২৩০ বছর পেরিয়ে, কেমন আছে 'ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব'?

ক্রিকেটের গল্প কি কেবল বর্তমানেই আটকে আছে? একদমই নয়! বরং সেখানে হাজির হয়েছে ইতিহাস। এক বিশাল চালচিত্র, যেখানে জন্ম নিয়েছে বহু মিথ, বহু কিংবদন্তি। শুধু কি প্লেয়ার? ইতিহাস আটকে আছে বাইশ গজের পিচ আর সবুজ মাঠেও। বিশ্ব ক্রিকেটের কথা বললে হাজির হবে ‘মক্কা’, অর্থাৎ লর্ডস ক্রিকেট গ্রাউন্ড। আর বাংলা তথা ভারতের কথা বললে? অবধারিতভাবে চলে আসবে ইডেন গার্ডেনস। কিন্তু এখানেই কি শেষ? ইতিহাস কোথাও কি লর্ডস আর কলকাতাকে এক করে দেয়নি? এই প্রসঙ্গ ধরেই আমাদের সামনে হাজির হবে আরও একটি ক্লাব। আজকের দিনে ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সিএবি’র বি.সি.রায় ক্লাবহাউজ, সেখানেই একদিন ছিল একটি প্যাভিলিয়ন। সঙ্গে ছিল একটি ক্লাব— ‘ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব’। দুশো বছর অতিক্রম হয়েছে কবেই! আজও বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ক্রিকেট ক্লাবগুলির একটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহরের বুকে, ১৯/১ গুরুসদয় রোডের ঠিকানায়…

সালটা ১৭৬০। ইংল্যান্ডের বুকে ততদিনে শুরু হয়ে গেছে ক্রিকেট খেলা। একদিনের ম্যাচ বা টি-টোয়েন্টি ছিল স্বপ্নেরও অতীত। স্রেফ টেস্ট ম্যাচই ছিল সম্বল। সাদা জামা-প্যান্ট পরে মাঠে নেমে পড়ত খেলোয়াড়রা। তারপর চলত অনন্ত ম্যাচ। সেই সময়ই ইংল্যান্ডের একটি গ্রাম হ্যাম্বলডন তৈরি করল ইতিহাস। বিশ্বে প্রথমবার কোনো ক্রিকেট ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হল সেখানে। আর তার কয়েক বছর পরেই, ১৭৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হল মেরিলবন ক্রিকেট ক্লাব। কালে কালে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গেল ক্লাবটি। পরবর্তীকালে লর্ডসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলেও ঐতিহ্য হারায়নি। আজও সমানভাবে বেঁচে আছে এরা… 

কয়েকশো কিলোমিটার দূরে, সাগর পেরিয়ে আরেকটি দেশে তখন স্বপ্ন দেখছে ক্রিকেটের। পলাশীর যুদ্ধ শেষ। বণিকের মানদণ্ড, রাজদণ্ড হিসেবে হাজির হল ভারতের সামনে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন কায়েম হল দেশে। কলকাতা তাদের সাধের রাজধানী। ইংরেজরা মনের মতো করে সাজাবেন এই শহরকে। তাঁরা এসে থাকবেন; অথচ ক্রিকেট থাকবে না? কয়েকজন ইংরেজ ক্রীড়াপিপাসু একসঙ্গে হয়ে তৈরি করলেন একটি ক্লাব। তখনও অত ভালো করে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। কেবল ওই নামটুকু আর কিছু খেলোয়াড়ই যা সম্বল। তাই দিয়েই চলতে লাগল খেলা। ভারতীয়রাও অবাক! নতুন ধরণের খেলা এবার শিখতে হবে। ১৭৮০ সালে হিকির বেঙ্গল গেজেটে প্রথমবার সামনে এল এই ক্লাবের নাম। একটু একটু করে ক্রিকেট ম্যাচও খেলতে আরম্ভ করলেন তাঁরা। 

কিন্তু এই সামান্য জায়গাতেই ধরে রাখা হবে ক্লাবটিকে? আরও বড়ো স্বপ্ন দেখা হবে না? এই প্রশ্ন থেকেই শুরু হল আরও বড়ো করার উদ্যোগ। ১৭৯২ সাল। বিশ্ব ইতিহাস তো বটেই, ভারতের ক্রীড়া ইতিহাসের জন্যও এই বছরটি গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতার বুকেই তৈরি হল ‘ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব’। তখন গোটা বিশ্বে ক্রিকেট ক্লাবের সংখ্যা নামমাত্র। সেই তালিকায় এবার ঢুকে গেল কলকাতা। ইডেন গার্ডেনস হওয়ারও আগে তৈরি হল আরও এক আখ্যান… 

সেই সময় নিজস্ব খেলার মাঠ ছিল না এই ক্লাবের। ‘কলকাতার ফুসফুস’ ময়দানের বুকেই চলত ক্রিকেট খেলা। খোলা মাঠে নামত দুই টিম। আর সেই খেলা দেখার জন্য উত্তেজনাও থাকত বাকিদের। কিন্তু মাঠের ভেতর যে দর্শকরা চলে আসছে! খেলা হবে কী করে! একটা সময় পর মাঠের ধারে বেড়া বাঁধার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। ১৮৪১ সালে ময়দানের চারদিকে বসানো হল সেই বেড়া। ভেতরে শুরু হল ক্রিকেট ম্যাচ। আর সেই খবরই পৌঁছে গেল ইংরেজ সরকারের কাছে। একদম কাছেই ফোর্ট উইলিয়াম-সহ সমস্ত সরকারি দফতর। নিরাপত্তা নিয়ে একটা প্রশ্ন উঠল। আর সেই কোপ এসে পড়ল ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাবের ওপর। ১৮৬২ সালে প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার জেনারেলের চিঠি গেল উচ্চমহলে। এভাবে খোলা জায়গায় ক্রিকেট খেলা যাবে না; বিশেষ করে ময়দান চত্বরে। এখানে সেনাদের ড্রিলিং হয়, ফোর্ট উইলিয়ামের কাজকর্ম হয়। কাজেই এখানে ম্যাচ আয়োজন করা যাবে না। অগত্যা, ছাড়তে হল ময়দান… 

ক্যালকাটা ক্রিকেট ক্লাব পড়ল মুশকিলে। শহরের বুকে আরেকটা প্যাভিলিয়ন খোঁজাও তো খুব মুশকিল। ১৮৬৪ সালে ময়দানের অনতিদূরে একটি জায়গার সন্ধান পেল ক্লাব কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই জায়গার আংশিক চলে যাবে ইডেন গার্ডেনসে। কাজেই ওই জায়গা দেওয়া যাবে না। শেষ পর্যন্ত ওই বছরেরই এপ্রিল মাসে মিলল একটি ঠিকানা। প্রায় ১২৫ ফুট বাই ২৫ ফুটের বার্মা টিকের প্যাভিলিয়ন, সামনে মাঠ; খেলার আদর্শ পরিবেশ। একটু যেন মেরিলবন ক্রিকেট ক্লাবের প্যাভিলিয়নের আদলও মিশে ছিল। সব মিলিয়ে ঝাঁ-চকচকে হয়ে যাত্রা শুরু হল কলকাতা তথা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ক্রিকেট ক্লাবের। 

আরও পড়ুন
আপনার মতে আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেটে শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান কে?

আজও ক্লাবটির অস্তিত্ব বর্তমান। কেবল ক্রিকেট নয়, ফুটবলেও উন্নতি করেছিল ক্লাবটি। পাশাপাশি ছিল ‘ক্যাকলাটা ফুটবল ক্লাব’ও। একটা সময় মোহনবাগানের বিরুদ্ধে এর ম্যাচগুলোর কথা সবার মুখে মুখে ফিরত। সঙ্গে ছিল মহামেডান, আরিয়ানের মতো ক্লাবও। আটবার কলকাতা লিগও জিতেছে এই ক্লাবটি। চুনী গোস্বামী, সুভাষ ভৌমিক, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বরা যুক্ত ছিলেন এর সঙ্গে। ১৯৬৫ সালে জুড়ে যায় দুটি ক্লাব। নতুন নাম হয় ‘ক্যালকাটা ক্রিকেট অ্যান্ড ফুটবল ক্লাব’। র্মা টিকের সেই প্যাভিলিয়ন মুছে গেছে কবেই! কিন্তু গুরুসদয় রোডে গেলে আপনার অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে ক্লাবটি। সঙ্গে এক টুকরো ইতিহাস। কলকাতা আর ক্রিকেটকে কি আলাদা করা যায়! 

তথ্যসূত্র –

১) Calcutta Cricket and Football Club official website
২) ‘Calcutta Cricket Maidan, Calcutta, 1792’, Purono Kolkata
৩) ‘Calcutta Cricket and Football Club- Heritage clubs’, Tutorial at Home
৪) ‘Story of Cricket’, BBC

ছবি ঋণ - ccfc1792.com

আরও পড়ুন
মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন যুবরাজ, ক্রিকেটের সঙ্গে শেখালেন জীবনেরও পাঠ

Powered by Froala Editor

More From Author See More