দু'বার অস্কারজয়ী এই অভিনেত্রীর জন্ম দার্জিলিং-এ, পড়তেন লোরেটো কনভেন্টে!

১৯৪০ সাল। অস্কারের মঞ্চ আলো করে রেখেছেন সব তারকারা। অবশেষে সময় এল সেই বছরের সেরা অভিনেত্রীর নাম ঘোষণা করার। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। কে হবে এবার? একসময় মঞ্চে ঘোষণা করা হল তাঁর নাম। ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেত্রীর স্বীকৃতি পেলেন ভিভিয়েন লেই। সাতাশ বছরের এক প্রাণোচ্ছল তরুণী উঠে দাঁড়ালেন মঞ্চে। তাঁর রূপের জাদুতে এমনিই মেতেছে গোটা হলিউড। মঞ্চে সেই সৌন্দর্য আরও বিকশিত হতে শুরু করল। পুরস্কার নেওয়ার পর ভিভিয়েনের কি মনে পড়ছিল ছোটবেলার সেই পাহাড়ি দিনগুলোর কথা? মনে পড়ছিল দার্জিলিংকে?

অস্কারের মঞ্চে এরপরেও একবার হাজির হয়েছিলেন ভিভিয়েন। সেবারও ‘আ স্ট্রিটকার নেমড ডিজায়ার’-এর জন্য সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কারটি পেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে হলিউডের চলচ্চিত্র ইতিহাস তাঁকে জায়গা দেবে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে। রূপ আর গুণ— দুটিই যেন অস্ত্র হয়ে উঠেছিল ভিভিয়েনের। আর এ হেন কিংবদন্তির যাত্রার সঙ্গে জড়িয়েছিল এই দেশও। এখানেই, এই দার্জিলিংয়েই যে বেড়ে উঠেছিলেন ভিভিয়েন লেই! 

১৯১২ সাল। লন্ডনের কেনসিংটনে চার হাত এক হল আর্নেস্ট রিচার্ড হার্টলে এবং গারট্রুড মেরি ফ্রান্সেসের। গারট্রুডের শিকড় আগে থেকেই জুড়েছিল ভারতে। তাঁর বাবা ছিলেন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান; আর মায়ের পরিবার সিপাহী বিদ্রোহের কোপে পড়েছিল। বিয়ের পর দুজনেই চলে আসেন কলকাতায়। ধীরে ধীরে শহরে নেমে আসে গ্রীষ্মকাল। এমন গরমে সাহেব-মেমদের যে টেঁকা দায়! ততদিনে গ্রীষ্মের হাত থেকে বাঁচার জন্য হাজির হয়েছে দার্জিলিংও। সেখানেই চলে গেলেন হার্টলে দম্পতি। 

১৯১৩ সালের নভেম্বর মাস। একটু একটু করে শীতের ছোঁয়া পড়ছে ভারতে। আর দার্জিলিংয়ের মতো পর্বতঘেরা জায়গায় তো শীত নিজের সমস্ত রূপ নিয়ে হাজির হয়। তখন এত দূষণেরও বাড়বাড়ন্ত ছিল না। ফলে প্রকৃতির আমেজটা সম্পূর্ণ নেওয়া যেত। এমন প্রেক্ষাপটেই দার্জিলিংয়ের শ্যানন লজে জন্ম নিল ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। আর্নেস্ট-গারট্রুড সন্তানের নাম রাখলেন ভিভিয়েন— ভিভিয়েন মেরি হার্টলে। 

অবশ্য বেশি সময় সেখানে থাকেননি তাঁরা। ভিভিয়েনের যখন মাত্র পাঁচ বছর বয়স, তখনই ছোট্ট সন্তানকে নিয়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন গারট্রুড। তার আগে সামান্য কিছু সময়ের জন্য দার্জিলিংয়ের লোরেটো কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি হন ভিভিয়েন। সেই ছোটো বয়সে ছেড়ে চলে গেলেও, দার্জিলিংয়ের সেই ছবি মনের কোণে ধরে রেখেছিলেন এই কিংবদন্তি অভিনেত্রী। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে ছোটোবেলার প্রসঙ্গ। আর প্রতিবারই দার্জিলিং সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভিভিয়েন লেই বলেছেন, ‘পৃথিবীর সবথেকে রোম্যান্টিক জায়গা।’ খানকার পরিবেশ, প্রকৃতি, জীবনের স্রোত সব যেন ছবির মতো সামনে এসে ধরা দিত। ভারতের সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ না থাকলেও, নিজের জন্মস্থানকে কখনও ভোলেননি তিনি। 

মানুষও ভোলেনি ভিভিয়েনকে। শুধুমাত্র ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’-এর জন্যই আপামর সিনেপ্রেমীদের ভেতরে থেকে যাবেন তিনি। তুখোড় অভিনয় তো বটেই; সেইসঙ্গে ভিভিয়েনের সঙ্গী ছিল তাঁর অসামান্য রূপ। বলা হয়, অনেক সময় চরিত্র স্বয়ং এসে অভিনেতার কাছে ধরা দেয়। স্কারলেট ও’হারার চরিত্রটির ক্ষেত্রেও তাইই হয়েছিল। ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ উপন্যাস হিসেবে পড়ার পরই স্কারলেটের প্রতি আকৃষ্ট হন ভিভিয়েন। মনেপ্রাণে চাইছিলেন এই চরিত্রে অভিনয় করতে। আর ভাগ্যের কি অদ্ভুত খেলা! ঘুরেফিরে তাঁর কাছেই এসে থামে চরিত্রটি। বাকিটা ইতিহাস… 

আরও পড়ুন
'সূর্যোদয়' দেখতে চেয়েছিলেন নিবেদিতা, মৃত্যুর পর শুধু অবহেলাই দিল দার্জিলিং!

শুধু পর্দাতেই নয়; ভিভিয়েন ছিলেন মঞ্চেরও রানি। শেক্সপীয়রের একের পর এক নাটকে অভিনয় করেছেন তিনি। সঙ্গে দোসর হিসেবে পেয়েছেন নিজের স্বামী, আরেক কিংবদন্তি স্যার লরেন্স অলিভিয়ারকে। দিব্যি চলছিল সব। কিন্তু জীবনের জাহাজটা শান্ত সমুদ্রে ছিল না। একের পর এক ঝড়ঝাপটা নেমে এসেছে জীবনে। অলিভিয়ারের সঙ্গে আজীবন ঘনিষ্ঠ ও ভালোবাসার সম্পর্ক থাকলেও, একটা সময় দুজনের বিচ্ছেদ হয়। জীবনে আসে আরেক পুরুষ। কিন্তু তার থেকেও বেশি আঘাত হানে শরীর। চল্লিশের দশকেই যক্ষ্মায় জর্জরিত হয়ে পড়েন ভিভিয়েন লেই। এখনকার মতো আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা তখন ছিল না। একটু একটু করে শরীরও শেষ হতে থাকে। তখনও যৌবন যায়নি তাঁর। 

সবকিছু নিয়েই চলতে থাকে অভিনয়। দেশ বিদেশ ঘুরে নাটক করেন। ইতিমধ্যে ১৯৫১ সালে আরও একবার অস্কার পান তিনি। এছাড়াও বহু আন্তর্জাতিক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন ভিভিয়েন। উল্টোদিকে, যক্ষ্মা ক্রমশ চেপে ধরছে তাঁকে। ব্যক্তিগত জীবনের ঝড় মানসিক দিক থেকেও ভেঙে দিয়েছে ভিভিয়েনকে। সবকিছু নিয়েও চালিয়ে যেতে লাগলেন অভিনয়। মৃত্যুর দুবছর আগেও মুক্তি পেয়েছে তাঁর ছবি ‘শিপ অফ ফুলস’। কিন্তু ততদিনে বয়স যেন ঘা মেরেছে শরীরে। 

১৯৬৭ সাল। কতই বা বয়স হবে ভিভিয়েন লেইয়ের? মাত্র ৫৩ বছর। কিন্তু ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে গিয়েছিল শরীরটা। যক্ষ্মার কামড় তখন সর্বোচ্চ পর্যায়। লন্ডনেই নিজের বেডরুমে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ব্রিটিশ ও হলিউড সিনেমার অন্যতম কিংবদন্তি ভিভিয়েন লেই। তখনও তাঁর সৌন্দর্য ফিকে হয়নি এতটুকুও। শেষ মুহূর্তে কি মনে পড়েছিল দার্জিলিংয়ের সেই সুন্দর বাগান? কাঞ্চনজঙ্ঘার সূর্যোদয়? হয়তো সেসব কল্পনা করতে করতেই মৃত্যুকে আহ্বান করেছিলেন ভিভিয়েন।

আরও পড়ুন
বৃষ্টি থেকে রক্ষার নামে বদলে গেল গ্লেনারিসের চেহারা, ক্ষুব্ধ দার্জিলিংপ্রেমীরা

Powered by Froala Editor

More From Author See More