দার্জিলিংয়ের একটি ছোট্ট পাহাড়ি জায়গা মুর্দাহাটি। দাঁড়িয়ে থাকলে, শান্ত পরিবেশের ভেতর দিয়ে উঁকি মারে টয়ট্রেন। স্থানীয়দের কাছে মুর্দাহাটির আরও একটি পরিচয় আছে— দার্জিলিংয়ের শ্মশান। ভেতরে ঢুকলেই, নজর কাড়বে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি সাদা সমাধি। একা, নির্জন; আশেপাশে আর কেউ নেই। খানিক এগিয়ে গেলে দেখা যাবে, সমাধির ভেতরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছেন। কাচের আড়াল থেকেও যাকে চিনে নেওয়া যায় ঠিক। দার্জিলিংয়ের মুর্দাহাটির ভেতরে, এই শ্মশানেই যে পার্থিব যাত্রা শেষ হয়েছিল ভগিনী নিবেদিতা। নিজের জন্মস্থান থেকে বহু বহু দূরে, একাকী…
১৮৯৫ সালের নভেম্বর মাস। তখনও ইংল্যান্ডে একজন সাধারণ শিক্ষিকা হিসেবেই পরিচিতি মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের। ওয়েস্ট এন্ডের একজন পরিচিতের বাড়ি গিয়েছেন তিনি। কয়েকদিন আগেই বিশ্ব ধর্মসম্মেলন হয়ে গেছে শিকাগোতে। সেখানে সবাইকে মোহিত করে রেখেছিলেন গেরুয়া পরিহিত এক ভারতীয় সাধু। তিনিই নাকি এই বাড়িতে আসবেন। সেই প্রথম মুখোমুখি হন মার্গারেট নোবেল এবং স্বামী বিবেকানন্দ। জীবন তখন দোলাচলে; কোথাও স্থির হতে পারছেন না। বিবেকানন্দের কথা, ভারতবর্ষের কথা যেন ভেতরে ঢেউ নিয়ে এল। নিজেকে চিনতে পারলেন না মার্গারেট। ভেসে চলেছেন সেই অপার ঢেউয়ে। আর ভাসতে ভাসতে চলে এলেন ভারতবর্ষে, কলকাতায়…
ধীরে ধীরে যেন ফুটে উঠল ফুল। মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেলের খোলস থেকে জন্ম নিলেন ভগিনী নিবেদিতা। স্বয়ং স্বামীজির ভাবশিষ্যা। শুধু কি কলকাতাতেই আটকে ছিলেন তিনি? বাগবাজারের ১৬ নং বোসপাড়া লেনই কি ছিল একমাত্র আশ্রয়? তা তো নয়! তাঁর কাজ তখন ছড়িয়ে পড়েছে গোটা বাংলায়। নিজের শিক্ষকসত্তাকে জাগিয়ে তৈরি করেছেন নিজের স্কুল। তবে কলকাতার গণ্ডি ছাড়িয়ে তিনি চলে গিয়েছিলেন আরও উঁচুতে। পৌঁছে গিয়েছিলেন শৈলশহর দার্জিলিংয়ে। ধীরে ধীরে সেই শহরই জায়গা করে নিল মনের কোণে। নিবেদিতার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কখন যে দার্জিলিংও জড়িয়ে পড়ল, বোঝাই গেল না।
মোট সাতবার দার্জিলিংয়ে গেছেন ভগিনী নিবেদিতা। যতবারই গেছেন, নতুন করে দেখেছেন পাহাড়ের রানিকে। ১৮৯৮ সাল। স্বামী বিবেকানন্দ চলে গেছেন দার্জিলিং। ঠিক হল, মিস মুলারের সঙ্গে নিবেদিতাও যাবেন গুরুর কাছে। শেষ মুহূর্তে আর যাওয়া হল না তাঁর। স্বয়ং স্বামীজিই বারণ করে দিলেন আসতে। এর কয়েক বছর পর, ১৯০৩ সালে আবারও সুযোগ এল যাওয়ার। এই প্রথমবার নিবেদিতার পা পড়ল দার্জিলিংয়ে। আফসোস, এবার আর সঙ্গে পেলেন না স্বামীজিকে। এক বছর আগে, চিরকালের মতো ধরাধাম ত্যাগ করেছেন তিনি…
ঘুম স্টেশনের কাছেই অ্যাসাইলিন ভিলা। সেখানেই প্রথমবার গিয়ে আশ্রয় নিলেন ভগিনী। সঙ্গে ছিলেন প্রিয় দুই মানুষ - জগদীশচন্দ্র বসু ও তাঁর স্ত্রী অবলা বসু। এরপরে আরও বেশ কয়েকবার এসেছেন এখানে। বেশিরভাগ সময়ই তাঁর সঙ্গী হতেন জগদীশ ও অবলা। কখনও নিজের বইয়ের পাণ্ডুলিপির কাজ করছেন, কখনও আবার জগদীশ বসুর গবেষণাপত্র তৈরির ব্যাপারে সাহায্য করছেন। আর সেইসঙ্গে চলছে স্কুলের চিন্তা। সেখানকার মেয়েদের নিয়ে নানা ভাবনা। ওরা যাতে আরও এগোয়, আরও নানা জায়গা থেকে মেয়েরা উঠে আসে, তাই ভেবে যেতেন সবসময়। মনে মনে প্রার্থনাও করতেন…
সেই কবে থেকে পরিশ্রম করে চলেছেন তিনি। শরীরের দিকে নজরই দেওয়া হয়নি। আর কতই বা ধকল নিতে পারবে? একসময় শরীরও আঘাত দিতে শুরু করল। ১৯০৫ সাল। কলকাতাতে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়লেন নিবেদিতা। ডাক্তার নীলরতন সরকার বললেন, ব্রেন ফিভার। সম্পূর্ণ সুস্থতার জন্য একটু হাওয়া বদলের প্রয়োজন। আবারও দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন নিবেদিতা। সঙ্গে জগদীশ, অবলা ও বোন ক্রিস্টিন। এখন আশ্রয়স্থল চলে গেছে লেবং কার্ট রোডের রায় ভিলায়। শেষদিন পর্যন্ত এই বাড়িটিই নিবেদিতার দার্জিলিংয়ের আবাসস্থল ছিল…
আরও পড়ুন
অষ্টমীর বেলুড় মঠ; ‘জ্যান্ত দুর্গা’ সারদামনির পুজো করলেন বিবেকানন্দ
ভারতের পরিস্থিতিও সেসময় সুখকর ছিল না। স্বাধীনতা আন্দোলনের আগুন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। ইতিমধ্যেই জন্ম নিয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের কোপ পড়ল অবিভক্ত বাংলার ওপর। বিদেশিনী হলেও, এই সিদ্ধান্ত মানতে পারেননি ভগিনী নিবেদিতাও। অবশ্য তখন তাঁকে বিদেশিনী বলিই বা কি করে! শুধু সমাজ সংস্কারই তো নয়; ভারতের স্বাধীনতা, ভারতীয়দের স্বাধীনতার জন্যও লড়ে গেছেন তিনি। এই সূত্রেই আলাপ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে, অকুস্থল সেই দার্জিলিংই। পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতেই একদিন দেখা দেশবন্ধুর সঙ্গে। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর হাতের গোলাপফুলটি গুঁজে দিলেন দেশবন্ধুর কোটের বোতামে। ব্যস, বন্ধুত্বের বৃত্ত সম্পূর্ণ হল…
কাজের মধ্যে থাকতে থাকতে ভুলেই গিয়েছিলেন শরীরের কথা। ব্রেন ফিভারের পর যথেষ্ট দুর্বল তিনি। তারপরেও থেমে নেই নিবেদিতা। কলকাতা তো বটেই, দার্জিলিংয়েও যখন যাচ্ছেন কাজ করে যাচ্ছেন আপন মনে। সঙ্গে বসু দম্পতি ও অন্যান্য বন্ধুরা থাকলে কী হবে? মনের দিক থেকে কি তিনি সম্পূর্ণ একা? এক এক করে সবাই চলে যাচ্ছেন। ১৯০৯ সালে আমেরিকা থেকে খবর এল, স্বামীজির স্নেহধন্য মিসেস বুল গুরুতর অসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে দার্জিলিং থেকেই রওনা দিলেন তাঁকে দেখতে। খেয়ালই করলেন না, তাঁর নিজের শরীরও খুব একটা ভালো নয়। যখন ফিরলেন, তখন আবার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অতঃপর, আবারও যাত্রা দার্জিলিং। কে জানত, সেটাই হবে শেষ যাত্রা…
১৯১১ সাল। দার্জিলিংয়ের রায় ভিলায় বসে জগদীশচন্দ্র বসু ঠিক করলেন, একবার সিকিম বেড়াতে যাবেন। সেখানকার বৌদ্ধ সংস্কৃতি, মঠ দেখবেন। এমন কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে পড়লেন ভগিনী নিবেদিতাও। তিনি নিজেও যে যেতে চান! অমন পবিত্র পরিবেশে একটু মন না রাখলে হয়! সমস্ত কিছু ঠিক করা হল। যাত্রাও শুরু হবে; এমন সময় দুঃসংবাদ। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নিবেদিতা। সঙ্গে সঙ্গে চলে এলেন ডাক্তার নীলরতন সরকার। নিবেদিতার শারীরিক অবস্থা পরীক্ষা করেই বুঝলেন, গতিক ভালো নয়। যে কোনো সময় ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা। জগদীশ আর অবলা মিলে দিনরাত সেবা করতে লাগলেন তাঁর। আর নিবেদিতা? মৃত্যুর শব্দ ততক্ষণে শুনতে পেয়ে গেছেন তিনি। এক অদ্ভুত আলো দেখতে পাচ্ছেন। দার্জিলিংয়ের বিশাল পাহাড়ের কোল জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে সেই আলো। সেটাই দেখতে চান নিবেদিতা। ‘দ্য বোট ইজ সিঙ্কিং, বাট আই শ্যাল সি দ্য সান রাইজ’… ১৩ অক্টোবর, ১৯১১। রায় ভিলার ঘরেই শেষে তরী ডুবল ভগিনী নিবেদিতার…
আরও পড়ুন
এসেছেন রবীন্দ্রনাথ-বিবেকানন্দও, বাগবাজারে নিবেদিতার বাড়ি বদলে গেল মিউজিয়ামে
এর পরের গল্পটি ক্রমশ একা হয়ে যাওয়ার। খ্রিস্টান হলেও, নিবেদিতার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর দেহ সমাহিত করা হয়নি; সনাতন হিন্দু রীতি মেনে দাহ করা হয়েছিল মুর্দাহাটির শ্মশানে। তারপর তাঁর চিতাভস্মের একটি অংশ দিয়েই তৈরি হয় সমাধিক্ষেত্র। বহু বছর অবহেলার মধ্যে পড়েছিল সেই জায়গাটি। জন্মস্থান থেকে বহু দূরে, একা নির্জন হয়ে কেটেছিল অনেকটা সময়। এমনকি, ভগিনীর শেষ ঠিকানা রায় ভিলাও অনেক হাত ঘুরেছে। অনেক স্মৃতি নষ্টও হয়েছে। তবে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় ছিল সমাধি ক্ষেত্রটি। হায় রে ইতিহাস! এভাবেই কত জিনিস হেলায় হারিয়ে ফেলি আমরা। স্বয়ং ভগিনী নিবেদিতাও রেহাই পেলেন না সেই জাঁতাকল থেকে। তবে কয়েক বছর আগে পরিস্থিতির কিছু বদল হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগেই হাল ফিরেছে লেবং কার্ট রোডের সেই রায় ভিলার। আজ তার পরিচয় ‘রামকৃষ্ণ মিশন নিবেদিতা শিক্ষা ও সংস্কৃতি কেন্দ্র’ হিসেবে। এবং এই বছরই মুর্দাহাটির সমাধি ক্ষেত্রটিও চেহারা ফিরে পেয়েছে। যতটা সম্ভব যত্নে রাখা যায় ভগিনীর শেষ স্মৃতি। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা সেই সূর্যোদয়ই বোধহয় এখনও দেখে চলেছেন তিনি…
তথ্যসূত্র-
১) ‘অবহেলায় পড়ে নিবেদিতার সমাধি’, সৌমিত্র কুণ্ডু, আনন্দবাজার পত্রিকা
২) ‘দার্জিলিঙে হাল ফিরল নিবেদিতার সমাধি ক্ষেত্রের’, নিউজ ১৮ বাংলা
৩) ‘শিক্ষয়িত্রী এবং তাঁর প্রিয় দার্জিলিং’, রিফাৎ আহমেদ, স্টে কিউরিয়াস বাংলা
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
জগদীশচন্দ্রের লেখালিখির সম্পাদিকা, বসু বিজ্ঞান মন্দির গড়তেও সাহায্য করেছিলেন নিবেদিতা