ক্যানসার-জয় করে বাংলাকে শিখর-জয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন ‘স্যার’ অরুণ লাল

ঠিক যেন ফিনিক্স পাখির গল্প। জ্বলে গিয়ে, ছাইয়ের ভেতর থেকে আবারও বেঁচে ওঠা। আবারও লড়াইয়ের ময়দানে ফিরে আসা রাজার মতো। এই মরসুমের রঞ্জিতে বাংলা ক্রিকেট দলকে নিয়ে এমন কথা বলাই যায়। যাঁদের সামনে কার্যত সমস্ত অস্ত্রই ভেঙে পড়েছিল শক্তিশালী কর্ণাটক টিমের। খেলোয়াড়রা তো নিজেদের উজাড় করেছেনই। সেই সঙ্গে সারাক্ষণ ছায়ার মতো থেকেছেন একজন সৌম্যকান্তি মানুষ। তাঁর জীবনের সঙ্গে যুদ্ধকে কখনও আলাদা করা যায় না। প্রতিটা পদে তিনি খাদে পড়েছেন, তারপর সেখান থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন ওই ফিনিক্স পাখির মতোই। অরুণ লাল নামের একজন ভদ্রলোকের কোচিংয়েই যে ঘুরে দাঁড়ানোর খেলা শুরু…

আরও পড়ুন
বড়ো চাকরি ছেড়ে ক্রিকেট, ভালোবাসেন গিটার ও সুমনের গান, অনুষ্টুপের জীবন তাঁর ব্যাটিং-এর মতোই ধ্রুপদী

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলেছিলেন মাত্র ১৬টি টেস্ট। করেছিলেন ৭২৯ রান। সর্বোচ্চ ৯৩, ইডেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে। খুব একটা ঝাঁ চকচকে আন্তর্জাতিক কেরিয়ার, সেটা বলা যাবে না। সুনীল গাভাসকরের বদলি হিসেবে সুযোগ পেয়েছিলেন ভারতীয় টিমে। কিন্তু, গাভাসকার তখন মধ্যগগনে। স্বভাবতই ঢাকা পড়ে গিয়েছিলেন অরুণ লাল। মিডিয়াতেও স্বাভাবিকভাবে সেরকম শোরগোল পড়েনি। কিন্তু বঙ্গ ক্রিকেটে এই অরুণ লালই হয়ে উঠলেন অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুম্বই হোক বা কর্ণাটক, অনেক সময় স্রেফ মানসিকতায় প্রতিপক্ষের থেকে এগিয়ে থাকত। ঠান্ডা মাথায় ম্যাচ বের করে নিয়ে যেত, সেখানেই ছিল মাহাত্ম্য। বঙ্গ ক্রিকেটে ঠিক এই জিনিসটাই নিয়ে এলেন অরুণ লাল। মনে করে দেখুন ১৯৮৯-৯০-এর মরসুমের কথা। কোয়ার্টার ফাইনালে বাংলার উল্টোদিকে সেই মুম্বই! সেই স্নায়ুর লড়াই। এবারেও কি একই ফলাফল? সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিলেন অরুণ লাল। তাঁর করা অপরাজিত ১৮৯ রানে ভর করে বাংলা চলে গেল সেমিফাইনালে। সেই মরসুমে দ্বিতীয়বারের জন্য রঞ্জি চ্যাম্পিয়ন হল বাংলা।

আরও পড়ুন
অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ ফাইনাল আজ, চিনে নিন ভারতীয় দলের ক্রিকেটারদের

এবার একটু ফিরে দেখুন বাংলা বনাম কর্ণাটকের সেমিফাইনাল ম্যাচ। সেই হার না মানা ছবিটাই কি ভেসে আসছে না? অন্যান্য ম্যাচগুলোও নজরে রাখা উচিত। ম্যাচের পরে কোচ অরুণ লালের সাক্ষাৎকারে যেন ঝরে পড়ছে আত্মবিশ্বাস। ওরা ঠিক পারবে, পারলে ওরাই পারবে— বাংলা দলটির সম্পর্কে সবসময় এটাই বলে এসেছেন তিনি। পিকে’র ভোকাল টনিকের কথা মনে পড়ছে কি? অরুণের এই আত্মবিশ্বাসই দেখা গেছে অনুষ্টুপ মজুমদার, ঈশান পোড়েল, শাহবাজ আহমেদদের মধ্যে।

আরও পড়ুন
৮ বছর বয়সে হাত খুইয়েও ছাড়েননি খেলা, রাজ্যের অধিনায়কও হয়েছেন এই ক্রিকেটার

রঞ্জিতে এই মরসুমে বাংলার কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনালের নায়ক অনুষ্টুপ। কথাপ্রসঙ্গে প্রহরকে জানাচ্ছিলেন, “অরুণ লাল এসে টিমের ভেতরের আবহাওয়া পুরোটাই বদলে দিয়েছেন। প্রত্যেকে নিজের সর্বস্বটা দেওয়ার কথা ভাবছে। যতটা পারবে, জেতার জন্যই ঝাঁপিয়ে পড়া যেটাকে বলে। ব্যক্তি নয়, টিম আগে; তার জন্য সবকিছু করার এই মানসিকতা এসেছে এই টিমে। হয়তো এই মুহূর্তে বাংলার ক্রিকেটে ওঁর থেকে ভালো কোনো মোটিভেটর নেই। টেকনিক নিয়ে সচরাচর কথা বলতেন না। তাঁর নিজেরও সেই দিকে পাহাড়প্রমাণ পারদর্শিতা ছিল না। এটা তিনি নিজেই বলতেন। মনের জোরকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতেন তিনি। খেলোয়াড় জীবনে তো দিয়েছেনই, নিজের কোচিং জীবনেও। বাংলার ড্রেসিংরুমেও সেটাই ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।”

আরও পড়ুন
৮৭-তেও তরুণী ছিলেন তিনি, প্রয়াত ভারতীয় ক্রিকেটের ‘সুপারফ্যান’ চারুলতা প্যাটেল

মনের জোরের এই নমুনায় প্রতি পদে দেখা গেছে খেলোয়াড়দের মধ্যে। দু’মাস ধরে বিশেষ কিছু ট্রেনিং করিয়েছেন অরুণ লাল। ১০-১৫ পাক করে দৌড়তে হত সবাইকে। দৌড়ের সঙ্গে ভাবতে বলতেন পজিটিভ কথা। কেউ ২০০ করছে, কেউ বড়ো ইনিংসের দায়িত্ব নিচ্ছে, কেউ ছয় সাত উইকেট নিচ্ছে— এই ভাবনাগুলো ভাবতে ভাবতে দৌড়তে বলতেন। অদ্ভুতভাবে একটা সময় এটাই কাজে এসে যায় সবার। এই ভাবনাটাই খেলোয়াড়দের ভেতরে ঢুকে যায়। ব্যস, বাকিটা মাঠে নেমে নিজের মতো করে খেলা। যতটুকু পারো, সবটা দিয়ে মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে জেতার জন্য খেলো— এই ছিল ‘অরুণ-মন্ত্র’।

আরও পড়ুন
কোনো ক্রিকেটার নন, সেবার মাঠকর্মীরাই পেয়েছিলেন ‘ম্যান অব দ্য মাচ’ পুরস্কার

কঠোর পরিশ্রম, হার-না-মানা মনোভাব, সেই সঙ্গে ক্রিজে দাঁত কামড়ে টিকে থাকার জোর— আমাদের একটু একটু করে শিখিয়ে যান অরুণ। যতই চোট আঘাত লাগুক, খেলে গেছেন নিজের সেরাটা দিয়ে। শুধু কি ক্রিকেটের বাইশ গজেই? ২০১৬ সালে আচমকা ধরা পড়ল ভয়ংকর রোগ। রিপোর্ট এল, বিরল চোয়ালের ক্যানসারে আক্রান্ত অরুণ লাল। জীবন এক লহমায় কীরকম বদলে যায় না? মৃত্যুর খাদের সামনে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়ে দেওয়া বলে না একে! কিন্তু অরুণ লাল পারলেন। স্টেপ আউট করে বল পার করে দিলেন বাউন্ডারি। তারপরই বাংলার দায়িত্বে যখন এলেন, শুধু শারীরিক বা ক্রিকেটীয় কোচিং নয়; মানসিক ট্রেনিংও চলতে লাগল প্লেয়ারদের। সেই সময়ই বলেছিলেন, এই টিমই পারবে রঞ্জি জয় করতে। কয়েক বছরের মধ্যেই করবে।

আরও পড়ুন
ফুটবল ও ক্রিকেট – দুই খেলাতেই ময়দান কাঁপাতেন বাংলার চুণী গোস্বামী

আজ, ১৩ বছর ধরে সেই অধরা স্বপ্নের শেষ দরজায় দাঁড়িয়ে বাংলা ক্রিকেট দল। খেলোয়াড়রাও জানেন, পেছনে ঠিকই দাঁড়িয়ে আছেন ‘অরুণ স্যার’। এবার শুধু মাটি শক্ত করে ধরে রাখা, আর নিজের সেরাটুকু দেওয়া। বাকিটা তো সময়ের খাতায়…

More From Author See More