১৮৯৮ সালের কথা। দিনটি ছিল ৩০শে মার্চ। তখন সবে দু-তিন মাস হল এদেশে এসেছেন ওঁরা। আয়ারল্যান্ড থেকে মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল(১৮৬৭-১৯১১)। তখন একত্রিশ। আর অন্যজন হলেন আমেরিকা-র সারা চ্যাপম্যান বুল। বয়স সাতচল্লিশ। বর্তমান লেখাটির উপজীব্য মার্গারেট এলিজাবেথ নোবলকে নিয়ে, যিনি সকলের কাছে পরিচিত ভগিনী নিবেদিতা হিসেবে। বস্তুত এই লেখা একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকার এবং সেই প্রেক্ষাপটকে কেন্দ্র করে একটি ঐতিহাসিক সময়ের কিছু দলিল। এই সাক্ষাৎকার একজন স্বনামধন্য ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানীর সঙ্গে দুজন মধ্যবয়সী শ্বেতাঙ্গ নারীর। যাদের একজন মার্গারেট নোবেল অন্যজন সারা বুল। উল্লেখ্য যে দুজন নারীর কেউই বিজ্ঞানের জগতের ছিলেন না। আর সেই পদার্থবিজ্ঞানী আর কেউ নন স্বয়ং জগদীশচন্দ্র বসু।
ভাবতে অবাক লাগে, বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা করেননি অথচ সে সময়ের মেধাবী এবং বন্দিত একজন গবেষক বিজ্ঞানীর সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হচ্ছেন তাঁরা। তাও আবার বিদেশ ত্থেকে এসেছেন। তাহলে কি ওঁরা দুজন ভারতীয় বিজ্ঞানী সম্পর্কে আগে থেকে শুনেছিলেন?
যখন আমার বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বে অনেকে সন্দিহান ছিলেন তখনও দুই-এক জনের বিশ্বাস আমাকে বেষ্টন করিয়া রাখিয়া ছিল।
প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে তাঁরা দেখা করতে এসেছেন। এর আগে সম্ভবত শুনেছেন পরাধীন ভারতবর্ষের একজন বিজ্ঞানী প্রফেসর বোসের উদ্ভাবনার কথা। শুনেছেন বেতার সংকেত আদান প্রদানের বিশেষ প্রযুক্তি এবং পরীক্ষানিরীক্ষার কথা। শুনেছেন বলেই তাঁদের আন্তরিক ইচ্ছা সেই প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে একবার চাক্ষুষ দেখার। সামনাসামনি দুটো কথা বলে ধন্য হওয়া।
অবশেষে দেখা হল। মার্গারেট আর সারা বুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। সামনে যিনি বসে আছেন, তিনিই বেতার সংকেত প্রেরক ও গ্রাহক যন্ত্রের স্রষ্টা। বেতার বিজ্ঞানের পথিকৃৎ! এই ছোট্ট ঘরে বসেই তিনি আধুনিক পদার্থবিদ্যার মৌলিক গবেষণা করে যাচ্ছেন। এত অনাড়ম্বর আর সাদামাটা আয়োজন অথচ এর মধ্যেই সর্বাধুনিক বিজ্ঞান তপস্যায় নিয়োজিত রয়েছেন জগদীশচন্দ্র!। তবে তখন বেতার তরঙ্গ নিয়ে নয়, অন্য অনুসন্ধানে বিভোর হয়ে রয়েছেন। জগদীশের দু-চোখে তখন অন্য এক জগতের খোঁজ।
জগদীশ তখন জীবনের মতন জড় পদার্থের মধ্যেও খুঁজে পাচ্ছেন উত্তেজনায় সাড়া দেওয়া কিংবা ক্লান্তি বোধ – এই সব প্রাণের অনিবার্য লক্ষণ! অপ্রাণ জড় পদার্থ এবং উদ্ভিদের মধ্যে জেগে ওঠা অনুভব আর সংবেদনের সুর শুনতে পাচ্ছেন। সেদিন জগদীশ তাঁর সেই নতুন পর্যবেক্ষণের কথা দুজন নতুন অতিথিকে বলছেন। অবাক বিস্ময়ে শুনছেন সারা বুল আর মার্গারেট বিজ্ঞান সাধকের কথা! জীব নয়, জড় নয়, এ যেন অন্য এক তৃতীয় ভুবন! যে ভুবনে অপ্রাণেও ধ্বণিত হয় প্রাণের স্পন্দন!
জগদীশের গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ এবং পুস্তক রচনায় প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিলেন নিবেদিতা।
এ শুধু নিছক সাক্ষাৎকার নয়। এর বিস্তার যে কী বিশাল, তা বোঝা যায় পরবর্তী সময়ে তাঁদের সহযোগের অজস্র স্বাক্ষরগুলি থেকে। প্রাথমিক আলাপের সেই মুগ্ধতা কালক্রমে জীবনব্যাপী নিবিড় বন্ধুত্বের রূপ পায়। যে সম্পর্কের বুননে জড়িয়ে শুধু জগদীশচন্দ্রই নয়, জগদীশের স্ত্রী অবলা দেবীও। এমনকি জগদীশের পরবর্তী গবেষণার বিভিন্ন ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন নিবেদিতা। ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক বন্ধুত্ব ছাড়িয়ে পরাধীন ভারতবর্ষের বিজ্ঞান চর্চা চালিয়ে যাওয়ার প্রতিকূলতা অতিক্রমের ক্ষেত্রে নিবেদিতা ও সারা বুল বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। শুধু বিজ্ঞানচর্চায় উৎসাহ ও সাহায্য করা ছাড়াও সারা বুল ও নিবেদিতার আগ্রহ এবং সাহায্যে জগদীশচন্দ্র পেটেন্ট অর্জন করতে সক্ষম হন। এসবের সাক্ষ্য নিবেদিতার জীবনীকারদের লেখাতে পাই। এরই পাশাপাশি জগদীশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রশাসনের অসহযোগিতার বিরুদ্ধে জগদীশের পাশে দাঁড়িয়ে নিবেদিতা মদত দিয়েছেন একাধিকবার।
জগদীশের দ্বিতীয় পর্যায়ের গবেষণার কাজগুলি প্রকাশের ক্ষেত্রে জগদীশ একটু দোলাচলে ভুগছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন, তাঁর ওই সাম্প্রতিক কাজ শারীরতত্ত্ববিদ বা পদার্থবিদদের বোঝানো কী বিপুল কঠিন! এখানেও এগিয়ে আসেন নিবেদিতা। যাতে দেরি না হয় সে ব্যাপারেও নিবেদিতা ছিলেন তৎপর। ওই জটিল বিজ্ঞানভাবনাকে লিখিত রূপ দেওয়া একজন বিজ্ঞান শাস্ত্র না-জানা লেখকের পক্ষে যে কতটা কঠিন কাজ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবু আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে আশ্চর্যজনক ভাবে সফল হলেন নিবেদিতা।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। নিবেদিতার শক্তিশালী ও মেধাবী লেখনী জগদীশচন্দ্রের রচনা প্রস্তুতিতে দারুণ সাহায্য করেছিল, এসব কথার উল্লেখ খুব বেশি নেই। এমনকি জগদীশচন্দ্রের স্বীকৃতি উল্লেখেও নিবেদিতার অবদানের কথা স্থান পায়নি। নাকি নিবেদিতাই নিজেকে আড়ালে রেখেছিলেন? এ জিজ্ঞাসার উত্তর নিবেদিতা গবেষকরাই ভালো দিতে পারবেন।
কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষের জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে নিবেদিতার যে কী বিশাল ভূমিকা ছিল সেই দিকটি আজও অনেকের কাছে অজানা অধ্যায়। শিল্পী লেখক শিক্ষাবিদ সমাজসেবী স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষজনের সঙ্গে নিবেদিতার সংযোগ ও আদানপ্রদানকে স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বাভাবিক বলে মনে হলেও জগদীশচন্দ্র বসু, যিনি অগ্রগামী বিজ্ঞান গবেষণার সঙ্গে যুক্ত, তাঁর সঙ্গে কী ভাবে সম্পর্কের ওইরকম নিবিড় বন্ধন গড়ে উঠেছিল নিবেদিতার, সে কথা ভাবলে আশ্চর্য লাগে।
জগদীশচন্দ্রের এইসব পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষানিরীক্ষার কথাগুলিই ১৯০২ থেকে ১৯০৭ এর মধ্যে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হবে। সেই ভুবনবিখ্যাত গবেষণাগ্রন্থগুলি Living and Non Living , Plant Response, Comparative Electro-physiology, কিংবা Irritability of Plants. এছাড়াও আরও বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলি পরে ধারাবাহিকভাবে রয়্যাল সোসাইটির পত্রিকাতেও প্রকাশিত হয়েছে। যে কথাটা বলা জরুরি তা হল, এই সমস্ত গবেষণাধর্মী লেখালেখির কাজগুলি সম্পাদনা করেন নিবেদিতা। শুধু সম্পাদনা বললে কিছুই বলা হয় না। ভাষার ওপর অসম্ভব ভালো দক্ষতা ছিল নিবেদিতার। জগদীশের ওইসব গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ এবং পুস্তক রচনায় প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিলেন নিবেদিতা।
বহু বছর ধরে একটি বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন লালন করে আসছিলেন জগদীশচন্দ্র। কিন্তু কাজ রূপায়িত করা যে কী দুঃসাধ্য সে সম্পর্কে জগদীশচন্দ্র ভালো করেই বুঝতেন। এ-কাজে আর্থিক সংস্থান করার জন্যে নিবেদিতা এবং সারা বুলের ভূমিকার কথা আজ অনেকেরই জনা। সারা বুল দুটি পর্যায়ে চল্লিশ হাজার ডলার উইল করে গেছিলেন জগদীশের গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্যে। এর পেছনেও দারুণ ভূমিকা নিয়েছিলেন নিবেদিতা। এভাবেই তৈরি হল জগদীশচন্দ্রের স্বপ্নের ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’। ৩০শে নভেম্বর ১৯১৭। সারা বুল এবং নিবেদিতা দুজনেই প্রয়াত হয়েছেন তখন। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে নিবেদিতা প্রয়াত হন।
বিজ্ঞান মন্দিরে ঢোকার মুখে ফোয়ারার ধারে জপমালা হাতে এক নারীর রিলিফ মূর্তি চোখে পড়ে
বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে জগদীশের ভাষণে নিবেদিতা ও সারা বুলের প্রসঙ্গ এসেছে ঠিকই। তবে জগদীশচন্দ্র কোথাও তাঁদের কোনো নাম উল্লেখ না করে বলেন – ‘যখন আমার বৈজ্ঞানিক কৃতিত্বে অনেকে সন্দিহান ছিলেন তখনও দুই-এক জনের বিশ্বাস আমাকে বেষ্টন করিয়া রাখিয়া ছিল। আজ তাহাঁরা মৃত্যুর পরপারে।’
জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে নিবেদিতার কয়েকটি অনুল্লেখিত উপস্থিতির কথাও বলা দরকার। বিজ্ঞান মন্দিরে ঢোকার মুখে ফোয়ারার ধারে জপমালা হাতে এক নারীর রিলিফ মূর্তি চোখে পড়ে। যদিও কোথাও তাঁর পরিচয় লেখা নেই। তবু এই মূর্তির সঙ্গে নিবেদিতার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এছাড়া, বিজ্ঞান মন্দিরের দরজায় অলংকরণ এবং চূড়ায় বজ্রচিহ্ন। নিবেদিতার পছন্দের ছিল এই বজ্রচিহ্ন। যদিও কোথাও নাম খোদাই করা নেই, তবু বিজ্ঞান-মন্দিরের সব খানেই নিবেদিতার নিরুচ্চার উপস্থিতি।
গত বছরই পেরিয়ে এসেছি আমরা নিবেদিতার সার্ধশতবর্ষ। নিবেদিতা শুধু জগদীশ্চন্দ্রের গুণগ্রাহীই ছিলেন না, তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রেও এই প্রতিভাময়ী নারীর গভীর ও প্রত্যক্ষ অবদান ছিল। এই সম্পর্কের কথা আরও যত স্পষ্ট হয়ে উঠবে, উন্মোচিত হয়ে উঠবে এই অভূতপূর্ব সম্পর্কের বৈভব ততই উজ্জ্বল হয়ে উঠবে এই স্বল্পালোকিত বিজ্ঞান ইতিহাস।