একটা গোটা গ্রামই প্রযোজক, ছকভাঙা এক সিনেমার গড়ে ওঠার ‘সত্যি রূপকথা’

হঠাৎ করেই ভাবনাটা খেলে গিয়েছিল উজ্জ্বল বসুর মাথায়। নতুন ছবির জন্য প্রযোজক খুঁজছেন হন্যে হয়ে। ছবির নাম ‘দুধ পিঠের গাছ’। একটি ছোট্ট ছেলে স্বপ্ন দেখে আম-জাম-কাঁঠালের মতো দুধ পিঠের গাছও নিশ্চয়ই আছে। ঈশ্বরের দেশে গেলে সেই গাছের দেখা মিলবে। অথচ মানুষের দেশে এমন মায়াঘোর গল্পের জন্য প্রযোজক মেলে না সহজে। স্টারকাস্ট কই, কিংবা বিনোদনী চমক? ছবির তৈরির স্বপ্নটা যখন ধাক্কা খেতে শুরু করেছে, তখনই উজ্জ্বলের মনে পড়ে যায় নদিয়ার আড়ংঘাটার কথা। এই গ্রাম এক অর্থে তাঁর শিকড়। এখানকার প্রাইমারি স্কুলে পড়ানোর সময় একটি ছোট্ট ছেলেকে দেখেই এই ছবির বীজ কুড়িয়ে পেয়েছিলেন তিনি। উজ্জ্বল ভাবলেন, গ্রামের মানুষদের কাছে গিয়েই যদি দাঁড়ানো যায় সাহায্য চেয়ে? তারপরে যে এমন রূপকথা গড়ে উঠবে, তা অবশ্য ভাবতেও পারেননি তিনি।

আরও পড়ুন
এই প্রথম মহাকাশে পাড়ি বাংলা চলচ্চিত্রের, মঙ্গলের মাটিতে রহস্য বুনলেন পরিচালক

রূপকথাই বটে। উজ্জ্বল আড়ংঘাটায় গেছিলেন ছবির জন্য অর্থসংগ্রহ করতে। চেয়েছিলেন এই গ্রাম থেকেই জন্ম নিক গোটা সিনেমাটা। ক্রাউড ফান্ডিং বা গণ অর্থায়নের মধ্যে দিয়ে সিনেমা তৈরির নানা চেষ্টা এর আগে ভারতীয় চলচ্চিত্র দুনিয়া দেখেছে। গোটা বিশ্বেও এর আগে এমন উদাহরণ দুর্লভ নয়। কিন্তু একটি গ্রামের প্রায় ১০০০ জন মানুষ মিলে তিলে তিলে টাকা জড়ো করে একটি সিনেমার জন্ম দিচ্ছে – সন্তানের মতো তাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করছে, এমন নজির বোধহয় ভারত তথা গোটা বিশ্বে নেই। এবং এখানেই ‘দুধ পিঠের গাছ’-এর গড়ে ওঠার ইতিহাসটি বাকি সমস্ত সিনেমার থেকে আলাদা। প্রায় রূপকথা ছুঁয়ে ফেলা একটা ছবির জন্য প্রায় রূপকথারই জন্ম দিয়েছেন আড়ংঘাটার মানুষরা। উজ্জ্বলের হাতে তাঁরা তুলে দিয়েছেন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা!

আরও পড়ুন
থ্রিলারের চেনা গণ্ডি ছেড়ে বাঁক নিল ‘শব্দ জব্দ’, প্রশ্নের ভূত তাড়া করবে দর্শককেও

আড়ংঘাটার গ্রামবাসীরা পাশে না দাঁড়ালে যে ছবিটা করাই হত না, তা একবাক্যে স্বীকার করে নিচ্ছিলেন পরিচালক উজ্জ্বল বসু। এইভাবে যে ছবি করা যেতে পারে, শুরুতে তা ভাবতে পারেননি অনেকেই। আনুমানিক বাজেট প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা! সন্দেহ ছিল, ক্রাউড ফান্ডিং-এর মাধ্যমে এত টাকা উঠবে কী করে! হাল ছাড়েননি উজ্জ্বল। সাধ্যমতো সাহায্য করতে বলেছেন আড়ংঘাটার গ্রামবাসীদের। আয় অনুযায়ী, কেউ পারলে ১০ টাকা, কেউ পারলে তার থেকে বেশি দিক। কিন্তু যেন অংশগ্রহণ থাকে প্রত্যেকেরই। যেন গোটা একটা গ্রামের সিনেমা হয়ে উঠতে পারে ‘দুধ পিঠের গাছ’।

আরও পড়ুন
‘শেষ পঞ্চাশ’ প্রথম পর্ব: দ্বাদশ ব্যক্তি

না, গ্রামবাসীরা নিরাশ করেননি তাঁকে। সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন প্রায় হাজারজন গ্রামবাসী। ছবির প্রয়োজনে অকাতরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অন্যভাবেও। উজ্জ্বল অভিনয়েও গ্রামের মানুষদের জড়িয়ে নিয়েছেন। শুটিং-ও হয়েছে গ্রামেই। আড়ংঘাটা ও আশেপাশের অঞ্চলের প্রাইমারি ও হাইস্কুলের বহু শিশুশিল্পীও অভিনয় করছে এই সিনেমায়। শুটিং-এর আগে এই শিশুশিল্পীদের নিজের হাতে গড়ে-পিটে নিয়েছেন উজ্জ্বল।

আরও পড়ুন
জাতপাতের হিংসার মধ্যেই মানুষের বেঁচে থাকা, নতুন শর্ট ফিল্মে উঠে এল ‘বদ্ জাত’দের কথা

‘দুধ পিঠের গাছ’ আসলে না থেকেও আছে। আছে শিশুর অসম্ভব স্বপ্নে। একটা ‘সব পেয়েছির দেশ’ ভর্তি সেই গাছে। উজ্জ্বল আর তাঁর সহযোদ্ধাদের কাছে এই ছবিও যেন আসলে ‘দুধ পিঠের গাছ’। শুধু সেই ‘সব পেয়েছির দেশ’-টার সন্ধান পেয়ে গেছিলেন উজ্জ্বল। নদিয়ার আড়ংঘাটা। সিনেমা তো আসলে শুধু ‘আর্ট’ নয়, ইন্ডাস্ট্রিও। ব্যয়বহুল মাধ্যম, টাকা লাগে। সেই টাকা ফিরিয়ে দেওয়ারও দায় থাকে একটা। কিন্তু কেউ যখন সিনেমার মধ্যে দিয়ে গল্প বলতে চান, তখন তার কাছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে ওঠে অর্থ সংগ্রহ। সবসময় প্রযোজক মেলে না, কেননা প্রযোজকেরও নিরাপত্তার প্রয়োজন। প্রয়োজন জনমোহিনী গল্পের, তারকার, পরিচিত মুখের। এক্ষেত্রে সেইসব কিছুই ছিল না। ছিল একটা মায়াঘোর গল্প আর অদম্য জেদ। সেই জেদ ছুঁয়েই একটা অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলেছে ‘দুধ পিঠের গাছ’ টিম।

আরও পড়ুন
৪টি বিভাগে অস্কারজয়ী সিনেমা ‘প্যারাসাইট’ ও আজকের দেশ-দুনিয়া

ছবি তৈরির পরেও অবশ্য লড়াই থামেনি উজ্জ্বলের। সিনেমা রিলিজের প্রক্রিয়াও কম জটিল নয়। হল পেতে গেলেও মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। কয়েকদিন আগে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিচালক প্রদীপ্ত ভট্টাচার্যের ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ সিনেমাটির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, হল পেয়েও কিছুদিনের মধ্যেই হল থেকে তুলে নিতে হয়েছিল ছবিটি। এক্ষেত্রেও তেমন আশঙ্কা থেকেই যায়। তারপরেও উজ্জ্বল আর তাঁর সহযোদ্ধারা লড়ছেন। ছবির মুক্তি সামনের এপ্রিলেই। যেসব সিনেমা অনুরাগীরা চান স্বাধীন সিনেমা বেঁচে থাক, ভালো চলচ্চিত্র তার পায়ের তলার মাটি খুঁজে পাক, তাঁরা এই সিনেমার পাশে এসে দাঁড়ান, চাইছেন ‘দুধ পিঠের গাছ’-এর টিম। তাঁরা যদি এই সিনেমার পাশে দাঁড়ান, এই সিনেমা দেখতে ভিড় জমান, তাহলে হয়তো একটা নতুন দিগন্ত খুলে যাবে বাংলা চলচ্চিত্রের সামনে। প্রমাণিত হবে, এভাবেও ছবি করা যায়, এভাবেও জনপ্রিয় করে তোলা যায় ভালো ছবিকে।

‘দুধ পিঠের গাছ’ সেই অসম্ভবের দেশটাকেই খুঁজে পেতে চাইছে এই রাজ্যের ভিতর।