মৃত্যুর পরে ‘পুরুষ’-পরিচয় বদলে গেল নারীতে! কে এই রহস্যময় ডাক্তার?

৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসা করার পর হঠাৎই মারা গিয়েছেন ইংল্যান্ডের অন্যতম জনপ্রিয় একজন চিকিৎসক। চিকিৎসার পাশাপাশি দীর্ঘদিন সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেছেন তিনি। এমন একজন মানুষের মৃত্যুতে স্বাভাবিকভাবেই শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছিলেন রাজকর্মচারী থেকে শুরু করে রাজপরিবারের সদস্যরাও। ঠিক এমন সময়েই শোনা গেল এক অদ্ভুত ঘটনার কথা। সেই চিকিৎসকের মৃতদেহ পরিষ্কার করতে গিয়ে সাফাইকর্মী লক্ষ করেছেন, তিনি আসলে পুরুষ নন। তিনি মহিলা, এবং তাঁর তলপেটে প্রসবের চিহ্নও রয়েছে। ইংল্যান্ডের ইতিহাসে অন্যতম রহস্যময় এক চরিত্র ডাঃ জেমস ব্যারি (Dr. James Barry)। তাঁর প্রকৃত পরিচয় কী, কীভাবেই বা এত মানুষের কাছ থেকে গোপন রেখেছিলেন তাঁর লিঙ্গপরিচয়?

১৮৬৫ সালে জেমস ব্যারির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই ইংল্যান্ডজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে। লোকমুখে নানা গুজবও ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড়ো গুজবটি হল, ব্যারি আসলে রাজা তৃতীয় জর্জের অবৈধ কন্যা ছিলেন। এই জনশ্রুতিকে উপজীব্য করে একটি কাহিনিও লিখে ফেলেছিলেন চার্লস ডিকেন্স। ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ডে অন্যতম জনপ্রিয় একটি নাটক মঞ্চস্থ হয় সেই কাহিনি নিয়ে। তবে এ-কথা মানতেই হবে, সমস্ত গুজব ও কাহিনির চেয়েও অনেক বেশি রোমাঞ্চকর ব্যারির বাস্তব জীবন। ১৮৫৯ সালের আগে ইংল্যান্ডে মহিলাদের ডাক্তারি পড়া নিষিদ্ধই ছিল। অথচ তার প্রায় ৩০ বছর আগে একজন মহিলা শুধু যে ডাক্তারি পড়েছিলেন, তাই নয়। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা করেছেন, এমনকি সেনাবাহিনীতেও যোগ দিয়েছেন।

জেমস ব্যারির মৃত্যুর প্রায় ১৫০ বছর পর তাঁর জীবনের প্রকৃত তথ্য খোঁজার কাজ শুরু করলেন মিশেল ডু প্রেজ নামের আরেক চিকিৎসক। তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন জীবনীকার জেরেমি ডনফিল্ড। ২০১৬ সালে তাঁদের সংগ্রহ করা সমস্ত তথ্য নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘ডাঃ জেমস ব্যারি – আ ওম্যান অ্যাহেড অফ হার টাইম’। জেমস ব্যারির জীবনের ওপর এখনও অবধি এটিই সবচেয়ে তথ্যসমৃদ্ধ বই। তবে ব্যারিকে তৃতীয় জর্জের সন্তান বলে স্বীকার করেননি জীবনীকাররা। বরং মিশেল প্রেজ বলছেন, ১৭৯০ সালে কর্ক শহরে এক ব্যবসায়ী পরিবারে জন্ম মার্গারেট বালকলে। এই মার্গারেটই পরে নিজেকে জেমস ব্যারি নামে পরিচয় দেবেন।

ভিক্টোরীয় যুগে জন্ম নিয়েও মার্গারেট ছোটো থেকেই ছিলেন স্বাধীনচেতা। একদিন কথায় কথায় তাঁর দাদাকে জানিয়েছিলেন, তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চান। তাঁর এই ইচ্ছার কথা শুনে সবাই হাসাহাসি করায় আরও জেদ বেড়ে যায় তাঁর। আর ঠিক এই সময়েই পিটার ব্যারি নামের এক আত্মীয় মার্গারেটকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। তিনিই মার্গারেটকে এডিনবরা রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেন-এ ভর্তি হতে সাহায্য করেন। সেইসঙ্গে বদলে ফেললেন নামও। মার্গারেট নিজের পরিচয় দিলেন পিটার ব্যারির ভাইপো জেমস ব্যারি। এরপর ডাক্তারি পড়া শেষ করে আর্মি ট্রেনিং-এ যান ব্যারি। সেখানেও পিটার ব্যারির পরিচয় কাজে লেগে যায়। মাত্র ২২ বছর বয়সে সেনাবাহিনীর চিকিৎসক হিসাবে কাজ শুরু করেন তিনি।

আরও পড়ুন
প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা মহাকাশচারী হিসেবে আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে জেসিকা

প্রথম ১২ বছর কেপ উপনিবেশে কাটিয়েছেন ব্যারি। সেখানেই সেনাবাহিনীর প্রধান মেডিক্যাল অফিসারের দায়িত্বও পান। পরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভূমধ্যসাগর সহ বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ করেছেন তিনি। জেমস ব্যারির হাত ধরেই জনস্বাস্থ্য বিভাগে কাজ শুরু করেছিলেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল। তবে জেমস ব্যারির বদমেজাজের কারণে অনেকেই তাঁর ওপর ঠিক সন্তুষ্ট ছিলেন না। জেলখানা এবং অ্যাসাইলামের স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নতি ঘটানোর জন্য তো রীতিমতো রাজপরিবারের সঙ্গে ঝামেলাই শুরু করে দিয়েছিলেন। এমনকি তুচ্ছ কারণে নাইটেঙ্গেলকেও বকাবকি করেছেন বহুবার। তবে সমস্ত মানুষকেই তিনি এত ভালোবেসেছেন, মানুষও তাই তাঁকে ভালোবাসতে দেরি করেননি। এখানে ধনী-দরিদ্র অথবা ঔপনিবেশিক প্রভু-ক্রীতদাসদের মধ্যে কোনো প্রভেদ করতেন না তিনি। তাছাড়া নানা জটিল সার্জারির কাজেও ব্যারি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনিই প্রথম সিজারিয়ান প্রসব ঘটিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
প্রথম মহিলা মার্কিন প্রেসিডেন্ট পেল আমেরিকা

তবে সারাজীবন ডাক্তারদের আশেপাশে থেকেও কীভাবে ব্যারি তাঁর লিঙ্গপরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন, তা এক রহস্য। মিশেল প্রেজের মতে, বহু প্রভাবশালী মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর। এর মধ্যেই অন্যতম ছিলেন কেপের গভর্নর চার্লস সমরসেট। সম্ভবত সমরসেটের সন্তানেরই জন্ম দিয়েছিলেন ব্যারি। তবে অনেকেই মনে করেন, জেমস ব্যারি আসলে ছিলেন একজন ইন্টারসেক্স। তাঁর শরীরে পুরুষ এবং নারী, উভয় লিঙ্গেরই বৈশিষ্ট্য ছিল। আর তার ফলেই বাকিদের চোখে ধুলো দিতে পেরেছিলেন তিনি। তবে ১৮৬৫ সালে ব্যারির মৃত্যুর মাস দুয়েক পরেই ইংল্যান্ডের প্রথম মহিলা ডাক্তার হিসাবে পাশ করেন এলিজাবেথ গ্যারেট আন্ডারসন। একে সমাপতন ছাড়া আর কীই বা বলা যায়?

আরও পড়ুন
প্রথম অ-শ্বেতাঙ্গ মহিলা হিসেবে দক্ষিণ মেরু জয়ের পথে ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রীত

তথ্যসূত্রঃ Dr James Barry: A Woman Ahead of Her Time review – an exquisite story of scandalous subterfuge, Wendy Moore, The Guardian

Powered by Froala Editor

More From Author See More