এই ধরনের আউট এড়িয়ে চলতেই উৎসাহ দেওয়া হয়। এবং এই ভাবে আউট করা হলে বর্তমানে সেটাকে বলা হয়, ‘মানকাডিং’ বা ‘মাঁকড়ীয়’ আউট। যে ক’জন লেজেন্ড ক্রিকেট খেলাটা খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সেরা মানুষটার নামের সঙ্গে জড়িয়ে কেন রাখা হল এরকম একটা কালো নিশান?
আরও পড়ুন
এদেশের প্রথম দলিত ক্রিকেটার তিনি, ‘লগান’ সিনেমার কাছরা চরিত্রটির অনুপ্রেরণা
ফ্ল্যাশব্যাক ১৯৪৭। যে মানকড়কে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে যেতে চেয়েছিল ব্রিটিশ ক্রিকেট দল, সেই অস্ট্রেলিয়াতেই এবার খেলতে গেল ভারত। ততদিনে স্বাধীনতা পেয়েছে দেশ। স্বাধীন ভারতের দল হিসেবে প্রথম বিদেশ সফর। প্রত্যাশা তুঙ্গে। কিন্তু সেখানেই সিডনি টেস্টে ঘটে গেল অপ্রীতিকর একটা ঘটনা। এক দিক থেকে নাগালে বল করে যাচ্ছিলেন মানকড়। বোলিং প্রান্তে রানারের ভূমিকায় তখন অজি ব্যাটসম্যান বিল ব্রাউন। তার আগের সপ্তাহেই একটা প্র্যাকটিস ম্যাচে শেফিল্ড শিল্ড টিমের হয়ে ভারতীয় দলের বিরুদ্ধে খেলেছিলেন এই ব্রাউন। সেখানে তিনি বারংবার রানার প্রান্তের ক্রিজ ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বোলার বল ছাড়ার আগেই। মানকড় বোলিং করা থামিয়ে দিলেন হঠাৎ। সাবধান করলেন ব্রাউনকে। কিন্তু ব্রাউন পুনরায় একই কাজ করেই চললেন সেই। এইবার ক্রিকেটের নিয়ম মেনেই বোলিং প্রান্তের উইকেট ভেঙে দিলেন মানকড়। ব্রাউন তখন ক্রিজের বাইরে। কিন্তু অভ্যাস ম্যাচ হওয়ায় তেমন আলোচনা হল না বিষয়টাকে নিয়ে। কিন্তু তারপরেই সরকারি টেস্ট ম্যাচেও বিল ব্রাউন যখন এই একই কাজ করে চললেন, আবার তাঁকে আউট করতে দ্বিধা বোধ করলেন না মানকড়। তীব্র সমালোচনা শুরু হল চারিদিকে। বলা হল, ভদ্রলোকের খেলার ‘স্পিরিট’টাকে নষ্ট করে দিলেন মানকড়। অথচ খেলার নিয়মের মধ্যে থেকেই শুধু একটা দিন নয়, আগের ম্যাচ থেকেই কিন্তু তিনি সাবধান করে আসছিলেন ব্যাটসম্যানকে।
সেই সময় সমস্ত ‘হোয়াইট প্রেস মিডিয়া’ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মানকড়েরর উপর। কিন্তু অদ্ভুতভাবে পাশে পেয়েছিলেন এমন একজন মানুষকে, যিনি ক্রিকেটটা বুঝতেন এবং সারা পৃথিবী যাঁকে চেনে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান হিসেবে। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু বছর পরে স্বয়ং বিল ব্রাউনও স্বীকার করে নেন যে, বিনুর ভুল ছিল না ওই ভাবে আউট করায়; বরং বারংবার মানা করলেও সেটা না শুনে ভুল করেছিলেন ব্রাউন নিজেই। নিজের মুখেই বললেন, “সেটা প্রাপ্য ছিল আমার।” কিন্তু এই ঘটনা আঘাত করেছিল হয়তো সাদা মানুষদের ইগোতে।
তবু প্রশ্ন থাকবে, যদি খেলার কোনও আইন খেলার আত্মা নষ্ট করছে বলে মনে করা হয়, তবে সেই আইনটা রাখার যৌক্তিকতা কোথায়? কেন থাকবে সেই আইনটা? আইসিসি কিন্তু তাদের রুল বুক থেকে ‘মানকাডিং’ শব্দটা উড়িয়ে দিয়েছে। তাই ‘মানকাডিং’ নিয়ে কথা বলা মানে এমন একটা বিষয় নিয়ে কথা বলা, যেটার এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই। এটা স্রেফ একটা রান আউট। এখন অন্তত ভারতীয় ক্রিকেটের অন্যতম যুগপুরুষকে একটু হলেও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারণ করতেই পারি আমরা!
আরও পড়ুন
২৩০ বছর পেরিয়ে, কেমন আছে 'ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব'?
Powered by Froala Editor