দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা - হুকার, ক্যাম্পবেল ও পাগলা দেওয়ান

সময়ভ্রমণ - ৩৪
আগের পর্বে

১৯৩৩ সালে অ্যান্ডারসন হত্যা মামলা আদালতে ওঠে। দীর্ঘ শুনানির পর ৭ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেন বিচারপতি ডার্বিশায়ার। রায়ে বলা হয় ষড়যন্ত্রের মূল দোষী মনোরঞ্জন ব্যানার্জি। সেই উজ্জ্বলাকে বিপথে নিয়ে যায়। এমনকি এই সম্পর্কের পিছনে আসলে ব্যক্তিগত চাহিদা ছিল বলেও জানান ডার্বিশায়ার। বুঝতে অসুবিধা হয় না, বিচারপতির রায়ে ভিক্টোরিয় পিতৃতন্ত্রের প্রভাব স্পষ্ট। ৭ জন অপরাধীর মধ্যে তিনজনের বিরুদ্ধে অবশ্য প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ ছিল না। তাঁরা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। তবে জেরার মুখেও ভবাণী ভট্টাচার্যের মধ্যে কোনো অনুতাপ ছিল না। পরে কলকাতা গোয়েন্দা পুলিশের দপ্তর অ্যান্ডার্সন হাউসের নাম বদলে ভবানী ভবন রাখা হয়। তবে এর বেশি আমরা মনে রাখিনি সেই বিপ্লবীকে।

দার্জিলিং-এর চৌরাস্তা অর্থাৎ ম্যাল থেকে আস্তাবলের পাশ দিয়ে খাড়াই রাস্তা চলে যাচ্ছে জলাপাহাড় ছাউনি ও সেন্ট পলস ইস্কুলের দিকে। জলাপাহাড় থেকে অবজার্ভেটরি পাহাড় অবধি যে সংকীর্ণ গিরিশিরা, আদি সায়েবি দার্জিলিং-এর চৌহদ্দি ছিল মোটামুটি ওইটুকু। জলাপাহাড় যাবার পথে সেকারণে অনেক সায়েবদের বাস ছিল। দার্জিলিং থেকে সায়েববাস উবে গেছে বহুযুগ, তবে সায়েববাসা থেকে গেছে একাধিক। সেগুলোর বেশির ভাগই জীর্ণ, বৃদ্ধ, লোল। দেয়ালে ফাট ধরছে, চিমনি একদিকে হেলে, সামনের লনে আগাছার ভিড়, জানলার কাচে ঠান্ডা আটকানোর জন্য কাগজ পিজবোর্ড ইত্যাদি, ছেঁড়াখোঁড়া ছাদে লালনীলকালো প্লাস্টিক। বাড়িগুলোয় ঢোকার মুখে যে বড় দরজা, সেখানে আবছা অস্পষ্ট হয়ে আসা বাড়ির বাহারি নাম, অমুক কটেজ, তমুক ভিলা। অবশ্য দার্জিলিং-এর পুরোনো গাছপালা প্রকৃতির মতো, এইসব বাড়িগুলোকেও এখন খুঁজে বার করতে হয়। ম্যাল ছাড়ানোর পরই রাস্তার দুধারে উঁচু উঁচু সিড়িঙ্গে বাড়ি, পাহাড় না বেনারসের গলি বুঝে ওঠা যায় না। সেই সব বাড়িগুলোয় এন্তার ছোট বড় হোটেল আর গেস্ট হাউস। যেসব গরিবগুর্বো সায়েব ব্যাকপ্যাকাররা দার্জিলিং দেখতে আসে, তারা সেইখানে ওঠে।

অথচ বছর তিরিশ-পঁয়ত্রিশ কি তারও আগে জলাপাহাড়ের রাস্তাটা নিঃঝুম সুন্দর ছিলো, মনে পড়ে। অনেকটা চড়াই ভেঙে রায় ভিলায় পৌঁছোনো যেতো, সে বাড়িতে চমকে দেবার মতো ঝকঝকে পরিষ্কার একটা ইয়ুথ হস্টেল চালাতেন ওয়ার্ডেন ক্যাপ্টেন মোক্তান। দার্জিলিং গেলে ওখানেই ওঠা হতো, ফলে জলাপাহাড় অঞ্চলে ঘোরাঘুরিও হতো বেশি। একদম ওপরের পাইনবন আর ছাউনি অবধি বিনা বাধায় চলে যাওয়া যেতো। জলাপাহাড়ের চুড়ো থেকে আশপাশের তো বটেই, দূরের পাহাড়ও দিব্যি দেখা যেতো। হয়তো এখনও যায়।

রায় ভিলার আগে পরে দু চারটি পুরোনো বাড়ি কিছু আস্ত অবস্থায় টিঁকে আছে। কেনমিউর পয়েন্ট বলে একটা একতলা বাড়ি খুব মনে ধরেছিলো। সন্ধ্যা নামছিলো, সেসঙ্গে হাল্কা কুয়াশা। বাড়িটার জানলার সার্শিতে মেঘ, টিনের চাল থেকে পাথরের দেয়াল অবধি হলদে লতানো ফুল, সম্ভবত পাহাড়ি গোলাপ। ভিতরে আলো জ্বলছিলো। খোঁজ নিয়ে দেখলাম, কেনমিউর পয়েন্ট বাড়িটার নামডাক ছিলো। বিশ শতকের গোড়ায় দার্জিলিং-এর ডেপুটি কমিশনার সেখানে থাকতেন, পরে গ্যাজেটিয়ার রচয়িতা এ জে ড্যাশও। যতদূর জানা যায়, বাঙালিদের হাতেও বাড়িটা গিয়েছিল। মনে হচ্ছে, কোথাও একটা দেখেছিলাম, শিল্পী রনেন আয়ন দত্ত কেনমিউর পয়েন্টে থাকতেন। হতে পারে, নাও হতে পারে।

জলাপাহাড়ের পথ, যেটাকে এখন জাকির হোসেন রোড নামে ডাকা হয়, তার শুরুতেই ডানহাতে আর একটা ঐতিহাসিক বাড়ি আছে। দার্জিলিং-এর সর্বময় কর্তা ও স্রষ্টা, প্রবাদপ্রতিম ক্যাম্পবেল সাহেব ওই বাড়িটায় থাকতেন। সে অনেককাল আগের কথা। এখন সে বাড়িতে দার্জিলিং-এর পুলিশ সুপার সায়েব থাকেন, ঢোকা বারণ। বাড়িতে নীল সাদা রং পড়েছে। পুরোনো বাড়িগুলোকে সরকারি আমলাদের মর্জির ওপর কেন ছেড়ে রাখা হয়, কে জানে। দার্জিলিংয়ে সারা বছর গুচ্ছের লোক বেড়াতে আসে, রাজস্মৃতি(রাজ মেমরিজ) ও হেরিটেজ কলরবে পাহাড় মুখরিত, কিন্তু গোটা শহরের কোথাও পুরোনো বাড়িঘর রাস্তাঘাট নিয়ে কিচ্ছু বলা নেই। সায়েবদের আগের কথার তো প্রশ্নই আসে না(কিছু ছিলোই না), সায়েবসময়টাও প্রায় নিশ্চিহ্ন। খাড়া খাড়া খোঁচা খোঁচা বাড়ি উঠছে তো উঠছেই। অবিরল আমোদ চলিতেছে ও পাহাড় কেটে মাটি খুঁড়ে হলুদ যন্ত্রের গোঁগোঁ।

আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর গপ্পোগাছা (তিন)

সরকারি ও অন্যান্য 'হেরিটেজ' বয়ানে সন্ধান পাওয়া যায় না, অথচ ক্যাম্পবেলের বন্ধু ও দার্জিলিং-এর সায়েবেতিহাসের সঙ্গে অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িয়ে থাকা হুকার সায়েব, অর্থাৎ উদ্ভিদবিদ জোসেফ ডাল্টন হুকারও জলাপাহাড় অঞ্চলে থেকেছিলেন বেশ কিছু দিন। কোম্পানি শাসনের শেষ দিকে, ১৮৪৮ সালে হুকার জলপথে(নৌকোয়), স্থলপথে(ঘোড়ায় ও ডাকগাড়িতে) এবং বায়ুপথে(লোকের কাঁধে চেপে) দার্জিলিং পৌঁছোন। সায়েবি ও নেটিভ সিকিমের পাহাড়বনে অক্লান্ত ঘোরাঘুরি করে যে ভ্রমণবৃত্তান্ত তিনি লেখেন, তা এখনো অবধি দার্জিলিং গবেষক ও সাধারণ ভ্রমনার্থীর অবশ্যপাঠ্য।

আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা (দুই)

হুকার থাকতেন জলাপাহাড়ের চুড়োর কাছাকাছি, পাথর আর কাঠ দিয়ে তৈরি একটা বাড়িতে। সে বাড়ি বানিয়েছিলেন স্বয়ং ব্রায়ান হজসন, যাঁকে ছাড়া প্রাক-সায়েব দার্জিলিং ও সিকিমের নিসর্গের ইতিহাস ভাবা সম্ভবই নয়। হজসনের বাড়িটায় এখন সেন্ট পলস ইস্কুলের রেক্টর থাকেন। বাড়ির সামনে একটা ফলকে পুরোনো কথা লেখা আছে, হজসনের, হুকারের কথা। শ খানেক বছর আগেকার একটা পর্যটনবান্ধব পথনির্দেশিকা বা গাইডবুক(লিখেছিলেন দার্জিলিং পুরসভার তদানীন্তন ইঞ্জিনিয়ার জিও পি রবার্টসন--বইতে দার্জিলিং-এর পুরোনো রাস্তা, বাড়িঘর, হোটেল এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আছে) থেকে জানা গেল, ১৮৬৪তে দার্জিলিংয়ে স্কুল শুরু হবার আগে, সেন্ট পলসের পুরো জমিটাই হজসনের কাছ থেকে কেনা হয়। সেসব আপাতত পুরোনো, বাতিল কথা। আজকের দার্জিলিংয়ে হুকারের নামে একটা রাস্তা আছে। বার্চ হিলের কাছে সেই রাস্তাটা নিচের লেবঙ রাস্তায় নেমেছে। এই অঞ্চলে হুকার কোনোকালে থেকেছেন কিনা, তা নিয়ে কিছু জানবার উপায় নেই।

আরও পড়ুন
দার্জিলিংয়ের গপ্পোগাছা

হুকার দার্জিলিং-এ এসেছিলেন গাছ খুঁজতে, নিসর্গ দেখতে। অথচ তাঁর বিখ্যাত হিমালয়ান জর্নল বইটার ছত্রে ছত্রে সায়েবশাসনের জয়ধ্বনি, সাদা-চামড়া ঔপনিবেশিকের সীমাহীন ঔদ্ধত্য। সিকিম হিমালয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে হুকার এবং ক্যাম্পবেল যে অভিযান চালান, তাতে প্রাণীতত্ব উদ্ভিদবিদ্যা ভূগোল সংক্রান্ত অনুসন্ধিৎসা যতটা ছিল, সাম্রাজ্যবিস্তারের ইচ্ছাও ততটাই। অবশ্য এসব সত্ত্বেও, হুকার এবং তাঁর লেখাটাকে স্রেফ ঔপনিবেশিক খোঁয়ারি বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। এমন নয় যে হুকারই প্রথম পূর্ব হিমালয়ের পাহাড়জঙ্গল নিয়ে লিখছেন, বুকানন-হ্যামিলটনের কথা বলা হয়েছে, তাঁর আগে জর্জ বোগল ও স্যামুয়েল টার্নার তিব্বতে ঢুকছেন ভুটান বাক্সাপাহাড় হয়ে, কিছু পরে উদ্ভিদবেত্তা গ্রিফিথ। কিন্তু এঁদের মধ্যে কেউই সিকিম অঞ্চলে আসেননি। তার চাইতেও বড় কথা, এঁরা কেউই হুকারের মতো সুলেখক ছিলেন না, পাহাড়নদী বনজঙ্গল নিসর্গশোভা মানুষজন এই সবটা নিয়ে হিমালয় হুকারের লেখায় যেভাবে উপস্থিত, অন্যদের লেখায় সেভাবে নয়। হুকার সেকারণেই বহুলপঠিত, বহুচর্চিতও বটে। পরের দিকে যে সব সায়েব অভিযাত্রী যত্ন নিয়ে পূর্ব হিমালয়ে ঘুরছেন, যথা এল এ ওয়াডেল ও ফ্রেশফিল্ড, তাঁরা প্রত্যেকেই হুকারের নাম করছেন, বহুক্ষেত্রে আক্ষরিক অর্থেই তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করছেন।

আরও পড়ুন
দার্জিলিং-এর বহু গল্প

১৮৩৯-এ লয়েড দার্জিলিং থেকে অপসারিত হচ্ছেন, ক্যাম্পবেল দায়িত্ব নিচ্ছেন। হুকার আসছেন ১৮৪৮-এ। তাঁর লেখার কোথাও লয়েডের নামগন্ধ নেই, যেন ব্যক্তিটি ছিলেনই না। হুকারের ভাষ্য অনুযায়ী, দার্জিলিং আবিষ্কার করেন গ্র্যান্ট, বাকি যা করার করেন ক্যাম্পবেল। হুকার এবং ক্যাম্পবেল, বিশেষত ক্যাম্পবেল, সিকিমের ভিতর নানান হুজ্জতি ঝামেলায় পড়েন। সে সব ঝামেলায় লয়েডপর্বের ছায়াপাত ছিল। হয়তো সে কারণে, হয়তো লয়েড বিষয়ে ক্যাম্পবেলের অশ্রদ্ধার কারণেও, হুকার লয়েড প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।

হুকার যখন আসছেন, অর্থাৎ লয়েডবিদায় ও ক্যাম্পবেলউদয়ের দশ বছরের মধ্যে, দার্জিলিংপত্তনের কাজ সম্পূর্ণ হয়নি। রাস্তাঘাট তৈরি হয়নি, ঘরবাড়িও। অর্থাৎ বন কাটাই-এর জরুরী কাজটা শেষ হয়নি, এখানে ওখানে বিস্তর বনজঙ্গল থেকে গিয়েছিল। সেই বনের চিত্রময় উপাদেয় বর্ণনা হুকারের লেখায়:

“কার্শিয়াং থেকে খুব খাড়া একটা পাকদণ্ডি পথ পাহাড়ের ওপরে উঠছে, চেস্টনাট, ওয়লনাট, ওক আর লরেলের এক মহনীয় অরণ্যের মধ্য দিয়ে। গাছপালা উদ্ভিদের এর চাইতে বিচিত্রতর ও মহত্তর সমারোহের কথা ভাবাই সম্ভব নয়--কাষ্ঠল গাছগুলোর ঋজু কান্ড সোজা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে, তাদের অনেকেরই গা নগ্ন, পরিষ্কার। কারুর ছাল ধূসর, কারুর বা বাদামি, কারুর ফিকে। বাকিদের গা অবিরল ঢেকে আছে অর্কিডজাতীয় উদ্ভিদের দীর্ঘ ঘন পোশাকে, পুষ্পের পুঞ্জ যেন বা, বিশেষত সাদা অর্কিড ফুটে আছে সর্বত্র, মনে হচ্ছে যেন গাছের গায়ে বরফ পড়েছে।”

'পাছিম' বলে একটা জায়গায় রাত কাটিয়ে হুকার দার্জিলিং-এর দিকে যান। সে পথের বন ভরে ছিল 'ইংরেজ-দর্শন' গাছে। এক ধরণের সাদা রডোডেনড্রনের কথা বলছেন হুকার, যার 'বিশাল ও মনোরম' লেবুগন্ধ পাঁপড়িতে বনতল ছেয়ে ছিল। বনে যা গাছ, তার অর্ধেক ওক, এক চতুর্থাংশ ম্যাগনোলিয়া। বাকির মধ্যে বার্চ, অ্যালডার, ম্যাপল, হলি ইত্যাদি।

হুকার দার্জিলিং পৌঁছচ্ছেন ১৬ই এপ্রিল। হজসন তখনো আসেননি, অথবা হুকার প্রথমেই তাঁর সঙ্গে ছিলেন না। জনৈক চার্লস বার্নেস একটা মেস চালাতেন, হুকার সেখানে ওঠেন। সায়েবরা সেসময় বিস্তর চাকরবাকর নিয়ে পাহাড়ে উঠত। হুকারের ধারণা ছিল, দার্জিলিং-এ সর্বসুবিধাযুক্ত হোটেল ইত্যাদি মওজুদ, ফলে তিনি লোকলস্কর নিয়ে আসেননি।

হুকারের বক্তব্য, সিকিম হিমালয়ে কোম্পানি সরকার যে ঢুকেছিল তার প্রধান কারণ, নেপালকে আটকানোর দরকার ছিল। সিকিম থেকে নেপালি সেনাদের না তাড়ালে তারা সিকিম ভুটান এমনকি বার্মা অবধি পুরো হিমালয় দখল করে নিতে পারত। সে সময় এমন ভাববার কারণও ছিল। নেপালি গোর্খাদের সঙ্গে কোম্পানির সবেমাত্র যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে, পূর্ব কুমায়ুনের কালি নদী থেকে মোরাং-এর মেচি নদী অবধি বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকা বরাবর কোম্পানিরাজত্বের ভিতরে ও কোম্পানিবন্ধু দিশি রাজাদের এলাকায় ঢুকে আসছে গোর্খারা। বনজঙ্গল নদীপাহাড়ে সমাচ্ছন্ন দুর্জ্ঞেয় ও রহস্যাবৃত হিমালয়ে সবে কোম্পানিসরকারের পা পড়েছে, কোথায় কি বিপদ লুকিয়ে কেউ জানে না। হিমালয়ের সীমান্ত বরাবর যে সব সায়েবি হিল স্টেশন গড়ে উঠল, তারা যে একাধারে সেনাছাউনি ও স্বাস্থ্যাবাস, তার একাধিক কারণ ছিল। সমতল ভারতের বিচ্ছিরি গরম, পোকামাকড় রোগজারি ও নোংরা নেটিভদের থেকে বহুদূরে সুরক্ষিত, শোভন ও 'সায়েবি' নিসর্গের নির্মাণ প্রয়োজন হয়ে পড়ল। কোম্পানি সরকার এবং তার আমলাকর্মচারীদের, এবং সায়েব ও সায়েবকল্প দিশি বেনিয়াদের কাছে নতুন পাহাড়ি শহরগুলো হয়ে উঠল ছুটি কাটানোর জায়গা, শাসনকেন্দ্র ও নিরাপদ 'মধ্যাঞ্চল' বা 'বাফার'। বাফার কথাটা বিশেষভাবে খেয়াল করা দরকার। একদিকে, সমতলের বহুশত্রু, অন্যদিকে পাহাড়ের অজানা বিপদ, তা নেপালি গোর্খারা হতে পারে, কিম্বা ভুটানি দস্যুরা, বা আরো মারাত্মক, তিব্বতী সেনাদল। যে বিপদ জানা তার মোকাবিলা করা যায়। যা জানা নয় তা বহুগুণ আতঙ্কের। তিব্বতী ভয়ঙ্করের আতঙ্ক প্রায় একশো বছরের বেশি সময় ধরে ব্রিটিশদের তাড়া করে বেরিয়েছে। ফ্রান্সিস ইয়ং হজব্যান্ড যখন খামোখাই বিশাল সেনাদল ও কামানবন্দুক নিয়ে লাসা অবধি পৌঁছে যাচ্ছেন, প্রচুর রক্তপাত ভাঙচুর ঘটাচ্ছেন, পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে তিব্বতীরা সামরিক শক্তিতে অতীব হীনবল, ব্রিটিশরা হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে দার্জিলিং-এ ফিরে আসছে, তারপর থেকে কোনো ইউরোপীয়কে তিব্বত প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না, এমনকি স্বয়ং স্বেন হেদিনকে সিমলায় ঘাঁটি ঘিরে বসে থাকতে হয়েছিলো প্রায় বছর খানেক। শেষমেশ তিনি লুকিয়ে তিব্বতে ঢোকেন, তিব্বতী মালভূমি পেরিয়ে তাঁর বিখ্যাত ট্রান্স হিমালয়ান অভিযানের সূচনা হয়।

হুকার, ক্যাম্পবেল ও সিকিমের পাগলা দেওয়ান, এই তিন চরিত্র মিলিয়ে যে গল্প তৈরি হয়, তা বহুকথিত, বহুশ্রুত, দার্জিলিং-এর যাবতীয় গ্যাজেটিয়ার ও সরকারি-বেসরকারি ইতিহাসে তার উল্লেখ পাওয়া যাবে। এখানে সে গল্পে বিশদ কালক্ষেপ করার প্রয়োজন নেই। মোদ্দা বিষয় হল, দার্জিলিং অঞ্চলে তাঁর দ্বিতীয় ভ্রমণকালে, ১৮৪৯-এর শেষদিকে, হুকার সিকিম হয়ে পূর্ব নেপালে ঢোকেন। অনটু এলাকা, অর্থাৎ ইলাম অঞ্চলে তখনো টেরিং কাজি ও তার লেপচা প্রজারা বসবাস করছে। কাজি হুকারকে ভেট ইত্যাদি দিয়ে সনির্বন্ধ অনুরোধ করে যেন তাকে দার্জিলিং-এ ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার যে মুখ নেপালে পড়ছে, সেখানে কাঙবাচেন উপত্যকা ঘুরে ফিরবার পথে হুকার ও ক্যাম্পবেল তিস্তার পারে রাজসন্দর্শনে যান। তার পরে কী ঘটে, কিভাবে সিকিমের ইতিহাস চিরকালের মতো বদলে যায়, সে গল্প পরেরবার।

Powered by Froala Editor