নোবেলজয়ী বাঙালির এক বছর; দেশের দুর্দিনে আরও প্রাসঙ্গিক অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

২০১৯-এর ডিসেম্বর মাস। তখনও করোনা নামক ত্রাসের আগমন হয়নি পৃথিবীতে। স্বাভাবিক ছন্দেই জীবন কাটছে সবার। গোটা বাংলার চোখ তখন মোবাইলে, কিংবা টিভির পর্দায়। সামনে ভেসে উঠেছে স্টকহোমের কনসার্ট হল। কিছুক্ষণ পর মঞ্চে উঠলেন তিনজন। লম্বা, রোগা, চশমা পরিহিত একজন এগিয়ে এলেন সামনে। পরনে কালো কোট, ধবধবে সাদা ধুতি এবং পাঞ্জাবি। পাশেই শাড়ি পরে দাঁড়িয়ে তাঁর বিদেশিনী স্ত্রী। অবশেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী’র হাতে তুলে দেওয়া হল নোবেল পুরস্কার। অর্থনীতির ময়দানে তাঁদের গবেষণা নতুন দিশা দেখিয়েছে পৃথিবীকে— তার জন্যই এই সম্মান। গোটা বাংলা আরও একবার উৎকর্ষের ছোঁয়া পেল। মঞ্চে যে দাঁড়িয়ে আছেন এই বাংলারই ছেলে, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী এস্থার দুফলো…

প্রায় এক বছর আগের এই দৃশ্য এখনও অনেকে ভুলতে পারেননি। বহুদিন পর বাংলার বুকে এল নোবেল; অমর্ত্য সেনের পর অর্থনীতিতে বিশ্বের স্বীকৃতি আদায় করে নিলেন অভিজিৎ। গত অক্টোবরে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হবার পর নানা মহল থেকে ডাক পেয়েছেন তিনি। এসেছে সম্মান, প্রশংসা; পাশাপাশি নিন্দাও! আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করলেও মনেপ্রাণে যে তিনি আজও বাঙালি, বাংলার ঐতিহ্যের বাহক, সেকথা বারবার মনে করিয়ে দেন অভিজিৎ। কাজের মধ্যে দিয়েও বারবার ফিরতে চেয়েছেন এই দেশে। এখানকার দরিদ্র মানুষদের কথা ভেবেছেন, তাঁদের উন্নতির জন্য একের পর এক পরীক্ষামূলক কাজ করেছেন। কখনও আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, কখনও ভারত— ‘পুওর ইকোনমিক্স’কে নতুন করে চাঙ্গা করার জন্য তিনি এবং এস্থার কাজ করে যাচ্ছেন। পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে, ছোটো ছোটো ঘটনার হাত ধরে সমস্যার গভীরে পৌঁছনো, তারপর সমাধানের রাস্তা খোঁজা— এমন রাস্তাতেই বিশ্বাসী তিনি। আমাদের জীবনযাপনের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আসল কথাগুলো! 

উন্নয়ন কী? তার খামতির কারণই বা কী? এই প্রশ্নের হাত ধরেই পৌঁছে যাওয়া গবেষণার গভীরে। ছোটো ছোটো দৃশ্য কী করে আসল সমস্যাকে চেনাতে সাহায্য করে তার বহু নমুনা তৈরি করেছেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। নিয়ে এসেছেন তাঁর বিখ্যাত ‘র্যা ন্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’ তত্ত্ব। দেখিয়েছেন, বাড়িতে চটি নেই বলে আফ্রিকার শিশুরা খালি পায়ে স্কুলে যায়। ফলে প্রায়শই রোগাক্রান্ত হয় তারা। এবং এই চটি না থাকা এবং রোগাক্রান্ত হবার ফলেই স্কুলছুটদের সংখ্যা বাড়ছে সেখানে। বাড়ছে দারিদ্র্য, অপরাধ। শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে একটা প্রজন্ম। এভাবেই মানুষের মধ্যে থেকে, তাঁদের জীবনকে দেখে অর্থনীতির ভেতরে পৌঁছনোর পথ দেখিয়েছিলেন অভিজিৎ। আর তাঁর সেই গবেষণা পথ দেখিয়েছে গোটা পৃথিবীতে… 

নোবেল পুরস্কার প্রাপক হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হবার পর বেশ কিছু মুহূর্ত মনে থেকে গেছে। গত বছর অক্টোবরে ঘোষণা হবার পর এমআইটি’র মিডিয়া সেন্টারে যখন হাজির হলেন অভিজিৎ বিনায়ক এবং এস্থার, তখন সাংবাদিকরাই বাংলায় কথা বলার জন্য অনুরোধ করেন। সাবলীল বাংলায় নিজের গবেষণা নিয়ে ছোটো বক্তৃতাও রাখেন। নোবেলের মঞ্চে দাঁড়িয়েও সেই বাংলাকে ভোলেননি অভিজিৎ। 

নোবেলের পর কেটে গেছে বেশ কিছু মাস। এসেছে ২০২০ সাল। নতুন একটি দশক, অনেক স্বপ্ন, অনেক প্রত্যাশা। কিন্তু শুরুতেই বাধা পড়ল যাত্রায়। বিশ্বে হাজির হল করোনা পরিস্থিতি। একটা ভাইরাস সমস্ত স্বাভাবিক জীবন থামিয়ে দিল। বন্ধ হল স্কুল-কলেজ, কারখানা। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশ দেখল পরিযায়ী শ্রমিকদের মৃত্যুমিছিল। এখনও স্বাভাবিক হয়নি পরিস্থিতি। গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে নেমেছে ধস, কাজ হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। দেখতে দেখতে ভারতও এইসব সমস্যার শিখরে এসে হাজির হল। 

এমন পরিস্থিতিতে আবারও মাঠে নামলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর মতো প্রথম সারির অর্থনীতিবিদ, ডাক্তার, বিজ্ঞানীরা শুরু করলেন গবেষণা, আলাপ-আলোচনা। অভিজিৎ দেখলেন, কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে নিজের পরিবার নিয়ে গ্রামের দিকে পা বাড়াতে শুরু করেছেন পরিযায়ী শ্রমিকরা। টাকা নেই, কাজ নেই, খাবার নেই। কিন্তু এই পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা কত? সরকার চুপ! অভিজিৎবাবুর মতে, এবার সরকার নিজে থেকে পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য উদ্যোগ নিক। করোনা পরিস্থিতি না হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের এমন মর্মান্তিক অবস্থার কথা সামনেও আসত না। যদি দেশ থেকে দারিদ্র দূর করতে হয়, তাহলে সবার আগে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন সুনিশ্চিত করা উচিত। বিভিন্ন ওয়েবিনারে বারবার এমন কথাই বলেছেন অভিজিৎ। ওঁদের সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করলে মাঠে নেমে কাজ করতে ও পরিকল্পনা করতে সুবিধা হবে। তাতে আখেরে দেশেরই ভালো। সেইসঙ্গে জোর দিয়েছেন করোনার ভ্যাকসিনের দিকেও। যখন ভ্যাকসিন আসবে, তখন যেন তার সুষম বণ্টন হয়— এই কথাটাও বলেছেন অভিজিৎ। আর সেখানে প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। তা না হলে ভ্যাকসিন নিয়েও কালোবাজারি শুরু হবে, বঞ্চিত হবে সাধারণ মানুষ। কখনও হাজির হয়েছেন ‘কোভিড কেয়ার নেটওয়ার্ক গ্রুপ’-এর আলোচনায়, কখনও দ্য ন্যাজ ফাউন্ডেশনে। সব জায়গায় একটাই কথা— এই অর্থনৈতিক দীনতা থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে দরিদ্র মানুষদের হাতে টাকা পৌঁছে দিতেই হবে। তাঁদের শিরদাঁড়া শক্ত হলে, দেশের অর্থনীতিও পায়ের নিচে জমি খুঁজে পাবে। কর্পোরেট এবং বিত্তশালী নয়, লক্ষ্য হোক সাধারণ, মধ্যবিত্ত ও গরিবরাই… 

আরও পড়ুন
সুদূর বস্টনে বসেও চিন্তিত অভিজিৎ, এগিয়ে এলেন আমফান দুর্গতদের জন্য

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় আজও থেমে নেই। লড়াই চলছে সমাজে, আর তার ভেতরে ঢুকে সমস্যার সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছেন তিনি। সেই প্রথম দিনগুলোর মতোই। একটা নোবেল তো পরিস্থিতিটা বদলে দিতে পারে না! তাই করোনা ও দারিদ্র্যের সঙ্গে এই লড়াইয়ে নিজেকেও সামিল করেছেন। বাংলাকে ভোলেননি তিনি; এই দুর্দিনেও এগিয়ে এসেছেন সাহায্যের জন্য। অধ্যাপনা, গবেষণা, পুরস্কার— সমস্ত কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে মানুষের জন্য কাজ করা। তাঁর প্রিয় শহর তো এটাই শিখিয়েছে তাঁকে… 

তথ্যসূত্র- 

১) ‘করোনা ভ্যাকসিন এলেও তা বিতরণের পরিকল্পনা প্রয়োজন, বললেন অভিজিৎ’, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘দারিদ্র দূরীকরণে পরিযায়ীদের তথ্য জরুরি, মত অভিজিতের’, আনন্দবাজার পত্রিকা
৩) ‘জানেন, জুতো নিয়ে কোন গবেষণা করে দারিদ্রের আশ্চর্য সত্য জেনেছিলেন নোবেলজয়ী অভিজিৎ!’, এনডিটিভি বাংলা 

আরও পড়ুন
আজ সন্ধেতেই নোবেল পদক পাচ্ছেন অভিজিৎ আর ডুফলো, পুরস্কারমূল্য দান করবেন গবেষণা-খাতে

Powered by Froala Editor