ময়দানের দিকে প্রথম পা

সূর্যের মুখোমুখি হত সূর্যমুখীরা। ফুলগুলি তার ঘাড় ঘুরিয়ে সারাদিন সূর্যকে অনুসরণ করত। ঠিক ছায়ায় মতো। ছায়া যেমন সঙ্গে সঙ্গে চলে... প্রথম সূর্যমুখী চেনা তখনই। গোপেশ্বর দত্ত রাজবাড়ির কেয়ারটাকারকাকুর গাছের শখ। তার সন্তানের মতোই সূর্যমুখীরাও। আমরা যখন মাঠে যেতাম, দেখতাম অজগরের মতো লম্বা জলের পাইপ দিয়ে জল দিচ্ছে। পাইপে পা পড়লেই তার মগ নিয়ে সে কী হইচই! তখনকার এইসব দক্ষযজ্ঞ, এখনকার আমি হয়ে ওঠার সূত্র। সূর্যমুখী ক্ষেতের পাশে মাঠের মতো যে ফাঁকা জায়গাটা, সেখানেই প্রথমবার সামনে থেকে রাম-লক্ষ্মণ-কর্ণ-অর্জুনদের দেখা। তিরধনুক নিয়ে দূরে রাখা গোলাকার রামধনুকে তাগ করত ওরা। পরে জেনেছি, ওটা চাঁদমারি। আর ওরা তিরন্দাজি খেলে। তিরধনুকও যে খেলা, সেটাও প্রথম জানা তখনই। তিরন্দাজির মাঠের পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা চলে গেছে। রাস্তার বাঁ-পাশে গোপেশ্বর দত্ত ফ্রি স্কুল। তার আগে মাঠ। এখানেই ফুটবল শেখায় সুব্রত মিশ্র (ভ্যাকালুদা)। 

আমার মা-বাবা ভ্যাকালুদার ফুটবল সেন্টারে ভর্তি করিয়ে দেন আমায়। অনেকে তার এই মাঠকে বলত, ‘ফুটবলার তৈরির টোল’। সকালে স্কুল আর বিকেলে মাঠ— এই ছিল সোম থেকে শনিবারের বাঁধা-ধরা রুটিন। সুব্রতকাকু বলত, ‘ফুটবল জীবনের মতো। আর এই জীবনের জন্য দরকার পরিশ্রম ও শৃঙ্খলা।’ কিন্তু আমার মতো ভীতু অথচ ফাঁকিবাজ ছোকরা ভ্যাকালুদার এসব নীতিকথা কেনই বা পাত্তা দেবে! তাই সে হ্রস্বতর পথ খুঁজত। হ্রস্বতর পথ অর্থাৎ শর্টকাট। হামেশাই ভুল করতাম মাঠে। পায়ে হাত দিয়ে ভ্যাকালুদা ইনস্টেপ, আউটস্টেপ বোঝাত পইপই করে। বল রিসিভ করা, এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, কাটানোর টেকনিক, ড্রিবলিং, স্কিল ডেভালপমেন্ট নিয়ে সে যখন ক্লাস নিত ভাবতাম এ বান্দার জন্য বোধহয় ফুটবল নয়। একদিন তো প্র্যাকটিসে বড় ভুল হতেই ভ্যাকালুদা নিয়ে গেল ‘কারেন্ট ঘরে’। তখনও বুঝিনি যে, ওই ঘরে শাস্তি হয়। গোপেশ্বর দত্ত স্কুলেরই একতলায় এই কারেন্ট ঘর ছিল। ‘এবার হাত পাত...’ চার-পাঁচ ঘা বেতের বাড়ি। বেত্রাঘাতের পর ভ্যাকালুদা হররোজই বলত, ‘নে এবার ভেজানো কাঁচা বাদাম আর ছোলা খেয়ে নে।’ একবার তো ক্ষেপে গিয়ে বলে উঠেছিলাম, ‘আমি ঘোড়া নাকি?’ কোচের উত্তর ছিল— ‘অনেক গরম দিয়েছি, এবার মলম দিলাম।’ তারপর কোলে তুলে নিয়ে আদর করত। ঠিক যেন পিতৃস্নেহ।

এই ছিল আমাদের কোচ। সুব্রত মিশ্র। তাঁকে নিয়ে লেখার কেউ নেই। বলারও... একদিন ফোন আসে তাঁর। বলেন, ‘তোর ধারাবাহিকটা পড়ছি। আমাকে নিয়ে লিখবি?’

আরও পড়ুন
লোকালে আর গ্লোবালে বাঙালির ফুটবল

বলি, ‘তোমাকে নিয়ে লিখতে গেলে তো ফিচার লিখতে হবে। কিন্তু আমি তো তা লিখছি না। লিখছি মাঠে ময়দানের ফুটবল নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা। যদি তোমাকে লিখি, আমার চোখে আমার কোচ কেমন সেসব লিখব।’ 

আরও পড়ুন
ময়দানি কুইজিন

―চলে আয় একদিন।

আরও পড়ুন
সশরীরে বিশ্বকাপে

আরও পড়ুন
৯ ডিসেম্বরের বাতিল ডার্বি: মাঠ থেকে দূরে অথচ মাঠের এত কাছে


ফোন কেটে যায়। সেই থেকে ভাবতে শুরু করি, ভ্যাকালুদাকে নিয়ে লিখব অথচ সেখানে কেবল আখোদেখা অভিজ্ঞতার দোহাই দেব? ব্যক্তিগত নিবন্ধে কিছুটা ফিচারের আঙ্গিক ঢোকালেও তো ডালে চালে মিশ খায়। মন্দ হবে না এভাবে লিখলে। ঠিক করি, এভাবেই লিখব। যখন তার কাছে যাই, কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এ লেখা দিয়ে ‘পায়ে পায়ে ময়দানে’র শুরু হতে পারত। তবে আপাতত সাঙ্গ হবে তাঁর কথা লিখেই।

ততক্ষণে অবশ্য আমার ছোটবেলার একগুচ্ছ ছবি পাঠিয়ে মনটাকে স্মৃতির সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে ভ্যাকালুদা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোচকে আমি দু’ভাবে ডাকতাম― সুব্রতকাকু ও ভ্যাকালুদা। মানে, একই আত্মীয়তার বন্ধনে সে আমার কাকা ও দাদা। হাহাহা... যাইহোক, ভাসা-ভাসা মনে আছে, আমাদের সময় খেলতে আসত ঝন্টু, ছোটন, পিনাকী, প্রীতমরা। এরা সব বন্ধু হয়ে উঠেছিল। স্কুলের চার দেওয়াল আমাকে কখনোই খুব একটা ঘায়েল করতে পারত না। কারণ একটাই, বিকেলের মাঠ। মাঠে গেলে ফের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে। পিটি হবে। খেলাও হবে। তাই গোটা সপ্তাহটা নানান রুটিনের মধ্যে থেকেও আনন্দে কাটত। রবিবার ছিল ছুটির দিন। খুদে মন সব সময়ই ছুটি স্পর্শে মেতে ওঠে। অথচ আমাদের ক্ষেত্রে ঘটত উল্টোটা। রবিবার মাঠ হবে না বলে মনখারাপটা একপ্রকার অভ্যাসে পরিণত। একটা রবিবার যেন সপ্তাহের বাকি ছ’টা দিনের থেকেও দীর্ঘ। 


একটা রগড়ের কথা বলি। অদ্ভুতুড়ে গোত্রের আমার নানান বাহানা ছিল। পিটি করব না অথচ খেলতে নামব। যোগাসনের তালিকায় ছিল অর্ধনাবাসন, অর্ধচন্দ্রাসন, অঞ্জলি মুদ্রা, ধনুরাসন, ভুজঙ্গাসন, চক্রাসন, পদ্মাসন, হস্তপদ্মাসন ইত্যাদি। এগুলো কেবল মাঠেই নয়, হোমটাস্কও দেওয়া হত। মাঠে বেতের ভয়ে আসনগুলান করলেও বাড়িতে নৈব নৈব চ। কিন্তু বাড়িতেও একপ্রকার জোর করে ধরেবেঁধে যোগাসনগুলো রপ্ত করতে বসিয়ে দিত মা। কাঠের স্কেল নিয়ে মা বলত, ‘বসবি না মানে! ঘাড় বসবে।’ মাঠে বেত আর বাড়িতে কাঠের স্কেল— কেমন যেন একটা খণ্ডযুদ্ধের মতো ব্যাপার। কিন্তু এই স্মৃতির অতীত এখন আমার কাছে দ্বিতীয় হৃৎপিণ্ড। যার সিংহভাগটা জুড়েই কোচ সুব্রত মিশ্র ওরফ ভ্যাকালুদা। ক’দিন আগেই তো সে আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে কিংবদন্তি শৈলেন মান্নার সঙ্গে আমার ছবি পাঠিয়ে চমকে দিয়েছিল। নিজেই জানতাম না, অমন মানুষের সঙ্গে আমার ছবি রয়েছে। ছবিটি পয়লা বৈশাখে বারপুজোর দিন তোলা। ধারাবাহিকটির ‘মান্না পাঁচালি’ পর্বে সেসব লিখেছি।


কেমন আমাদের কোচ? বাবা অনিল কুমার মিশ্রও ছিলেন একজন ফুটবলার। তাঁর কাছ থেকেই অনুপ্রেরণা। বলা যেতে পারে, পারিবারিক উত্তরাধিকার তিনি বহন করে চলেছেন। সিঁথি ফুটবল কোচিং সেন্টারের কিশোর ও তরুণ ফুটবলাররা বিভিন্ন টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে সাফল্য পাচ্ছে। যদিও সাফল্যের পিছনে রয়েছে নানান প্রতিকূলতা। সুব্রতকাকু জানাল, উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবে এই কোচিং সেন্টার পরিচালনা করতে সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে। তবে বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও থমকে যায়নি তা ফুটবলার তৈরির এই টোল। এর অনেকটাই কৃতিত্ব প্রাপ্ত সিঁথি ফুটবল কোচিং সেন্টারের ‘চিফ পেট্রন’ পশুপতি রায়ের। ছোট ছোট ছেলেদের এই মাঠে খেলার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁকে সকলেই অভিভাবক হিসাবে দেখেন। অসম্ভব শ্রদ্ধার এই মানুষটি না-থাকলে এই মাঠকে কেন্দ্র করে এমন আয়োজন হয়তো সম্ভবই হত না। অন্যদিকে, নিজের ফুটবল কোচিং সেন্টারের পাশাপাশি একটি অনাথ আশ্রমের ছেলেদের নিয়ে ফুটবল প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। অনাথ ছেলেদের নিয়মিত ফুটবল প্রশিক্ষণ দেয় সুব্রতকাকু। 


তবে, প্রমাণ সাইজের একটা মাঠ পেলে আরও ভালোভাবে এই কোচিং সেন্টার চালাতে পারত ভ্যাকালুদা। পেশা হিসাবে ছোটখাটো ব্যবসা রয়েছে তার। ব্যবসা থেকে আয়ের অধিকাংশ অর্থই ব্যয় হয়ে যায় ফুটবল কোচিং সেন্টার চালাতে। খেলোয়াড়ি জীবনে অনেক চাকরির সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু মাঠ অন্তপ্রাণ মানুষটি চাকরির সুযোগ গ্রহণ করেনি। খুদে, জুনিয়র, সিনিয়রদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য এই মাঠে অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন তিনি। নিজে খেলা শিখত পটা গুপ্ত গোলকিপিং কোচিং সেন্টারে, যা ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের সামনে। এখন কালের নিয়মে সেই সেন্টার নেই। প্র্যাকটিস করত দেবু মুখার্জি, গৌতম সরকারের সঙ্গে। বেলেঘাটা ফ্রেন্ডস, রবার্ট হাটসন, গ্রেইল, হাওড়া ডিস্ট্রিক্ট সালকিয়া দূর্বাদল সহ বিভিন্ন ক্লাবে দাপিয়ে ফুটবলই কেবল খেলেনি, ক্যাপ্টেনসিও করেছে ভ্যাকালুদা। আর আজ তাঁর এই ট্রেনিং সেন্টার থেকে বিজয় হেম্ব্রম খেলেছেন ঐক্য সম্মিলনীতে, অনুপম পাত্র তালতলা ইন্সটিটিউটে, জয়ন্ত ঘোষ খেলেছেন কলকাতা পুলিশে। আরও বহু প্রতিভাই সুযোগ পেয়েছেন শহরের নামজাদা ক্লাবে। বাংলার ফুটবল জগতে আরও কিছু ফুটবল প্রতিভাকে তুলে ধরতে বহু প্রতিকূলতার মধ্যেও নিরলসভাবে কাজ করছে সুব্রত মিশ্র। মতি নন্দীর ক্ষিদ্দারা এখনও যে মাঠে-ময়দানে জীবন্ত, ভ্যাকালুদার জীবন এবং যাপন সম্ভবত তার বলিষ্ঠ প্রমাণ।

Powered by Froala Editor