‘ডাস্টবিন স্কুল’-এ পাঠানো হত কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের, প্রকাশ্যে ইংল্যান্ডের অমানবিক ছবি

“স্কুল থেকে ডিগ্রি নিয়ে পাশ করার পরেও কোথাও চাকরির জন্য আবেদন করতে পারিনি। কারণ, কীভাবে উচ্চারণ করতে হয় বা কীভাবে ফর্ম ভরতে হয়— সেটুকুও আমাদের শেখানো হয়নি স্কুলে। ইচ্ছাকৃতভাবেই। কারণ, বিশ্বাস করা হত আমাদের বুদ্ধিমত্তা কার্যত শূন্য।”

চলতি সপ্তাহেই প্রকাশ পেয়েছে চলচ্চিত্র নির্মাতা লিটানিয়া শ্যাননের তথ্যচিত্র ‘সাবনর্মাল : আ ব্রিটিশ স্ক্যানডাল’। আর সেই তথ্যচিত্রতেই এমন কথা বলতে শোনা গেল নইল গর্ডন নামের এক ব্যক্তিকে। অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? অবাক লাগার তো স্বাভাবিক। একজন ছাত্রকে কীভাবে ইচ্ছাকৃত করে উপেক্ষা করতে পারেন শিক্ষকরা? আসলে বিষয় ঠিক তেমন না। ক্লাসের প্রতি শিক্ষার্থীদের প্রতিই এমনটাই আচরণ করা হত সেইসময়ে। আর পরিকল্পনামাফিকই তৈরি করা হয়েছিল এমন স্কুল।

যে সময়ের কথা হচ্ছে সেটা ষাট-সত্তরের দশক। একটা অস্বস্তিকর সময় ব্রিটেনে। বর্ণবিদ্বেষ পৌঁছেছে তার চরম সীমায়। ঠিক সেইসময়ই বুদ্ধিমত্তার নিরিখে পিছিয়ে পড়া ‘অতিসাধারণ’ শিশুদের জন্য পরিকল্পনা করেই তৈরি করা হয়েছিল ‘সাবনর্মাল’ স্কুল। যা চলতি কথায় প্রচলিত ‘ডাস্টবিন স্কুল’ নামেও। আর এই স্কুলের ৮০-৯০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী ছিল মূলত কৃষাঙ্গ শিশুরা। তবে বুদ্ধিমত্তায় পিছিয়ে পড়ার বিষয়টি ছিল সম্পূর্ণ ভাঁওতা। আসলে বর্ণবৈষম্যের জেরেই তৈরি হয়েছিল এই স্কুলগুলি। 

শুধু ব্রিটেনের কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরাই নয়। জামাইকা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ-সহ একাধিক দেশ থেকেই সেই সময় ছাত্রছাত্রীরা অনেক আশা নিয়েই পড়তে আসত ব্রিটেনের এই স্কুলে। আর তারপর শিকার হত চরম অব্যবস্থার। বোর্ডিং স্কুল হওয়ার কারণে যোগাযোগ থাকত না পরিবারের সঙ্গে। অন্যদিকে স্কুলে চলত মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন। এমনকি ভুল শিক্ষা দিয়ে চেষ্টা চলত তাঁদের মধ্যে বর্ণবৈষম্যের বীজ রোপণের। কৃষ্ণাঙ্গ হওয়া মানেই যে অপরাধ, প্রতিপদে বোঝানো হত তাদের। স্কুল থেকে পাশ করার পরেও শিক্ষার ভাণ্ডার থাকত শূন্যতেই।

আরও পড়ুন
বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে একজোট এশিয়-আমেরিকান শিল্পীরা, চলছে সচেতনতামূলক প্রচার

কিন্তু জীবন তো গতিরুদ্ধ হয়ে থাকে না। তাই সাবনর্মাল স্কুল থেকে পাশ করার পরে অনেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই প্রথাগত শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছেন বাড়িতে থেকেই। এখন তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রতিষ্ঠিতও। তবে বৈষম্যের সেই দাগ মোছেনি এখনও। কেউ লজ্জা, অপমানে সন্তানদের থেকেও লুকিয়ে রাখেন ‘সাবনর্মাল’ স্কুলের স্মৃতি। 

আরও পড়ুন
পুলিশের গুলিতে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ যুবক, ফের বর্ণবিদ্বেষে রক্তাক্ত জর্জ ফ্লয়েডের শহর

তবে এইসব স্কুলের সমস্ত শিক্ষকরাই যে এমন অমানবিক আচরণ করতেন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে, তেমনটা নয়। তেমনই এক শিক্ষক বার্নার্ড বোর্ডকে শ্যানন তুলে এনেছেন তাঁর তথ্যচিত্রে। নিয়োজিত হওয়ার আগে পর্যন্তও মূল প্রেক্ষাপটের ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না গ্রেনাডার এই শিক্ষকের। ফলে ছাত্রছাত্রীদের তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ভেবেছিলেন শুরুর দিকে। পরে সেই ধারণা ভাঙে তাঁর। সকলকে লুকিয়ে ব্যক্তিগতভাবেই প্রত্যেক শিশুর পরিচর্যা করতেন তিনি। করাতেন ঐকান্তিক ক্লাসও। পরবর্তীকালে গোটা অব্যবস্থাটির ব্যাপারে তিনিই সরব হন সর্বপ্রথম। গড়ে তোলেন প্রতিরোধ। তাঁর লেখা বই ‘হাউ দ্য ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান চাইল্ড ইজ মেড এডুকেশনালি সাবনর্মাল ইন ব্রিটিশ স্কুল সিস্টেম’ ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয় কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মধ্যে। ১৯৭১ সালে গড়ে ওঠে ব্ল্যাক এডুকেশন আন্দোলন। 

আরও পড়ুন
বর্ণবিদ্বেষী মন্তব্যের জের, ইস্তফা দিতে বাধ্য হলেন ‘টিন ভগ’ সম্পাদক

সেই আন্দোলনের পরেই অবসান ঘটে সাবনর্মাল স্কুলের। তবে সেই কেলেঙ্কারির কথা সম্পূর্ণভাবে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলে ব্রিটিশ সরকার। অন্যদিকে সংখ্যালঘু ও কৃষ্ণাঙ্গরা তৈরি করেন বর্ণবাদবিরোধী সাপ্লিমেন্টারি স্কুল। আনুমানিক ধারণা অনুযায়ী ব্রিটেনের সেই নারকীয় শিক্ষাব্যবস্থার শিকার হয়েছিলেন ৬০ হাজারেরও বেশি কৃষ্ণাঙ্গ শিশু। কিন্তু আজও কি বদলেছে পরিস্থিতি? কৃষ্ণাঙ্গদের শারীরিক আকার কিংবা চুলের স্টাইলের জন্যও নিত্যদিনই অপমানিত হতে হয় ইংল্যান্ডে। এমনকি সম্প্রতি সামনে এসেছে, বর্ণবৈষম্যের শিকার স্বয়ং রাজপরিবারের পুত্রবধু মেগানও। এর শেষ কোথায় জানা নেই। তবে শ্যাননের তথ্যচিত্র এই অসাম্যের গালেই যেন সপাট থাপ্পড়…

Powered by Froala Editor

More From Author See More