সত্যজিতের লেখা নাটিকা

মানিকলমকারি -৫৬
আগের পর্বে

সিনেমার কাজ দৃশ্য তৈরি করা। সেখানে অক্ষরের খেলা মুখ্য নয়। কিন্তু তার শুরুতে যে টাইটেল কার্ড দেখানো হয়, তাকেই শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর সেটা তাঁর প্রথম ছবি থেকেই। ‘পথের পাঁচালি’-র সেই কিংবদন্তী টাইটেল কার্ড যেন ‘অপরাজিত’ বা ‘অপুর সংসার’-এ অনেকটা সাদামাটা হয়ে গিয়েছিল। তবে এই টাইটেল কার্ডের মধ্যে দিয়েই ফুটে উঠেছে অপুর বাবা হরিহরের যাত্রা লিখতে চাওয়ার স্বপ্ন থেকে অপুর ছাপার জীবনে আসার স্বপ্ন। আবার সেই স্বপ্ন ভেঙে অপু-অপর্ণার সংসারের কথা। ছবির গল্পকেই যেন টাইটেল কার্ডে নিয়ে আসতেন সত্যজিৎ। তাই কাঞ্চনজঙ্ঘার টাইটেল কার্ডে তিব্বতী থাংকার সঙ্গে মিলে গিয়েছে পশ্চিমি আদলে আঁকা দার্জিলিং-এর ছবি। আবার ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর একটি বাতিল টাইটেল কার্ডে তুলে এনেছিলেন কাশীর দেয়ালচিত্র এবং সেখানকার হিন্দি লেখার ধরণে বাংলা হরফে লিখেছিলেন নাম।

নাটিকাটির নাম ‘হাউই’। নাটিকাটি সত্যজিৎ লিখেছিলেন ২ অক্টোবর ১৯৮৬ তবে সেই নাটক ‘সন্দেশ’ পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছিল সত্যজিতের মৃত্যুর বছর দুয়েক পরে ১৯৯৪ সালে। এটা বেশ অদ্ভুত একটা ব্যাপার না, সত্যজিৎ ছোটোদের জন্য গল্প লিখেছেন, ছড়া লিখেছেন, ছবি তো বানিয়েছেনই--- কিন্তু নাটক কখনো লেখেননি আর। আর এটাও বেশ আশ্চর্যের ব্যাপার যে, যে-নাটিকাটি তিনি লিখলেন, সেটিও জীবৎকালে প্রকাশ করলেন না। খুবই ছোট্টো একটি নাটক। কাহিনিও সামান্য। তবে সেখানেও কিছু অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করা যায় বলেই তা নিয়ে আজকের কলমকারির আড্ডা।

লক্ষণীয়, নাটিকাটির শুরুতেই সত্যজিৎ নাটকে উল্লিখিত চরিত্রের নাম- পরিচয় আর নাট্যদৃশ্যের বর্ণনা দিয়ে শুরু করেছেন। নাট্যদৃশ্যে কী চমৎকারভাবে মঞ্চের একটা বর্ণনা হাজির করেছেন--- ছোটো ছোটো প্রসঙ্গের ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন একটি পত্রিকার আপিসের চেহারা। মঞ্চের কোথায় কোন কোণে কী আছে আর কে আছে, তার চেয়েও বড়ো কথা কে কী করছে, তার একটা বিবরণ দিয়ে শুরু হয় নাট্যদৃশ্য। স্পষ্টত লিখে দেন ঘরের মাঝখানে পত্রিকার সম্পাদকের টেবিল, তার সামনে উপস্থিত সম্পাদকের এক বন্ধু। তাদের হাতের কাছে রয়েছে চায়ের কাপ। তাদের পিছনদিকে এই পত্রিকার কর্মচারী পত্রিকার নতুন সংখ্যাটি গ্রাহকদের কাছে পাঠাবার জন্য ব্রাউন পেপারের প্যাকেটে বন্ধ করছে। এমনকি, মঞ্চের একেবারে পিছনে যে একটি দরজা আছে এবং সেই বন্ধ দরজা দেখে যে ভেতরের দিকে আরো ঘর আছে, তার একটি ইঙ্গিতও দিয়ে রাখেন নাটিকার মঞ্চনির্দেশক।

একেবারে ছোট্টো একটি নাটক--- কিন্তু তার মধ্যেই, মূল কাহিনিটিকে রেখেই লক্ষ করার বিষয় হল, একটি ছোটোদের পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত যত রকম বিষয় হতে পারে, তার সবই প্রায় স্পর্শ করে যান নাট্যকার। যেমন, পত্রিকার বিক্রির হিসেব, পত্রিকা চালানোর জন্য বিজ্ঞাপন কতখানি দরকার, বিজ্ঞাপনের রেট নিয়ে বিজ্ঞাপনদাতাদের সঙ্গে খটাখটি, বিজ্ঞাপন দেবে বলে বিজ্ঞাপনের ম্যাটার পাঠাতে দেরি করার জন্য পত্রিকা ছাপতে দেরি হওয়ার সমস্যা, খারাপ ছাপার জন্য প্রেস বদল করার ঝক্কি--- পত্রিকার অন্দরমহলের গপ্পোসপ্পো গুছিয়ে সংলাপের ভেতর ঢুকিয়ে নেন তিনি। অন্যদিকে লেখা পাঠানোর পর বাতিল হওয়া লেখকের বিষয়, নতুন লেখকের লেখার সন্ধান, লেখার সঙ্গে যুক্ত মানানসই অলংকরণ করার ধরন কীভাবে আজকাল বদলে গিয়েছে, খুদে গ্রাহকদের পত্রিকা নিয়ে আগ্রহ--- সব বিষয়ই নাটিকার মধ্যে পরপর গেঁথে দিতে পারেন তিনি। তবে নাটকের পাঠক জানেন, এই নাটিকর গল্পটা আসলে বেশ অদ্ভুত। বিষয়টা হল--- লেখকের নাম! পত্রিকা যারা বের করেন আর যারা প্রথম পড়েন সেই পত্রিকার দফতরে পাঠানো পাণ্ডুলিপি। পড়ার পরে সিদ্ধান্ত নেন পাণ্ডুলিপি আদৌ ছাপা হবে কি না, সেই বিষয়ে, তাঁদের কাছে কি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে না লেখকের নাম? লেখকের নাম বলতে এটা শুধু নাম-করা লেখকের বিষয় নয়--- লেখকের নাম বলতে, বেশ আধুনিক যুগোপযোগী নাম। লেখকের প্রকৃত নাম যদি একটু পুরাতনি গন্ধ ঘেঁষা হয়, তাহলে হয়ত সম্পাদকমশাই খুলেই দেখবেন না তার লেখা। এই ভাবনা থেকে নিজের আসল নাম ‘তিনকড়ি ধাড়া’ গোপন করে লেখক নিজের লেখা পাঠান ‘নবারুণ চট্টোপাধ্যায়’ নামে।

নাটিকা হাউই-এর অলংকরণ

 

আরও পড়ুন
নামাঙ্কনের কলমকারি হরফদারি

কাহিনির নির্মম দিকটি হল, সেই নবারুণের লেখা গৃহীত হলেও, তিনকড়ি ধাড়া নাম বলে, পত্রিকার আপিসে এসে পৌঁছবার পরেও একরকম উপেক্ষারই শিকার হতে হয় তিনকড়িকে। সম্পাদক তাঁকে বসিয়ে রেখেই নিজের অন্যান্য সাতপাঁচ কাজে ব্যস্ত হয়ে থাকেন। কী নিষ্ঠুর একটা গল্প। তিনকড়ি ধাড়া ছোটোদের পত্রিকার আপিসে আসেন। তাঁকে দেখতে কেমন? নাট্যের মধ্যে সেই বর্ণনাও স্পষ্ট--- ‘একজন বেঁটে, নিরীহ ভদ্রলোক, মাথায় টাক, পরনে গেরুয়া পাঞ্জাবি এবং খাটো ধুতি’। এঁর কথা বলার ধরন ভারি নিরীহ ধরনের। এঁর লেখাই নির্বাচিত হয়েছে, এঁর লেখা সম্পর্কেই সম্পাদক বলছেন, এমন নতুন লেখাই দরকার, এই লেখাই এবারের সেরা হতে বাধ্য, লেখকের পরিশ্রম আর মেধার কথাও বলছেন--- কিন্তু এমন একজন সাধারণ গোবেচারা চেহারার মানুষ যে এর লেখক হতেও পারে, সেটা মাথাতেই আসে না তাঁর। এটাই একটা জগৎ--- পোশাকাশাক- হালফ্যাশনের কেতাদুরস্তামি-র সঙ্গে লেখাকেও জুড়ে নিতে চায় মানুষ। সেখান থেকেই ওই তিনকড়ি ধাড়া নাম যেমন এদের কাছে অপাঙক্তেয়, তেমনই তাদের নজর নেই পত্রিকার আপিসে আসা ওই নিতান্ত সাধারণ মানুষটির দিকে। পরে অবশ্য চেনাচেনি হতে কাহিনির সহজ সমাপ্তি।

আরও পড়ুন
শুটিংয়ের বৈঠকি গপ্পো: এক অভিনব গদ্যবিষয়

এহেন একটি কাহিনি নাটকাকারে লিখেও সত্যজিৎ তা প্রকাশ করলেন না--- বরং লিখলেন আরেকটি গল্প। তারও বিষয় এই রকম ছোটোদের পত্রিকা, সেখানে লেখা-ছাপা নিয়ে কথাবার্তা এবং তার চেয়েও বড়ো কথা, সেখানেও ওই পুরাতনি নাম আর নতুন যুগের হালফ্যাশনের নাম নিয়ে একটা মজার খেলা তৈরি করলেন সত্যজিৎ। গল্পটির নাম ‘শিশু সাহিত্যিক’। গল্পটি প্রকাশিত হয় ‘সন্দেশ’ পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৯৪ সংখ্যায়। মানে ১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। ১৯৮৬-তে লেখা নাটিকার ‘হাউই’ পত্রিকা সেখানে হয়েছে ‘বহুরূপী’ পত্রিকা। সেখানেও পত্রিকার সম্পাদক সুপ্রকাশ সেনগুপ্তের ধারণা এই রকম ‘নতুন লেখকের অনেক লেখা আসে এবং সে লেখা পড়েই বোঝা যায় কাঁচা। মাঝে মাঝে সে লেখা পড়বারও দরকার হয় না। পাণ্ডুলিপির চেহারা দেখেই সুপ্রকাশ তাকে বাতিল করে দেন। শুধু পাণ্ডুলিপির চেহারা কেন, সময় সময় লেখকের নাম থেকেই বোঝা যায়, সে লেখা পড়ে লাভ নেই। নদেরচাঁদ ভড় বলে এক ভদ্রলোক তিনচারখানা গল্প পাঠিয়েছেন, সঙ্গে ডাকটিকিট। সুপ্রকাশ সেগুলো না পড়েই ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছেন। নদেরচাঁদ ভড় যার নাম সে লেখকের কাছ থেকে সুপ্রকাশ কিছু আশা করেন না। তাছাড়া পাণ্ডুলিপিও অপরিচ্ছন্ন।’ ঠিক এইভাবেই তিনি একই যুক্তিতে আগে খারিজ করেছেন বটকেষ্ট হোড়, নকুড়চন্দ্র হাতি, গজানন আইচের লেখা। গল্পকার বলেন, সুপ্রকাশের ধারণায় ‘তার মন বলেছে লেখকের নামের সঙ্গে লেখার উৎকর্ষের একটা সামঞ্জস্য থাকে। উৎকট নামের ভালো লেখক আশা করা ভুল।’

আরও পড়ুন
তারিণীখুড়োর পঞ্চভূত

শিশু সাহিত্যিক গল্পের অলংকরণ।

 

আরও পড়ুন
গল্পকার তারিণীখুড়োর গল্প

এই জায়গা থেকেই এই গল্পের কাহিনির মোচড়। কারণ, এই গল্পের শেষে জানা যায়, তার কাছে উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায় নাম নিয়ে পরে যে-লোকটি আসে, তার লেখা সুপ্রকাশের বেশ পছন্দ হয়--- আর জানা যায়, এই উজ্জ্বল বন্দ্যোপাধ্যায়ই হল সুপ্রকাশের কাছে সেই বাতিল-হওয়া লেখক নদেরচাঁদ ভড়। গল্পে দুসরা ক্লাইম্যাক্স বাকি ছিল তখনো। কারণ, এক্কেবারে শেষে জানা গেল, ওই নদেরচাঁদ ভড় আবার সুপ্রকাশের ছোটোবেলার স্কুলের এক ক্লাস নীচে-পড়া জুনিয়ার আর নদেরচাঁদ জানে এই সুপ্রকাশ সেনগুপ্তের আসল নাম ছিল ‘নিধিরাম ধাড়া’, ছেলেবেলায় তাকে সে ডাকত ‘নিধুদা’ বলে। তাই কাহিনির শেষে ‘বহুরূপী’ অফিস থেকে বেরোবার সময় নদেরচাঁদ বলে যায়, ‘আপনাকে নিধুদা বলছি বলে কিছু মনে করবেন না।’

তবে নামকরণেও শব্দ নিয়ে খেলা কিছু কম নয়, নিধিরাম নিজের নামকে আধুনিক করতে বেছে নিল ‘সুপ্রকাশ সেনগুপ্ত’ নাম। এক্কেবারে আরিক অর্থে যথার্থ নামই বটে। লক্ষণীয়, ‘সুপ্রকাশ সেনগুপ্ত’। নামটি সুপ্রকাশিত করাই লক্ষ্য বলেই বুঝি নাম তার সু-প্রকাশ। আর ‘গুপ্ত’ তো বটেই---  আসল নামটাকে যে নিজেই গুপ্ত করে রেখেছেন সম্পাদক সেনগুপ্ত মশাই। পরের কিস্তিতে সত্যজিতের কাহিনির এমনই এক নামাবলির শব্দ-মজা লক্ষ করা যাবে।  

Powered by Froala Editor