শুধুমাত্র দিব্যাঙ্গদের জন্য আস্ত গ্রাম ইংল্যান্ডে

ইংল্যান্ডের নর্থ ইয়র্ক মুরস ন্যাশনাল পার্কের মধ্যে ছোট্ট এক গ্রাম বোটন (Botton)। আড়াইশোর মানুষের বাস। এমন অনেক গ্রামই রয়েছে যার জনঘনত্ব কম, লোকসংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিন্তু ইয়ার্কশায়ারের বোটন বিশেষ কারণে ব্যতিক্রমী। এখানকার মোট জনসংখ্যার ১৩৫ জন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন। আর বাকি শতাধিক তাঁদের যত্নে নিয়োজিত।

গ্রামে প্রায় ৩০টি বাড়ি, পাঁচটি বায়োডাইনামিক খামার এবং বেশ কিছু ওয়ার্কশপ রয়েছে। ১৯৫০-এর গোড়ার দিকে মা-বাবার কাছে তাঁদের দিব্যাঙ্গ সন্তানরা ‘পাপের বোঝা’ ছিল। অস্ট্রিয়ান ডাক্তার কার্ল কোনিগ (১৯০২-১৯৬৬) (Karl Konig) সেই ‘বিশেষ’দের মসীহ হিসেবে আবির্ভূত হন। 

কোনিগের জীবনেতিহাসের পৃষ্ঠা ওলটালেই দেখা মিলবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের সঙ্গে তাঁর কাজের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ কোনিগ ক্যাম্পহিল আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। এই আন্দোলনে নৃতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে সামাজিক পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ক্যাম্পহিল সম্প্রদায়ের (Camphill Community) আওতায় পড়েন বিশেষ চাহিদা সম্পন্নরাও। তাঁদের সহায়তার উদ্দেশ্যেই এই আন্দোলন। ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা ও এশিয়া জুড়ে ২০টিরও বেশি দেশে ১০০-রও বেশি ক্যাম্পহিল কমিউনিটি রয়েছে।

এহেন কোনিগই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নিবেদিত স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন স্কটল্যান্ডের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকূলবর্তী শহর অ্যাবরদিনের কাছে। তবে, সম্ভবত স্থানিক দূরত্বের কারণে এই প্রচেষ্টা বিশেষ সফল হয়নি। আসলে ইয়র্কশায়ার থেকে অ্যাবরদিনের দূরত্ব প্রায় ৩৫০ কিমি। স্বাভাবিকভাবেই অত দূরে তাঁদের সন্তানদের পাঠানোর ব্যাপারে উদ্বেগে অভিভাবকরা। যা ডাক্তার কোনিগও বোঝেন।

আরও পড়ুন
ব্রিটেনের নিঃসঙ্গতম গ্রাম, কেন জনশূন্য হয়ে গিয়েছিল গ্রামদুটি?

তাই, ১৯৫৫ সালে তাঁর নির্দেশনায় হুইটবি থেকে ১৭ এবং ইয়র্ক থেকে ৫০ মাইল দূরে ড্যানবি ডেনে বোটন হল এস্টেটটি কেনা। ডাক্তার কোনিগকে সহায়তা করেন বিশেষ চাহিদা সম্পন্নদের মা-বাবা এবং সমমনা হিতৈষীরা। এটি ছিল সম্পূর্ণ নতুন ধরনের গ্রাম তৈরি করার কর্মশালা। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্করা এই গ্রামে তাঁদের চাপমুক্ত স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে শুরু করেন। সেই শুরু। এখন বোটন একটি সমৃদ্ধ গ্রামে পরিণত। গ্রামের পথ যেন এমব্রয়ডারি বিছানো। যদিও একসময় সংঘাতের শীর্ষে ছিল। মিডিয়া এবং আইন-আদালতে খেলা চলছে। তবে অতীতের শোক নয়, ভবিষ্যৎ তৈরিতেই তাঁদের মনোনিবেশ।  

আরও পড়ুন
খোলা মাঠেই পড়াশোনা, প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ‘গাছের ইস্কুল’

এই গ্রামে তাঁরা সক্রিয় জীবনযাপনের পথ বেছে নিয়ে সুখী। তাঁদের জন্য উপহারের ডালিতে রয়েছে কাজ করবার সুযোগ, সামাজিক জীবন, ব্যক্তিগত উন্নয়নের সমস্ত অবকাশ। এখন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্করা গোটা ব্রিটেন থেকেই এখানে আসেন। 'সবে মিলি করি কাজ/ হারি-জিতি নাহি লাজ'— এ কথাই তাঁদের রন্ধ্রে। সহকর্মীদের সঙ্গে থেকে সবাই মিলেমিশে তাঁদের প্রতিভার বিকাশ ঘটান। এটাই তাঁদের জীবন-পথের ভিত্তি, এভাবেই দিন গুজরান।

বোটন ব্যাপক অর্থে একটি পরিবার। এর নিজস্ব চরিত্র রয়েছে। এখানকার ৩০টিরও বেশি শেয়ার্ড হাউস মোটামুটিভাবে পাঁচটি পাড়ায় গোষ্ঠীভুক্ত। শেয়ার্ড হাউসগুলিতে তিন থেকে ১২ জন থাকতে পারেন। সবমিলিয়ে ২৭০ জনের বাস এই গ্রামে। সাধারণ পরিবারের এক দম্পতি এখানে গৃহনির্মাতা হিসেবে কাজ করেন। তাঁরা অন্যান্য সহকর্মীর সাহায্যে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি তাঁদের নিজ সন্তানদেরও দেখভাল করছেন। এতে কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই, বিভেদ নেই। গ্রামের রাজত্বে 'সবাই রাজা'। 

গ্রামটি স্ব-শাসিত। সামাজিক দায়বদ্ধতাই গ্রামের উন্নয়নের বিকাশ ঘটিয়েছে। এর বাইরে বোটন ক্যাম্পহিল ভিলেজ ট্রাস্ট লিমিটেড অন্যতম। রয়েছে বেশ কিছু চ্যারিটি এবং ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের অ্যাসোসিয়েশন অফ ক্যাম্পহিল সম্প্রদায়ের চল্লিশের বেশি সদস্য। 

গ্রামের খাতিরে বিভিন্ন উৎস থেকেই অর্থায়ন। যার বেশিরভাগই আসে উত্তর ইয়র্কশায়ারের 'সাপোর্টিং পিপল' বাজেটের মাধ্যমে। সারাদেশের সমাজসেবা বিভাগগুলি থেকে স্বল্প হলেও বাজেট বরাদ্দ থাকে। তাছাড়াও 'হাউজিং বেনিফিট' বেশিরভাগ বাসস্থানের জন্য খরচে অবদান রাখে। কারুশিল্প এবং বিভিন্ন পণ্য বিক্রি থেকেও আয় হয়। এসব না থাকলে গ্রামের উন্নয়ন অসম্ভব ছিল।

বোটনে মোট পাঁচটি খামার, বেশ কয়েকটি বাগান এবং এক ডজন ওয়ার্কশপ রয়েছে। বায়ো-ডাইনামিক দুগ্ধজাত পণ্য থেকে শুরু করে নানান হাতের কাজ কিংবা খেলনা তৈরিতেও পটু দিব্যাঙ্গরা। উপহার তৈরিতে তো এখন এই গ্রামের দারুণ খ্যাতি। দেশে-বিদেশে বিক্রি হয় সেসব। 

তবে, সহকর্মী বা গ্রামবাসী কেউই এখানে মজুরি পান না। শুধুমাত্র অনাবাসিক কর্মচারীদের বেতন দেওয়া হয়। তবে, মজুরি না পেলেও অন্য কারো প্রয়োজন মেটানোর সন্তুষ্টি সহকর্মী গ্রামবাসীদের চোখেমুখে। প্রতিটি কাজেই তাঁদের সঙ্গে অংশ নেন দিব্যাঙ্গরাও। বাগান দেখাশোনা করা, গরুর দুধ দেওয়া, সুতো বোনা সবকিছুতেই কম নন তাঁরাও। আর হ্যাঁ। এই গ্রামসহ অন্যান্য ক্যাম্পহিল সম্প্রদায়ের জীবনধারা অস্ট্রিয়ান দার্শনিক রুডলফ স্টেইনার (১৮৬১-১৯২৫)-এর শিক্ষার ভাবধারার উপর ভিত্তি করে। সর্বজনীন শিক্ষা এবং স্বাধীনতার ধারণা নিয়েই সেই ভাবধারা। আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানই তার মূল কাঠাম। মানুষ স্বাধীন। স্বাধীন পথেই হেঁটে চলে তাঁদের মনবীক্ষা। নানান প্রতিকূলতাতেও জীবনকে কীভাবে অর্থপূর্ণ করে তুলতে হয়, এর মহার্ঘ দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রথম সারিতেই থাকবেন বোটনের সহজ মানুষেরা।

চিত্রঋণ : Camphill Village Trust

Powered by Froala Editor