যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতার ‘অগভীর’ দুঃখবাদের সন্ধানে

বাংলা সাহিত্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের (Jatindranath Sengupta) একমাত্র পরিচয় ‘দুঃখবাদী কবি’ হিসেবে। এই আখ্যায় সারবত্তা আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু একই সঙ্গে খানিকটা একপেশে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাঁর কাব্যগ্রন্থে জীবন ও সমাজ সম্বন্ধে হতাশার ছড়াছড়ি। আনন্দ, স্বপ্ন, আশা, প্রেম— এই শব্দগুলি যেন তাঁর কবিতার অভিধানে নেই। যন্ত্রণাই একমাত্র সত্য, প্রেম তো আসলে একটা বিরাট ফাঁকি। জীবন একটা নারকীয় অভিজ্ঞতা। কিছুটা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তোলা বটে। কিন্তু প্রয়োজন ছিল সেটুকুর। কবিসত্তার দাবি না থাকলেও, সময় তাঁর থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে এই বক্তব্য। আর সেখানেই প্রশ্ন ওঠে এই ‘দুঃখবাদী’ পরিচয় নিয়ে।

একবার সময়টা ছুঁয়ে আসা যাক। বিশ শতকের দুই ও তিনের দশক। বাংলা কবিতার আকাশে তখন একজনই রবি। তাঁর আলোর ছটায় প্রায় মুছে গেছে কালিদাস রায়, যতীন্দ্রমোহন বাগচী কিংবা কুমুদরঞ্জন মল্লিকের প্রতিভা। আসলে, তাঁদের কবিতাও বড়ো বেশি করে ‘রবীন্দ্রনাথের মতো’। পরে বুদ্ধদেব বসু ‘রবীন্দ্রনাথ ও উত্তরসাধক’ প্রবন্ধটিতে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করেছেন তাঁদের সমস্যাগুলি। ‘রবীন্দ্রানুসারী কবি’ হতে গিয়ে রবীন্দ্র-সমুদ্রেই ডুবে গেছেন তাঁরা। একমাত্র ‘ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহাহুঙ্কার’ তুলে টর্পেডোর মতো ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাজী নজরুল। ওরকম অশান্ত আবেগ বাংলা কবিতায় দেখা যায়নি আগে। কারোর বলার সাহস হয়নি ‘লাথি মার ভাঙরে তালা’। সত্যেন্দ্রনাথ বসুও ‘ছন্দের জাদুকর’ পরিচয়ের বাইরে নিজের পথে বহুদূর হেঁটেছেন বলা যাবে না।

অথচ, সময় কী দাবি করছে? প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, দেশজোড়া আর্থিক সংকট। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগুন জ্বলছে তীব্রভাবে। তিন-চারের দশকের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার ঠিক আগের ধাপে দাঁড়িয়ে আছে বাঙালি। তবুও শেষ আশ্রয় রবীন্দ্রনাথের আস্তিক্য-দর্শন, সত্য-শিব-সুন্দরের বাণী। ‘কল্লোল’, ‘কালিকলম’ পত্রিকার অর্থনৈতিক জীবনজিজ্ঞাসা ও দেহচেতনা সবে বেড়ে উঠছে সঙ্গোপনে। সেই দিনের বাংলা কবিতায় যদি সত্যিই ভিন্নস্বরের সন্ধান করতে হয়, তবে তাকাতে হবে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত ও মোহিতলাল মজুমদারের দিকে। তাঁদের ‘প্রতিবাদ’-এর পরীক্ষানিরীক্ষা কিন্তু রাস্তা প্রশস্ত করে দিয়েছিল জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তীদের।

বুদ্ধদেব বসুর মতে যতীন্দ্রনাথের কবিতা ‘অগভীর’, তবে একই সঙ্গে ‘ব্যবহারযোগ্য বিধর্মিতা’। ‘অগভীর’-এর প্রসঙ্গে পরে আসা যাবে, আগে দেখা যাক তার ‘বিধর্মিতা’। অন্তত, পরবর্তী কবিদের দৃষ্টিতে। যতীন্দ্রনাথের কবিতার সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য নির্মোহ দৃষ্টি। জগতে যা ঘটছে, তাতে ঐশ্বরিক শক্তির কোনো হাত নেই, দৈবলীলা বলে কিছু হয় না। ঈশ্বর আসলে ‘স্বেচ্ছাচারী’। রোমান্টিকতার আবেগের চশমা খুলেই তিনি দেখেছেন বাংলা কবিতাকে। হয়তো পেশায় ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন বলেই জীবনের কাঠিন্যের তীব্র শব্দ পাওয়া যায় তাঁর লেখায়। তাই হাতুড়ির আঘাতে অনুভব করেন ‘লোহার ব্যথা’। কিংবা ধরা যাক ‘ভক্তির ভারে’ কবিতা,
“প্রেমমন্দিরে তাহারই বিপদ—যে-জন দাঁড়াবে সোজা,
শিরদাঁড়াভাঙা যত কোলকুঁজো ঘাড়-গুঁজোদেরই মজা।”

আরও পড়ুন
রাখি পরালেই দিতে হবে টাকা, কবি মহাদেবী বর্মার কাছে আবদার আরেক কবির

রবীন্দ্রনাথের প্রেম-পূজা থেকে শতহস্ত দূরে এই উচ্চারণ। কবিতা এখানে ‘সংস্কারবর্জিত’। আবেগের বদলে বুদ্ধি দিয়ে চিনতে তাকে। স্বভাবকবি কথাটা ভাঁওতামাত্র। যারা এসব বলে তারা আসলে, ‘ছবি ও ছন্দে দালালি’ করে। তাই কবিতার একমাত্র বিষয় নিরাশা আর মৃত্যুর অনিবার্য ভবিষ্যত। দুঃখই প্রাপ্তি, তার থেকে মুক্তি নেই। শব্দচয়ন কিংবা রচনাভঙ্গিতেও পাওয়া গেল পথচলতি শব্দের রেশ, “মরণেরই দমে জীবনের ঘড়ি টিক্‌ টিক্‌ ঠিক্‌ ঠাক্‌”। উদাহরণ আরো বাড়িয়ে তোলা যায়, তবে সর্বত্রই এক চেহারা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মরীচিকা’-তেই (১৯২৩) যার সূত্রপাত। ‘মরুশিখা’, ‘মরুমায়া’, ‘সায়ম’, ‘ত্রিযামা’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থের নামই তাঁর কবিদৃষ্টির যথেষ্ট প্রমাণ। 

আরও পড়ুন
অনূদিত হোক কবিতার আত্মা : জয় গোস্বামী

এবার আসা যাক ‘অগভীর’-এর কথায়। অবশ্যই তাঁর দুঃখবাদে অভিনব কিছু নেই। ইংরেজ কবি জন ডানের সঙ্গে মিল পাওয়াও অসম্ভব কিছু নয়। তবে মূল সমস্যা রয়ে গেছে দুঃখবাদের নেশায়। যে কারণের জীবনের ছোটো ছোটো বিষয়কেও হতাশার মাপকাঠিতে মাপেন। প্রশ্ন উঠতে পারে যার স্বাভাবিকত্ব নিয়েও। কখনও-বা আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য বশবর্তী হয়ে যান অতিরেকের। আবার, ঈশ্বরকে নিয়ে হাজার প্রশ্ন করা মানে তো এক অর্থে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেওয়া। স্ববিরোধ নয় কি? পরে অবশ্য ‘সায়ম’, ‘ত্রিযামা’-তে শান্ত ভোরের আঁকড়ে ধরেছেন প্রেমচেতনাকেই। ফলে ‘দুঃখবাদ’ আসলে এক ধরনের মুখোশ কিনা, সেই প্রশ্ন ওঠাও অস্বাভাবিক নয়। 

সেই সূত্রেই গুলিয়ে যায় ‘রবীন্দ্রবিরোধী’ কবি হিসেবে তাঁর ভূমিকা। বুদ্ধদেব বসুরা যেমন সচেতনভাবে রবীন্দ্রনাথকে সরিয়ে রেখে নিজেদের পথ তৈরি চেয়েছিলেন কিংবা ‘কল্লোল’-রা যেমন সন্ধান করেছিলেন ‘ফজলিতর’ আমের, যতীন্দ্রনাথের কবিতা সেই গোত্রে পড়বে না। বরং, তিনি একপ্রকার ‘মিসিং লিঙ্ক’। বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথরা প্রেমের আশ্রয় খুঁজেছিলেন কঙ্কাবতী, বনলতা সেন কিংবা শাশ্বতীর মতো কল্পনায়িকার কাছে। আর তিনি পাবেন না জেনেই অস্বীকার করেছেন যত রোমান্টিক চেতনা। পরবর্তী কবিদের তথাকথিত ‘অন্ধকার’-এর আঁচও মেলে যতীন্দ্রনাথের হতাশায়। অবশ্যই তাঁর কবিতায় জীবনানন্দদের চেতনার মহাপৃথিবীর সন্ধান করা বাতুলতামাত্র। তবুও তিনি ধরে রাখেন রবীন্দ্রনাথের দু-দিকের কবিগোষ্ঠীর পরিবর্তমান সময়কে। ‘দুঃখবাদ’-এর স্বঘোষিত তকমায় চাপা পড়ে গেছে সেই দিকটি। সময় তাঁকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছে কাজটুকু, বাকিটা বন্দি রয়ে গেছে পাঠ্যপুস্তকের পাতায়। 

Powered by Froala Editor

More From Author See More