‘ব্যাক-বেঞ্চার’ হয়ে, ছাত্র রাজনীতি করে জেল খেটেও নোবেল পাওয়া যায়, দেখালেন অভিজিৎ

প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি, চোখে-মুখে দুষ্টুমির ছাপ। খানিক ঝিমিয়ে থাকত বলে বন্ধুরা নাম দিয়েছিল ‘ঝিমা’। পড়াশোনায় বরাবর ভালো। কিন্তু ঘোরতর পড়ুয়া বলতে যা বোঝায়, তা কোনওদিনই ছিল না সে। খেলতে ভালোবাসত, আড্ডা দিতেও। প্রেসিডেন্সিতে অঙ্ক আর অর্থনীতির প্রবেশিকা পরীক্ষায় ফার্স্ট। এদিকে আইএসআইতে স্ট্যাটিসটিক্স পড়ারও সুযোগ মিলেছে। ছেলেটা চলে এল প্রেসিডেন্সি। মাকে বলল, রোজ মহানির্বাণ রোড থেকে ঠেঙিয়ে রোজ বরানগর যেতে হলে আড্ডা আর খেলার সময় মিলবে না। অতএব, প্রেসিডেন্সিতে অর্থনীতিই পড়বে সে। অর্থনীতির প্রতি ভালোবাসার থেকেও আড্ডা আর খেলার সময় বের করাটাই প্রধান যুক্তি। কী আশ্চর্য, তার মা-বাবা সে যুক্তি মেনেও নিলেন।

প্রেসিডেন্সির ছাত্রজীবন শুরু হল। বাবা স্বয়ং কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান। ছেলেটা ক্লাসে বসত পিছনের বেঞ্চিতে। খোদ বাবার ক্লাসে ডুব মেরে সিনেমাও দেখতে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে একাধিকবার। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ট ওয়ান পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাসও জোটেনি। তাতেও অবশ্য খুব একটা বদলায়নি ছেলেটা। তারপরের বছরই ম্যাজিক। এত নম্বর পেল পরীক্ষায় যে পার্ট ওয়ানের ঘাটতি মিটিয়েও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।

এবারে ভাবুন, যদি আপনার পরিচিত কোনও মেধাবী ছেলে শুধুমাত্র আড্ডা আর খেলার সময় বের করার জন্য ‘বেটার কেরিয়ার অপশন’ হাতছাড়া করত, তাকে কী বলতেন আপনারা? তারপর যদি জানতে পারতেন, সে ক্লাস কেটে সিনেমায় যায় এবং পার্ট ওয়ানে ফার্স্ট ক্লাসও পায়নি, তাহলে? নিশ্চিত ভাবতেন, ছেলেটা গোল্লায় গেছে। সিদ্ধান্ত জানানোর আগে পার্ট টু-র রেজাল্টের জন্য অপেক্ষাও করতেন হয়ত।

গোল্লায় যাওয়া অবশ্য এইটুকুই না। দিল্লির জেনএনইউতে পড়তে গিয়ে ছেলেটার মাথায় ছাত্র আন্দোলনের ভূত চাপল। ছাত্র রাজনীতি যে মহাপাতকের ব্যাপার, সে তো প্রতিদিন বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে চারপাশ থেকে। তারমধ্যে জেএনইউ-র মতো বিশ্ববিদ্যালয়। সে তো নাকি ‘দেশদ্রোহী’ তৈরির কারখানা। সেই ছেলেটাও সতীর্থদের নিয়ে উপাচার্যর বাড়ি ঘেরাও করল। পুলিশের লাঠি খেল, গ্রেপ্তারও হল। তারপর দশদিন জেলবন্দি। ঠিকই শুনছেন, দ-শ দি-ন! যাকে বলে কেলেঙ্কারির একশেষ।

মুস্কিলটা হল, এহেন গোল্লায় যাওয়া, জেল খাটা ছেলেটাই হঠাৎ করে নোবেলও পেয়ে গেল। আর আমরাও তাঁকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করলাম। স্বাভাবিক, নোবেল কি সবাই পায়! তাও আবার এমন পোড়া দেশ থেকে! অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তাই এখন আমাদের গর্ব। কিন্তু, তাঁর বেড়ে ওঠার কথা জানলে খানিক হোঁচট যে খাবেই আমাদের প্রথাগত চিন্তা-ভাবনাগুলো।

নেহাত মেধার জোরে বিশ্ববিখ্যাত অর্থনীতিবিদ হননি অভিজিৎ। বরং, প্রথাগত ‘গোল্লায় যাওয়ার’ ধারণাকে হারিয়েই নোবেল পেয়েছেন তিনি। আমরা তাঁকে নিয়ে মাতামাতি করছি। আর তিনি ক্রমাগত আমাদের ভাবনা-বোধগুলোকে প্রশ্ন করেই চলেছেন। নিজের জীবন দিয়ে বোঝাচ্ছেন, শুধু মুখ গুঁজে না পড়েও বিখ্যাত শিক্ষাবিদ হওয়া যায়। শেখাচ্ছেন, ছাত্র-রাজনীতি করে জেল খাটলেও জীবন গোল্লায় যায় না। বরং, মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের রাজনীতি-সচেতন হওয়াটা প্রয়োজন। সেই কারণেই, জেএনইউ-র প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে প্রকাশ্যে দাঁড়ান তিনি। ক্যাম্পাসে মুক্ত পরিবেশের পক্ষে দাবি তোলেন। একদিকে শিক্ষাঙ্গনকে যখন ‘রাজনীতি-মুক্ত’ করার চেষ্টা চালাচ্ছে শাসক, তখন নোবেল-জয়ী দেশের অন্যতম সেরা শিক্ষাবিদ ছাত্র-রাজনীতির পক্ষে সওয়াল করছেন।

অভিজিৎ নোবেল পেয়েছেন। আমরা সেই আনন্দে মশগুল। এখন অভিজিতের গৌরবের অংশীদার আমরাও। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল আমাদের গর্বিত করেননি, আমাদের ভুলও প্রমাণ করেছেন। শিখিয়েছেন, জীবনকে নিজের মতো করে বাঁচতেও হয়। অভিজিৎ যেভাবে বেঁচেছেন। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেছেন গ্রামে। তথ্যচিত্র বানিয়েছেন। ছাত্রাবয়সে খেলা আর আড্ডাকে প্রাধান্য দিয়েছেন, প্রতিবাদ করে জেলে গেছেন। এবং তারপরে, তারপরেও নোবেল পেয়েছেন…

এরপরেও যারা নিজেদের সন্তানদের স্কুলের পরে খেলা কাটিয়ে টিউশনে পাঠাবেন, সকাল-সন্ধে-রাতে ঘাড়ে-মাথায় টিচার গুঁজে দেবেন, রেজাল্ট আর কেরিয়ারের দাবিতে তাদের কৈশোর উধাও করে দেবেন—তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম স্বীকৃতি পাওয়া এই বঙ্গসন্তান। কিঞ্চিৎ অস্বস্তি হবে তো এরপর অভিজিতের কথা ভাবলে?