খোলা মাঠেই পড়াশোনা, প্রত্যন্ত আদিবাসী গ্রামে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ‘গাছের ইস্কুল’

“ছোটো থেকেই প্রকৃতির মধ্যে ওদের বেড়ে ওঠা। কিন্তু প্রকৃতি-পরিবেশের যে একটা সংরক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে, সেটা কোনোদিন ওদের মনে আসেনি। কেউ বুঝিয়েও দেয়নি। তাই আমরা যখন বলি, কেন গাছ কাটতে নেই, কেন বনবেড়াল মারতে নেই, তখন ওরা শোনে।” বলছিলেন গাছের ইস্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অংশুমান ঠাকুর। গাছের ইস্কুল, মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা থানার অন্তর্গত বাহাদুরপুর অঞ্চলের শামলাপুর গ্রামের জনা ৫০ আদিবাসী ছেলেমেয়ের প্রতিদিনের পঠনপাঠনের ঠিকানা। এই লকডাউনের মধ্যেও তাদের পড়াশোনার চর্চাটা বাঁচিয়ে রেখেছে গাছের ইস্কুল। আর তার সঙ্গেই চলছে প্রকৃতির পাঠ।

অংশুমানের কথায়, “শান্তিনিকেতনে পড়ার সময়েই আমি অনুভব করেছিলাম প্রকৃতির মধ্যে থেকে পড়াশোনা করার তাৎপর্য কতটা। এখানেও সেই পরিবেশটাই তৈরি করার চেষ্টা করেছি। খোলা মাঠের মধ্যে গাছের নিচেই চলে পড়াশোনা।” আর এই নামকরণের মধ্যেও যে রয়েছে এক মাটির টান। “ওরা তো স্কুল উচ্চারণ করে না, ইস্কুল বলে। আর এই বিদ্যালয় তো ওদেরই। তাই নামের মধ্যেও সেই বিষয়টা রেখেছি।” বলছিলেন অংশুমান। ২০১৯ সাল থেকেই ‘গাছ গ্রিন হ্যান্ডস’ নামের একটি পরিবেশ সংগঠনের হয়ে কাজ করে চলেছেন অংশুমান। কিন্তু ক্রমশ তাঁর মনে হয়, এতে পরিবেশ সংরক্ষণের পুরো প্রক্রিয়াটার মধ্যে এক ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাবনা এসে পড়ছে। সমষ্টিগত একটা প্রচেষ্টা গড়ে তুলতে গেলে ছোটো থেকেই সেই শিক্ষার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। এই ভাবনা থেকেই তৈরি গাছের ইস্কুল। ফারাক্কা কলেজের আংশিক সময়ের শিক্ষক অংশুমানের সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন তাঁর ছাত্রছাত্রীরাও।

এর মধ্যেই এসে পড়ল লকডাউন। সমস্ত স্কুল বন্ধ। এমনিতেই প্রত্যন্ত এই অঞ্চলে শিক্ষার পরিকাঠামো নেই বললেই চলে। এই পরিস্থিতিতে পড়াশোনা একেবারে বন্ধ হয়ে যেতে দেননি অংশুমান। গত মার্চ মাস থেকে শুরু হয় পড়াশোনা। কিন্তু শুধু পড়াশোনার ব্যবস্থা করলেই তো হবে না। স্কুল বন্ধ থাকায় পড়ুয়ারা মিড-ডে মিলের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। অঙ্গনওয়াড়ি ব্যবস্থাও বন্ধ। রুগ্ন, অপুষ্ট শরীরে শিক্ষা কতটুকুই বা এগোতে পারে? মে মাস থেকেই তাই পড়াশোনার পাশাপাশি শুরু হয়েছে পড়ুয়াদের নিয়মিত খাবার দেওয়ার কাজ। “অন্তত সপ্তাহে দুদিন ডিমের ব্যবস্থা করা গেলেও তো কিছুটা পুষ্টি পাবে তারা।” বলছিলেন অংশুমান। ইতিমধ্যে সামাজিক মাধ্যমের সূত্রে এই উদ্যোগের কথা জানতে পেরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন অনেকে। তবু সবসময়ই দুশ্চিন্তা থাকে, কতদিন এই উদ্যোগ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্রদের স্কুলছুটের প্রবণতা বেশি, জানাচ্ছে সাম্প্রতিক সমীক্ষা

আরও পড়ুন
জীবনসায়াহ্নে এসে ‘সহজপাঠ’, লকডাউনে প্রবীণদের স্কুল চালু মণিপুরে

তবে ধীরে ধীরে পড়ুয়াদের মধ্যে পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা গড়ে উঠছে, এটাই আশার কথা। অংশুমান বলছিলেন, “ওরা জানতই না যে শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতির সৃষ্টি হয়। শুঁয়োপোকা দেখলেই পুড়িয়ে ফেলত। যখন জানতে পারল শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতির জন্ম হয়, তখন নিজেরাই স্বভাব বদলে ফেলল। এমনকি আমরা ওদের গাছ কাটতে বারণ করেছি, অথচ সেদিন একটা বেড়া তৈরির জন্য বাঁশ কাটতে গেলে ওরাই প্রশ্ন করে, তোরা বাঁশ কাটছিস কেন? এই প্রশ্নগুলোর ভিতর দিয়েই তো পরিবেশের বাকি সদস্যদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টা বুঝতে পারবে।”

আরও পড়ুন
লুধিয়ানায় ‘মাইক্রো অক্সিজেন চেম্বার’ তৈরি স্কুল পড়ুয়াদের

লকডাউনের সময়কে মাথায় রেখেই পথচলা শুরু। প্রতিদিন বিকালে অংশুমানের ছাত্রী ডলি সিং ঘণ্টা দুয়েকের ক্লাস নিয়ে চলেছেন। লকডাউন উঠে গেলে, সরকারি স্কুল চালু হয়ে গেলে কি এই পথচলা থমকে যাবে? অংশুমান বললেন, তাঁরা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথাই ভেবেছেন। সরকারি স্কুলের পরিকাঠামোর মধ্যে প্রথাগত শিক্ষা কিছুটা এগোলেও প্রকৃতির পাঠ তো হয় না। গাছের ইস্কুল তাই এগিয়ে যাবে নিজের মতো করেই। এ যে এক প্রকৃতির পাঠশালা।

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More