৯ ডিসেম্বরের বাতিল ডার্বি: মাঠ থেকে দূরে অথচ মাঠের এত কাছে

তারকেশ্বরের রেল গেটের কাছাকাছি কালিপদ পালের বহুরূপী সেন্টার। বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ-সহ বহু দেবদেবীর আকর্ষণীয় পোশাক পাওয়া যায় সেখানে। তখন মুখোশ নিয়ে কাজ করছি। ‘ঐহিক’ পত্রিকার ‘মুখ ও মুখোশ’ সংখ্যা বেরোবে। পত্রিকার সম্পাদক তমাল রায়, তাঁর স্ত্রী ও তাঁদের কন্যা মহুলও ছিল আমাদের সঙ্গে ওই সফরে। কালিপদ বহুরূপীর সঙ্গে কথা বলে আমরা গাড়িতে উঠেছি। পিছনের সিটে বসে তমালদা, বউদি ও মহুল। আমি ড্রাইভারের পাশে বসে শহরতলি দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি।এতক্ষণ এক প্রথিতযশা বহুরূপীর সঙ্গ পেয়ে মন ফুরফুরে। কিন্তু এত সবকিছুর পরেও সকাল থেকেই চাপা একটা চাপ ছিল। সেই দিনটায় মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচ। তমালদাদের অন্যদিন হত না বলে ২০১২-র ডিসেম্বরের ৯ তারিখটাকেই বেছে নিতে হয়েছিল অগত্যা। মাঠে যেতে পারিনি। যাইহোক, কাজের ক্ষেত্রে নো কম্প্রোমাইজ। তাই কালিপদ বহুরূপীর সঙ্গে কথা সেরে চারিদিকটা ইতিউতি দেখতে দেখতে আমরা এবার চলেছি তমালদার এক বন্ধুর বাড়ি। গোটা রাস্তায় মাঝেমাঝেই, প্রায় ডজনখানেকবার বলেছি, আমার কিন্তু বিকেলে ডার্বি দেখা চাই। আর এমন পিতৃতুল্য সম্পাদক পাওয়াটাও সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। আমাকে বারবার গদ্য লেখার জন্য উৎসাহিত করা মানুষটি কিন্তু তিনিই। এক্ষেত্রেও আমার আবদার মেনে নিয়েছিলেন। সেই বন্ধুর বাড়ি যেতে গিয়ে বউদি হঠাৎ বাড়ি থেকে চিৎকার করে উঠলেন। “ওই দেখ, ওই দেখ, গাড়ি থামাও...!” রাস্তা পার হচ্ছিল খুদে শিবঠাকুর। হাঁক দিতেই জানলার কাছে এলো। তাকে বললাম আমাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠে পড়তে। সে তো কিছুতেই যাবে না। বললাম, “ভয় নেই রে। চল। তুই আমাদের তোর গ্রামে নিয়ে যাবি।” কিন্তু সটান জানিয়ে দেয়, “তোমাদের সাথে গেলে আমার ভাত জুটবে না যে!” তবে আমাদের কাছ থেকে ব্যবস্থার আশ্বাস পেয়ে অবশেষে সেই খুদে শিব রাজি। গাড়িতে আর-একজন লোক বাড়ল। একেবারে সে আমার কোলেই বসে পড়ল! খুদে ওই বহুরূপীর নাম রাজু। মা বোনের মুখে ভাত তুলে দিতে রাজুর আর ছোটবেলা বলে কিছু নেই। ওর বাবা ফেরার হয়েছে অন্য 'মেয়েছেলে'কে বিয়ে করে। মা ঝি-গিরি করে। আর রাজু শিবঠাকুর সেজে শিবঠাকুরের এই আপন দেশে ঘুরে বেড়ায়। লোকজন ইচ্ছে হলে কিছু দেয়। আর তা তুলে দেয় ওর মাকে। ওর গ্রাম আসতেই একটা চায়ের দোকানে বসলাম। চায়ের দোকানের থেকে সামান্য দূরে শ্রীনাথ বহুরূপী। ওখানেই ও সাজে। কখনো শিব, কখনো কালী। চায়ের দোকানেই আমরা আপাতত পেটে মুখে কিছু দিতে দিতে রাজুর সঙ্গে কথা বলব। এরই ফাঁকে অদ্ভুত এক কথা শোনাল রাজু। কালী সাজার রেট বেশি। ৭০ টাকা! ভারী সাজ তো। রং লাগে অনেক। প্রচুর গয়নাগাটিও লাগে। তবে ঘটনা হল, আমাদের বাতচিতে বাধা পড়ছিল মাঝেমাঝে। কারণ হাইরোড দিয়ে লোক উপচানো ম্যাটাডোর ছুটে যাচ্ছিল কলকাতার যুবভারতীর দিকে। হইহই করতে করতে। তাদের মুখে ছিল স্লোগান। আমারও মনোযোগ ভেঙে যাচ্ছিল। বড়ো ম্যাচের দিন হলে যা হয় আর কি। এরই ফাঁকে রাজু বলে উঠল, আজ মোহনবাগানের খেলা। নিরতিশয় চমকে উঠেছিলাম। এই একরত্তি রাজু মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল জানে! অথচ এই ছোট্ট বয়সেই বাস্তবের চপেটাঘাতে বিক্রি করতে শিখে গিয়েছে পেশা। আমরি বাংলাদেশে এও এক খণ্ডচিত্র। সেখানে ইচ্ছা আছে, উৎসাহ আছে, খেলা নিয়ে পাগলামি আছে। কিন্তু অনেকেরই এই ইচ্ছা আর উৎসাহ নিয়ে বেঁচে থাকার আনন্দ নেই। নেই কথাগুলো এখনকার কান্না বিক্রি করা রিয়েলিটি শোয়ের মতো নয়। আর বাস্তবটাকে বোকা বাক্সে বন্ধও করা যায় না। তবে, আপাতত কথা ‘বন্ধ’ করে এগোলাম।

খেলা ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে। তমালদার বন্ধুর বাড়ি দ্বিপ্রাহরিক আহার সারতে সারতে খেলাও গিলছি। দুলকি চালেই চলছে প্রথমার্ধ। কিন্তু এরপর যা ঘটল, বড়ো ম্যাচে তেমনটা ঘটতে আমি আগে কখনো দেখিনি। ৪৩ মিনিটে মেহতাব হোসেনের ফ্রিকিক থেকে গোল করেছেন ইস্টবেঙ্গলের হরমনজোত খাবড়া। এর পরেই তাল কাটে। গোলের ঠিক পরে পরেই খাবড়াকে ফাউল করে বসেন মোহনবাগানের নির্মল ছেত্রী। রেফারি বিষ্ণু চৌহান ছেত্রীকে সতর্ক করে দেন। রেফারির এমন সিদ্ধান্ততে সন্তুষ্ট হতে পারেননি ওডাফা ওকেলি। তিনি এগিয়ে এসে রেফারির সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন। তর্কে আচমটাই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে মোহনবাগানের অন্যতম সেরা গোল স্কোরার ওডাফাকে লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন রেফারি। তেতে ওঠে গোটা স্টেডিয়াম। মাঠেই প্রতিবাদ জানাতে থাকেন ওডাফা। তাঁর দল এক গোলে পিছিয়ে। রেফারির এই সিদ্ধান্ত মোহনবাগানকে ১০ জনে নামিয়ে এনেছে। কিছুতেই মাঠ ছেড়ে যেতে চাইছিলেন না। মোহনবাগানের সহ-খেলোয়াড়রাও রেফারিকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। এমন অবস্থায় মোহনবাগানের ইউটিলিটি প্লেয়ার রহিম নবিকে ডান গালে হাত দিয়ে বসে পড়তে দেখা যায়। রক্ত ঝরছে সেখান দিয়ে। গ্যালারি থেকে ইটের টুকরো এসে সজোরে আঘাত করেছে নবির গালে। প্রবল এক সন্ত্রস্ত পরিবেশ। অ্যাম্বুলেন্স করে তাঁকে তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। গ্যালারিতে গণ্ডগোল। আমি ভাতের থালা সরিয়ে রেখে শুভ্রাংশুদাকে ফোনে ধরার করলাম। বলল, “ভয়ানক অবস্থা... আরেকটা না ১৬ আগস্ট...” ফোন কেটে যায়। পরে অন্তত দু’ঘণ্টা তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। যেটুকু তার কথা শুনতে পেলাম পটভূমিতে পরিত্রাহি চিৎকারের শব্দ। সেদিন দ্বিতীয়ার্ধে দল নামাতে অস্বীকার করে মোহনবাগান। বাতিল হয়ে যায় ম্যাচ। প্রসঙ্গত, ১৬ আগস্ট, ১৯৮০ বড়ো ম্যাচের ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার দিন হিসেবে রয়ে গেছে। ইডেন গার্ডেন্সে হওয়া ডার্বিতে পদদলিত হয়ে ১৬ জন সমর্থক নিহত হয়েছিলেন।


২০১২-তে আরও একটা গণ হিস্টিরিয়া তৈরি হতে পারত। আর যদি সত্যিই তেমন হত, তাহলে দায়িত্ব কে নিতেন? এই প্রশ্নের উত্তর মেলা ভার। বিরতির পর দল না নামানোয় ‘রণছোড়’ আখ্যা পেয়েছে মোহনবাগান। এআইএফএফ-এর ২২ নম্বর ক্লজে ‘দোষী’ও মোহনবাগান। মাঝপথে দল তুলে নেওয়াকে আইনি পরিভাষায় বলা হয় ‘ফোর্স ম্যাজেউর’। এর জন্য বড়োসড় শাস্তিও মেলে। মোহনবাগানও এর ব্যতিক্রম হয়নি। দু'বছর সাসপেন্ড করে দেওয়া হয় গোষ্ঠ পাল সরণির সবুজ-মেরুন ক্লাবকে। অথচ প্লেয়ারগুলোর কথা কেউ ভাবলেন না। তাঁদের সতীর্থ রহিম নবি হাসপাতালে। এই পরিস্থিতিতে কোন ফুটবলার মাঠে নামতে চাইবেন? পুলিশ অবশ্য সাফাই দিয়েছিল। উৎশৃঙ্খল জনতাকে তারা ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। খোদ রেফারি ‘অবতারে’র মতো মাঠে নামার জন্য মোহনবাগানকে অনুরোধ করেছেন। এমনকী তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের অনুরোধেও অনড় থেকেছে মোহনবাগান। আর এতসবের পর নন্দ ঘোষ হতে হয়েছে কেবল মোহনবাগানকেই। সবুজ-মেরুন ক্লাবের উপর সাসপেনশনের মতো কঠোর শাস্তি আরোপিত হয়। মনে পড়ে, মোহনবাগানের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন মিত্র রহিম নবির চোটের জন্য ওই বড় ম্যাচটির আয়োজক ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের কাছে ক্ষতিপূরণও দাবি করে রেফারির বিরুদ্ধে অভিযোগ হেনে বলেছিলেন, বিষ্ণু চৌহানের নাকি ফিফা ব্যাজই নেই। আরো বলেছিলেন, সর্বভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনের পথে যাবেন। প্রয়োজনে ফিফার দ্বারস্থ হবে। মোহনবাগান যে ফিরে আসবে, সে-কথাও জোর দিয়ে বলেছিলেন।

আরও পড়ুন
স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের দিনলিপি

বিধাননগর থানার পুলিশ দাবি করেছিল, দুষ্কৃতীরা স্টেডিয়ামের কংক্রিটের স্ল্যাব ভেঙে ফেলে। এই স্ল্যাবের টুকরোগুলিই হয়ে ওঠে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র। যার হানায় আঘাত পান নবি। কিন্তু প্রশ্ন হল, স্টেডিয়ামে তো নিরাপত্তার জন্য পুলিশ মোতায়েন ছিল। তাদের চোখে ধোকা দিয়ে দুষ্কৃতীরা স্ল্যাব ভেঙে ফেলল কীভাবে? পুলিশও কি তবে খেলা দেখতে ব্যস্ত ছিল? এর উত্তর হয়তো আজও পাওয়া যাবে না। টিভির পর্দাতেই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল, ঘটনার সময় চকোলেট বোমার গর্জন। তা দর্শক এন্ট্রির সময়ও কি ঠিকমতো চেক করা হয়নি? এমনই অজস্র প্রশ্ন ওঠে সেদিনের ঘটনায়। ৪০ জন আহত হয়েছিল সেদিন। এরমধ্যে ২০ পুলিশ কর্মীও ছিলেন। পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারও ছিলেন আহতদের তালিকায়।

আরও পড়ুন
দলবদল নয় সরগরম 'টিকিট বদল'


আরও পড়ুন
অনামিকা সেন: হুইসেলিংয়ের নেপথ্যে থাকা নিঃশব্দ কাহিনি

তবে, বেশ কয়েকদিন পর রহিম নবির একটা কথা খুবই প্রভাবিত করেছিল। “আমার মৃত্যু হলে মোহনবাগান এত বড় শাস্তি পেত না।” কথাটা এখনও ভাবলে মন হু-হু করে। ‘মৃত্যু’ নাকি এই কঠোর শাস্তি এড়াতে পারত! কতটা করুণ মানসিক অবস্থানে থাকলে কেউ এ-কথা বলতে পারে! ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে হিংসা-বিক্ষত ম্যাচের সময় পাথরের আঘাতে তাঁর গালের দু’টি অস্থিভঙ্গ। যন্ত্রণাবিদ্ধ যতখানি নবির শরীর, মন ততোধিক বেশি। ঠিক কী বলেছিলেন সবুজ-মেরুন এই মিডফিল্ডার? “গভীর দুঃখের সঙ্গে বলছি, ৯ ডিসেম্বরের ঘটনায় আমি নিহত হলে আমরা ফুটবল থেকে বঞ্চিত হতাম না। একইভাবে, মোহনবাগানের উপর এই শাস্তির জন্য আমার চোট দায়ী। অনেকে বলেছিল, পাথরটা যদি আমার অন্য কোথাও (মাথা) লেগে যেত, তাহলে মৃত্যু থেকে বাঁচা কঠিন হত। আমার মনে হয় আমার যদি সেদিন মৃত্যু হত, তাহলে ক্লাব এত কঠোর শাস্তি পেত না।” আর ঠিক কী হয়েছিল সৈয়দ রহিম নবির? ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে রবিবাসরীয় আই-লিগ ডার্বি খেলার সময় গ্যালারি থেকে তাঁকে ছুড়ে মারা পাথর থেকে গুরুতর চোট পেয়েছিলেন। ১০ ডিসেম্বর, সোমবার দু’টি ভাঙা হাড় ঠিক করার জন্য একটি অস্ত্রোপচার করা হয়। সফল হয় অস্ত্রোপচার। চার-পাঁচ দিন পর হাসপাতাল থেকে ছাড়াও পান। নিউরো সার্জন এস এন সিনহার কথায়, নবির জাইগোম্যাটিক হাড়ের (কান এবং চোয়ালের মধ্যে অবস্থিত) দু’টি ফ্র্যাকচার ছিল। যা ধাতব স্ক্রু এবং প্লেট ঢুকিয়ে ঠিক করা হয়। এরপর দীর্ঘ একমাস বিশ্রামের পর মাঠেও ফেরেন। মোহনবাগানও আইনি লড়াই লড়ে সাসপেনশন এড়ায়। কিন্তু প্রথম লেগে অর্জিত পয়েন্ট কেটে নেওয়া হয়। শর্ত একটাই, অবনমন এড়াতে গেলে অবশিষ্ট ১১/১২টা ম্যাচের প্রায় সবক’টাতেই জিততে হবে। ‘শত্রুপক্ষ’ ধরেই নেয়, নিশ্চিত অবনমন। কিন্তু মোহনবাগান দলে ছিলেন নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার ওডাফা। তিনি হয়ে উঠলেন জাদুকর। সেই জাদুস্পর্শে গোটা দল টেক্কা দিল বিপক্ষ দলদের। অবনমন বাঁচে। পুরো লিগের সবক’টা ম্যাচ খেলতে পারলে হয়তো চ্যাম্পিয়নও হয়ে যেতে পারত মোহনবাগান। 

আরও পড়ুন
'টু ডলার' রেফারিদের নানান গল্পস্বল্প

৯ তারিখের শীতের সেই রাত। আমরা কলকাতা ফিরছি মুখোশ-আস্বাদ নিয়ে। মুখে কথা নেই আমার। টিভির পর্দায় যা দেখলাম, লাখো মুখের আড়ালে থাকা শয়তানের মুখোশ। আঘাতকারীরা আর যাই হোক, সমর্থক হতে পারে না।

Powered by Froala Editor