মোহনবাগান এবং আমাদের সকলের আই-লিগ জয়

এক্কেবারে ভাইটাল সময়ে দাদা গেল হিমাচলে। তার হওয়া বদলের শখ। শুভ্রাংশুদার সঙ্গে ছিল আর-এক কট্টর মোহনবাগানী পীযূষদা (দলপতি)-ও। ভাইটাল সময় কারণ আই-লিগ পয়েন্ট টেবিলে দ্বিতীয় স্থানে থাকা দলের থেকে ৮ পয়েন্ট লিডে থাকা মোহনবাগান হঠাৎই ড্র বা হারতে শুরু করছে। কুপারেজ স্টেডিয়ামে মুম্বই এফসির সঙ্গে ড্র থেকে এই 'হঠাৎ অসময়'-এর শুরুটা হয়েছিল। তবুও ওটা পিছিয়ে পড়েও ড্র ছিল। কিন্তু এর পরের ম্যাচ নবাগত ভারত এফসির সঙ্গে ০-১ গোলে হারটা! পুণের ছত্রপতি স্টেডিয়ামে ৩৫ মিনিট নাগাদ সেই যে গোল খেয়ে বসল দল, সেখান থেকে আর ফিরে আসা গেল না। ভারত এফসির ভারত-ভবিষ্যৎরা মন জয় করে নিয়েছিল। কিন্তু অমন মাস্ট উইন সিচুয়েশনে মোহনবাগানের হারের পর সত্যজিৎ রায়ের ‘পাশফেল’ গল্পের দীর্ঘশ্বাসগুলো মনে পড়ছিল। তবে, আঘাতটাকে গাঢ় করল গোয়ার ফতোরদা স্টেডিয়ামের স্পোর্টিং ক্লুব দি গোয়ার সঙ্গে এর পরের ম্যাচ। ‘দুয়োরানি’ থুড়ি ‘দুয়োরাজা’ যদি কেউ হন, তিনি একদা মোহনবাগানের ‘প্রাণভোমরা’ ওডাফা ওকেলি। গোটা সবুজ-মেরুন দল ৬৫ মিনিটের পর কেমন একটা ক্লান্ত হয়ে গেল। আর সেই সুযোগেই আস্ত দু-দু’টো গোল মেরে বসে মোহনবাগানকে সিঁদুরে মেঘ দেখিয়ে দিলেন। জাপানি কাতসুমি একটা সময় আমাদের ১-১ সমতায় ফিরিয়েছিলেন বটে, কিন্তু নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার আগে আগেই ওডাফা ফের গোল দিয়ে গোয়া থেকে পয়েন্ট আনতে দিল না মোহনবাগানকে। আস্ত-গোটা পয়েন্ট মিস, অতিরিক্ত সতর্ক হতে গিয়ে অযথা ডিফেন্সিভ হয়ে যাওয়া, মুডের মতো প্লেয়ারদেরও পারফরম্যান্স সুইং করা, লম্বা লিগের ধকল― চোখে পড়ছিল প্রবলভাবে। পরের ম্যাচ ঘরের মাঠ বারাসত স্টেডিয়ামে। সবুজ গাছগাছালি ঘেরা স্টেডিয়ামে পৌঁছলাম ‘লাকি’ শুভ্রাংশুদা আর বন্ধু সুবিনয় (গায়েন)-কে নিয়ে। এত থমথমে গ্যালারি বহুদিন পর দেখছি। সমর্থকেরা ‘নিরামিষ’। আরে বাবা, আগের দু’টো ম্যাচে হারাটা তো অতীত। ওই নিয়ে পড়ে থেকে খাস মাঠে এসে এভাবে শোকপালন করলে চলবে? কিন্তু কে আর বুঝবে সে-কথা! প্রথম লেগে মোহনবাগানকে ৩-২ গোলে হারানো শিলংয়ের রয়্যাল ওয়াহিংডোর সঙ্গে ম্যাচ। আক্রমণে ওঠার চেষ্টা করছে সঞ্জয় সেনের ছেলেরা। কিন্তু আটকে যাচ্ছেন গত ম্যাচগুলোর মতো। গ্যালারিতে উত্তেজনা বাড়ছে। ফ্যাকাসে মুখ। এসময় ফেরিওয়ালা কখনো ঢোকে! তিনিই বা কী করে বুঝবেন মে মাসের গরমে নয়, মোহনবাগানের তখনকার হলফিল পুড়িয়ে দিয়েছিল আমাদের। বেশ কয়েকজন ওই ফেরিওয়ালার ওপরই ‘গরম’ নিল। এমন খণ্ডদৃশ্যের মধ্য দিয়েই গ্যালারিতে শুরু হল ‘আমাদের সূর্য মেরুন নাড়ির যোগ সবুজ ঘাসে’। এই তো, এতক্ষণে মনে হচ্ছে ঘরের মাঠে সাপোর্ট করতে এসেছি বাগানকে। মুষড়ে পড়া স্টেডিয়াম হঠাৎই চেগে উঠেছে। বলতে বলতেই গোল! প্রীতম কোটাল ডানদিকের উইং থেকে বাঁক খাওয়ানো দূরপাল্লার শটে ডেভিড বেকহ্যাম টাইপের গোল করে এগিয়ে দিলেন মোহনবাগানকে। এরপর সনি নর্দি, বলবন্ত সিংদের ঘনঘন আক্রমণ এবং মিসের বহরও মনে থাকবে। কিন্তু রয়্যালও যে দমে যাওয়ার ছিল না। ওরা লং পাসে টেক্কা মারার চেষ্টা করছিল। যদিও বিপদ হয়নি। ম্যাচের ৬০ মিনিটের পর হাইতিয়ান নর্দি ‘ঝলক দিখ লা যা’ বলেই যেন ফ্রিকিক থেকে ম্যাচের দ্বিতীয় গোল করলেন। বিশ্বমানের ফ্রিকিক ছিল। মোহনবাগান জিতল ২-০। ধড়ে যেন প্রাণ ফিরল। যদিও খুশির মধ্যেও রাগ হচ্ছে শুভ্রাংশুদার ওপর। বলল, “হিমাচল যাব। পরের ম্যাচে পারমিতা, স্বর্ণাভদের সঙ্গে আসিস।” পরের ম্যাচ সেই ওডাফার স্পোর্টিং ক্লুবের সঙ্গে। প্রতিবাদ জানালাম। টিকিট ক্যানসেল করার কথাও শুধোলাম। দাদা নিরুপায়। বলল, নিছক হওয়া বদল নয়, নিজস্ব কিছু কাজও আছে। তাই আপাতত তাকে সেদিন একটা কথাই বলেছিলাম, পরের ম্যাচে উল্টোপাল্টা কিছু ঘটলে কিন্তু খুব খারাপ হবে। “ধাপে ধাপে চিন্তা করো খোকা। চ্যাম্পিয়ন হব আমরাই। চল, খিচুড়ি খেয়ে আসি।” মনে এত কিন্তু নিয়ে সেদিনের আগে প্রিয় খিচুড়ি খাইনি কখনো।

ওদিকে বেঙ্গালুরুও ছোঁয়াছুঁয়ি খেলায় মোহনবাগানকে প্রায় ছুঁয়েই ফেলেছে। মনে আছে, যে দিনটায় মোহনবাগান-গোয়া ম্যাচ, সেদিনই সন্ধে সাতটায় ছিল বেঙ্গালুরু-ডেম্পো। আমাদের ম্যাচ বিকেল সাড়ে চারটায়। বাড়ির কাছাকাছি দমদম। মাত্র দশ মিনিটের পথ। কিন্তু পরিকল্পনা হল, শিয়ালদহ গিয়েই ট্রেন ধরার। এর প্রথম কারণ পারমিতা (রায়) দিদি, স্বর্ণাভ (নন্দী)-রা শিয়ালদহেই আসবে। আর দ্বিতীয় এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভিড় এড়ানো। আসলে গত ম্যাচে দমদম থেকে বারাসতে ট্রেনে উঠতে গিয়ে প্রায় পিষ্ট হয়ে যেতে বসেছিলাম। সুবিনয় ফের আমার সঙ্গ নিল। গত তিনদিন ধরে ও আমাদের বাড়ি আসছে। ওর মুখে তখন কেবলই ওডাফা। সত্য গোপন না করে বললে ওর মুখে কেবলই ওডাফা গঞ্জনা। ওরে পাগলা, এই ওডাফা একসময় মোহনবাগানের জন্য অনেককিছু করেছে। যে ডার্বিতে রহিম নবির মাথা ফাটল ইটের আঘাতে, মোহনবাগান দল তুলে নিয়েছিল প্রতিবাদে, এর পর তো প্রায় ব্যান ঠুকে দিয়েছিল ফেডারেশন! শেষমেশ ব্যানট্যান না ঠুকলেও পয়েন্ট কেটে চিচিংফাঁক করে এমন অবস্থা করেছিল আমাদের যে, অবনমন বাঁচাতে গেলে সেবার সেকেন্ড লেগের প্রায় সব ম্যাচেই জিততে হত। ওডাফা না থাকলে তো দ্বিতীয় ডিভিশনে নেমে যেতে হত। মনে পড়ে? সুবিনয় আপাতত সেইসব অতীতকে পাত্তা দেওয়ার মুডে নেই। ওর সাফ কথা, ওডাফাকে খেলতে দেওয়া চলবে না। তাহলেই মোহনবাগান জিতবে। মাঠে নামবেন বোয়া, কাতসুমি, নর্দি, প্রীতম, বলবন্ত, শিলটনরা আর ছক সাজাচ্ছে আমাদের সুবিনয়। কি কাণ্ড! হরি যার সখা বল, দুশমন তার পায়ের তল... চল বারাসত, মাঠেই হবে বোঝাপড়া।

আরও পড়ুন
কৃষ্ণপদ গাঙ্গুলি এবং তাঁর মধ্যমগ্রাম হাইস্কুলের জয়গাথা

আরও পড়ুন
ময়দানের তৃতীয় নয়ন

আরও পড়ুন
ইস্টবেঙ্গল মাঠ এবং নতুন ময়দানকে চেনার সেই দিন

দিনটায় ফিরি। কেবল ম্যাচ নয়, প্রাক্-ম্যাচ ওয়ার্মআপও দেখব। তাই ঠিক হয়েছিল, আগেভাগেই পৌঁছব স্টেডিয়াম। আমাদের অনুমান, এই পরিকল্পনায় ফাঁকায় ফাঁকায় যাওয়া যাবে। কিন্তু কোথায় কি! শিয়ালদহ স্টেশন পৌঁছতেই দেখি, সবুজ-মেরুন সমর্থকরা সমারোহে হাজির। একজন তো দেখি, মালিঙ্গা স্টাইলে নিজের হেয়ারকাটের রং করেছে সবুজ-মেরুন। বিদ্যানগর মেরিনার্সের লোকজন প্রায় প্রত্যেকেই সবুজ-মেরুন পতাকায় নিজেদের মুড়িয়ে ফেলেছেন। এক নম্বর প্ল্যার্টফর্মের ঠিক বাইরের টিকিটের লাইনের সিংহভাগই বাগান সমর্থকদের দখলে। এদিকে, বারাসত লোকাল মিস হয়ে যাবে বলে চিলচিৎকার জুড়ে দিলেন একদল। মাত্র দু’টো কাউন্টার খোলা ছিল কোনো কারণে। তবে, সেদিনের পরিস্থিতি ম্যানেজ করার জন্য নজিরবিহীন ভাবেই আরো দু’টো টিকিট কাউন্টার খুলে দেওয়া হয়েছিল সেদিন। আমরা নির্ধারিত সময়েই ট্রেন পেলেও তা কিন্তু ফাঁকা ছিল না। সিটও পাইনি। তবে এক কামরা মোহনবাগানীদের সঙ্গে বারাসত পৌঁছনোর মজাটাই আলাদা ছিল। শিয়ালদহতেই সমর্থকরা যেভাবে হর্ষধ্বনি তুলেছিলেন, তাতে স্বয়ং টিটিও ভ্যাবাচ্যাকা। আর গোটা ট্রেনেই সবুজ-মেরুন সমর্থকরাই তখন কুলীন। স্লোগানে-গানে-আনন্দ-হরষে খেলোয়াড়ি পরোয়ানার খোঁজেই পৌঁছলাম বারাসত। টোটো ধরতে হবে। স্টেডিয়াম মাত্র দশ-বারো মিনিট। ভিড়টা সেদিন অতিরিক্ত ছিল, তাই প্রায় আধ ঘণ্টা লেগেছিল স্টেশন পৌঁছতে। ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে তিনটে ছুঁইছুঁই।

আরও পড়ুন
জাতীয়তাবাদের ছুঁতোয় লাল-হলুদকে সমর্থন

স্টেডিয়ামে পছন্দমতো আসন সংগ্রহ করার পর দূরাকাশ দিয়ে এরোপ্লেন উড়ে গেল। মনে করলে এটা একটা প্রতীক। মোহনবাগান কি এভাবে উড়তে পারবে? এসব ভাবতে ভাবতেই চোখে পড়ল স্টেডিয়ামের ডানদিকের পিছন দিকটা। একজন মহিলা তাঁর বাড়ির বারান্দায় কাপড় মেলছেন। কিন্তু বারান্দাটা মোটেও ফাঁকা নয়। সময় এগোলো। বারান্দাটাও ভরে উঠল চার-পাঁচজন মানুষে। গোটা খেলাই তাঁরা দাঁড়িয়ে দেখলেন। সেই বাড়িটার পাশে একটা জ্যাঠা বট। সে তার একার কাঁধে কিছু মানুষের ওজন বইতে সক্ষম। তেমনটাই দেখা গেল। গাছে উঠে খেলা দেখে গেলেন বেশ কয়েকজন। এইসব ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যগুলো যখন এক ফ্রেমে বাঁধছি, দুই দলের প্লেয়াররা গা ঘামতে মাঠে নামলেন। গোয়ান দলের একটা বল আমরা যে গ্যালারিতে বসে, তার সংলগ্ন ফেন্সিংটার কাছে চলে এল। বল নিতে এলেন স্বয়ং ওডাফা। সুবিনয় সেই যে শুরু করল, তা জারি রইল ম্যাচের শেষ পর্যন্ত। তবে, ওডাফাকে সেদিন মোহনবাগান সমর্থকরা করতালি দিয়ে সৌজন্যও দেখিয়েছিলেন। শত হলেও মোহনবাগানে তাঁর মতো নাইজেরিয়ান তারকার অবদান কম কিছু নয়। ম্যাচ শুরুর পর তেড়েতুড়ে খেলতে শুরু করলেন সঞ্জয় সেনের ছেলেরা। সনির বাঁ-দিকের উইং দিয়ে বেদম দৌড় যেন স্বপ্নের ঠিকানা। সনি... সনি... চিৎকারে কানে তালা লেগে যাচ্ছে। বলবন্ত সিং সুযোগ খুঁজছেন। পারছেন না। ক্যামেরুনের পিয়ের বোয়া ওরফ আদরের ‘বোয়াদা’ অসম্ভব সব ভালো থ্রু বাড়াচ্ছেন। তবুও গোল হচ্ছে না। দু'তিনবার সর্পিল গতিতে ওদের ওডাফা আমাদের বক্সে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন। ডিফেন্সকে মজবুত সাজিয়েছিলেন সঞ্জয় সেন। তাই আটকে যাচ্ছিলেন ওডাফা। ডিফেন্সে বেলো ছিলেন অসামান্য। এরই মধ্যে থ্রো করতে আসার ঠিক আগে আমাদের গ্যালারির দিকে হাত নেড়ে অভিবাদন কুড়োতে চাইলেন তিনি। কিঞ্চিৎ নিরাশই হলেন। সর্মথকরা তখন বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনীর মতো— তোকে জমি দেব না একচুলও— পরমিতাদি বলে উঠল ‘‘আরে হচ্ছেটা কি?” আসলে কাজের কাজ কিছুই আর হচ্ছে না। গোলের দেখা নেই যখন, মোবাইলটা বেজে উঠল। ম্যাচের ৪০ মিনিট নাগাদ শুভ্রাংশুদার ফোন। কিন্নর কৈলাসের পাহাড়ি পথের কোনো কোণ থেকে ফোন করে স্কোর জানতে চাইছে। রাগই হচ্ছিল বটে। পারমিতাদি বলে উঠল, “শুভ্রাংশুকে বল গোল হলে ঠিক ফোন করব।” প্রথমার্ধ শেষ হল। স্কোরলাইন চশমা (০-০)। দ্বিতীয়ার্ধে কামড় দেওয়ার চেষ্টা করল বাগান। কিন্তু ওই... গোলের সামনে এসেই সব গণ্ডগোল। এমন ভাবতে ভাবতেই রাইট ব্যাক থেকে উঠে এসে গোল করে মোহনবাগানকে এগিয়ে দিলেন উত্তরপাড়ার সতীশ সিং। এরপর পিছনে তাকাতে হয়নি। যথেষ্ট গোছানো ফুটবল উপহার দিল বাগান। ৮০ মিনিটের ঠিক আগে আগেই প্রাণভোমরা সনি স্কোরলাইন ২-০ করলেন। শুভ্রাংশুদা ফোনে রেজাল্ট জানাতেই বলল, “আমার হিমাচল ভ্রমণ তবে কলঙ্কিত নয় বল?” ফোনের ও-প্রান্ত থেকেও তখন 'গোওওল...' বলে চিৎকার শুনছি। এরই মধ্যে গ্যালারিতে তখন রব উঠেছে। কার্তিকদা নাকি বলে দিয়েছিলেন মোহনবাগান ম্যাচ জিতবে হেসেখেলে। কিন্তু কে এই কার্তিকদা? তিনি এক জ্যোতিষী। আমি তাঁকে মজা করে নাম দিয়েছিলাম প্রফেসর পল-কার্তিক। এই পল আদতে এক অক্টোপাসের নাম। ২০১০ বিশ্বকাপ ফুটবলের আগে তার ভবিষ্যদ্বাণী কিন্তু দারুণ ফলেছিল। আসলে ফুটবল ম্যাচের ফলাফল ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য পশু ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে একে ব্যবহার করা হয়েছিল। যাই হোক, ম্যাচের পর টোটোয় নয়, বরং টোটো কোম্পানিতে জয়ের মিছিলে মিশে গিয়ে স্লোগান তুলতে তুলতে বারাসত স্টেশন পৌঁছেছিলাম। ফিরতি পথে পারমিতাদি আমাদের কাটলেট আর মিষ্টি খাইয়েছিল। একটু পরেই শুরু হবে বেঙ্গালুরু ম্যাচ, মারগাওয়ে। বেঙ্গালুরু পয়েন্ট লস করলেই আমাদের লাভ। ট্রেনে ফিরতে ফিরতেই সুখবরটা এল। বেঙ্গালুরু-ডেম্পো ম্যাচ ড্র হয়েছে। সেই দিনটার সেলিব্রেশন যেন দ্বিগুণ হয়েছিল সেদিন। এবার আমনে-সামনে বেঙ্গালুরুকে বুঝে নেব আমরা, ট্রেন কম্পার্টমেন্টে শুরু হল বলাবলি। অত সহজ যেন সবকিছু! বেঙ্গালুরু ম্যাচ একটা সপ্তাহ পরে। তাও খাস বেঙ্গালুরুর ডেরা কান্তিরাভায়। জিতলে কিংবা ড্র করলে প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হবে মোহনবাগান। আর হেরে গেলে? উঁহু, হারের কথা মাথায় আনা চলবে না। মনে রাখতে হবে এই বেঙ্গালুরুকে যুবভারতীতে এই আই-লিগের প্রথম লেগের ম্যাচে ৪-১ গোলে হারিয়েছিল মোহনবাগান। ওই ম্যাচটি থেকেই মনে বিশ্বাস এসেছিল, এই সবুজ-মেরুন দল ভারতসেরা হতে পারে।


শত চেষ্টাতেও বেঙ্গালুরু ম্যাচের দিন ছুটি ম্যানেজ করতে পারিনি। আমাদের রবিবারেও অফিস খোলা। তাই সেদিন আমাদের মোহনবাগানীদের ‘গ্যাং’-এর সঙ্গে বসে খেলা দেখতে পারিনি। এদিকে খবর, শোভাবাজার রাজবাড়িতে বড় জায়ান্ট স্ক্রিন বসানো হবে। সেখানে সন্ধে সাতটার ম্যাচ সরাসরি সম্প্রচারিত হবে। ভিড় করবেন সবুজ-মেরুন জনতা। কেবল তাই নয়, খবর এল, মোহনবাগান মাঠেও বসবে জায়ান্ট স্ক্রিন। সে-নিয়েই তোড়জোড়। চরমে উত্তেজনা। বড় স্ক্রিনে খেলা দেখানো হবে উল্টোডাঙা, বালিগঞ্জ-সহ কলকাতার আরো বেশ কিছু জায়গায়। সবই শুনছি আর আরো বেশি করে মন খারাপ হচ্ছে। এ স্বাদের ভাগ হবে না যে! কত কী যে সয়ে যেতে হয়... যেতে হয় যাক, কেবল আই-লিগটা ঘরে এলেই হবে। এর আগের তিন চারদিন ধরে ক্রমশ খবর পাচ্ছি যে, কলকাতা থেকে কর্নাটকের এই শহরে সদলবলে খেলা দেখতে যাচ্ছেন বেশ কিছু সমর্থক। মেরিনার্স অ্যাট ব্যাঙ্গালোরের সায়ন্তন বসু বললেন, “স্টেডিয়ামের ইস্ট লোয়ার বি টায়ার ছিল মোহনবাগান সমর্থকদের জন্য। কলকাতা থেকেও প্রচুর সমর্থক এসেছিলেন খেলা দেখতে। প্রায় সাড়ে সাতশো সিট কানায় কানায় ভরে গিয়েছিল। এমনকী অনেকে পিছনে দাঁড়িয়েও খেলা দেখেছিলেন সেদিন। প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। মাথার ওপর শেড ছিল না। ভিজে কাক হয়ে খেলা দেখতে দেখতেই ছন্দপতন ঘটল। বিরতির আগেই মোহনবাগান গোল খেয়ে গেল। এরপর বুঝতেই পারছেন যে, তখন কী অবস্থা চলছে মনের ভিতর! গোলের দেখা নেই। চান্স মিস। এসব দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে যখন ভাবছি যে, ‘নাহ এবারও আর হল না’; ভাবছি যে ফিরে যাব, সেই মুহূর্তেই কর্নার পেল মোহনবাগান…” সোমতীর্থবাবু সায়ন্তনের মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বলতে লাগলেন, “আমার বন্ধু তুহিন (রায়)-এর অবস্থা ছিল দেখার মতো। জনসনের গোলে সুনীল ছেত্রীর দল এগিয়ে যাওয়ার পর সে আর খেলাই দেখেনি। পিছন ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। বলেছিল, ‘কিছু হলে জানাস’। তবে কেবল তুহিনই নয়। অনেকেই ম্যাচের এই টেনশন নিতে পারছিলেন না।”— “তার পর গোল হল। আমরা ছিলাম গোলপোস্টের বাঁ-দিকে। ডানদিক দিয়ে গোলটা হয়েছিল। প্রথমে বুঝতে পারিনি যে, বলটা জালে জড়িয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে গোল হয়ে গেছে। গোলের পর মোহনবাগানের গ্যালারি সামান্য কিছুক্ষণ চুপ ছিল। তারপর সমর্থকদের চিৎকার শব্দব্রহ্ম তৈরি করেছিল।”— জুড়লেন সায়ন্তন। এরপর খেলা শেষের বাঁশি বাজল। “বাঁশি যতবার বাজে/ শুরু, শেষ আর মাঝে/ ততবার করে শুরু হয়/ খেলা শেষ হতে চায় না যে…” হ্যাঁ, সব খেলার সেরা সেদিনের ফুটবল ম্যাচ যেন শেষ হয়নি আজও। আজও যা স্মৃতির পর্দায় অমলিন। সেদিন ম্যাচ শেষে কিংবদন্তি গোলকিপার প্রয়াত শিবাজি ব্যানার্জি কান্তিরাভার মাঠে ঢুকে নেচেছিলেন। ম্যাচ শেষে দীপাঞ্জন মল্লিক নামে মোহনবাগানের এক সমর্থক মাঠে ঢুকতে গিয়ে পা ভেঙে বসেন। ওই উত্তাল সেলিব্রেশনের মাঝেও মোহনবাগান কোচ সঞ্জয় সেনের চোখে পড়ে সেই দৃশ্য। তিনি নিজে আহত সেই সমর্থককে কোলে করে অ্যাম্বুলেন্সে শুইয়ে দিয়ে আসেন। জয়ের মধ্যেও আরও বেশি করে স্মরণীয়, আরও অনেক অনেক বেশি বরণীয় এই খণ্ডদৃশ্যগুলি। কলকাতা থেকে সেদিন খেলা দেখতে যাওয়া কাশীনাথ সরদার পণ করেছিলেন মোহনবাগান সেই ম্যাচে উতরে না গেলে খাবেন না, খেলা শেষের বাঁশি বাজার পর মোহনবাগানী দম্পতির কাছে বিস্কুট চেয়ে উপোস ভেঙেছিলেন তিনি। এমন আবেগকে লিখে কতটুকুই বা বর্ণনা করা যায়? আর হ্যাঁ, আমাদের সবুজ-মেরুন গ্যাং-এর শুভ্রাংশুদা, পারমিতাদিরা সেদিন খেলা দেখছিল বালিগঞ্জের উইভার্স স্টুডিয়োয়। কেমন ছিল সেই স্টুডিয়োর পরিবেশ? পারমিতাদি তাঁর ‘অধরা মাধুরীর সন্ধানে’ নামে এক লেখায় লিখেছেন, সনি যখন কর্নারটা নিতে যাচ্ছেন সকলেরই চোখ তখন পর্দায়— কিছু একটা ঘটবার আশায়। সনির কর্নার পেনাল্টি বক্সে নামল, বেলো হেড করল, বল বেঙ্গালুরুর জালে। এই পর্যন্তই শুধু দেখতে পেয়েছিলাম, স্টুডিয়োয় উপস্থিত আমরা সবাই। প্রবল চিৎকারের সঙ্গে সবাই-ই লাফিয়ে উঠেছিল আত্মহারা হয়ে— তারপর কী যেন একটা হল। মানে স্ক্রিনে আর কিছু দেখা গেল না। তার ছিঁড়ে গেছে লাফালাফির চোটে। কিন্তু শব্দ আসছে। আর মিনিট পাঁচেক বাকি। ওই অন্ধকারের (মনে হচ্ছে অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল) মধ্যে পুরনো দিনের মতো আমরা শুধু রিলে শুনে যাচ্ছিলাম। শুনছিলাম কি? নাকি খেলা শেষের বাঁশি কখন বাজবে তার জন্য অপেক্ষা করছি। ওই পাঁচ মিনিটকে মনে হচ্ছিল পাঁচ ঘণ্টা। কে যেন বলল শেষ। সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরছে। আমার সামনে বসা শান্ত ছেলেটি হাউহাউ করে কাঁদছে। কাঁদছি আমরা সবাই। আমাদের সম্মান, আমাদের সম্ভ্রম আমরা রক্ষা করতে পেরেছি। আমরা তো জানি শুধু এই দিনটা দেখবার জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত জুড়ে মোহনবাগানীরা কত স্বপ্নের জাল বুনে চলেছে। এই বদলে যাওয়া ফুটবল-ভারতে আমরা আমাদের পুরনো প্রতীক সেই বাঘের মতো শাসন করতে ফিরে এলাম।”

বেলো যখন গোলটা দিলেন, তার আগে পর্যন্ত আমি অফিসের একচিতলে ঘরে এসিতে বসেও ঘামছি। কাজে মন নেই। এবারেও হয়তো এত কাছে এসেও চ্যাম্পিয়ন হওয়া হল না! এই অবস্থায় সনি নর্দির কর্নার থেকে বেলো রাজ্জাকের হেড এবং গোল। আবেগ সামলাতে পারিনি। কলিগরা বলেন, ডেক্সের চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে এমন চিৎকার জুড়ে দিয়েছিলাম যে, তা বহু ডেসিবেল ছাড়িয়েছিল। ঘটনা হল, বেলোর গোলের মুহূর্তে আমাদের সম্পাদক সেদিন দিল্লি থেকে ফিরে সোজা আমাদের ঘরে। আমি যখন চিৎকার করছি, সম্পাদক আমার পিছনে দাঁড়িয়ে। ভেবেছিলাম, আনন্দ হয়তো মাঠে মারা যেতে বসেছে। অথচ তিনি কিছুই বলেননি। আমার অবস্থা দেখে মাথা নেড়ে একফালি হেসে চলে গিয়েছিলেন। হয়তো ভিতরে ভিতরে আনন্দও পেয়েছিলেন, শত হলেও কলকাতার ক্লাব বলে কথা। অফিস ছুটির পর রয়েড স্ট্রিট থেকে লোটাস হেঁটে এসে 34B ধরে বাড়ি ফেরার পথে দেখেছিলাম অনেক কিছুই। ঠনঠনিয়া কালীবাড়ির কাছে সবুজ-মেরুন টুনি লাইট জ্বালানো হয়েছে। আতশবাজি ফাটছে। হেদুয়ার কাছে বিশাল বড় ব্যানার টাঙানো হয়েছে। তাতে লেখা 'ভারত সেরা মোহনবাগান'। বাস হাতিবাগান পেরোতেই যে জায়গাটায় আগে দর্পণা সিনেমা হল ছিল, তার পাশের গলিটা দিয়ে সামান্য এগিয়ে গেলেই ১৯১১-র শিল্ড জয়ী অমর একাদশের মূর্তি রয়েছে। আন্দাজ ছিল হাতিবাগান থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত বেশ উন্মাদনা নজরে পড়বে। ওইটুকু পথ পেরিয়ে আসতে সময় লেগেছিল অনেকখানি। কারণ রীতিমতো, হোলি চলছে। অকাল হোলি। সবুজ-মেরুন আবির ভ্যাপারের আলোয় এক মায়াবি রং ধারণ করেছে। ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে গেলে প্রতিদিন যে অস্বস্তি বোধ হয়, সেদিন তা লাগছিল না। হৃতগৌরব অর্জন করতে পারার আনন্দে মশগুল মন। পাড়ায় ঢুকতেই দেখি পাড়াতো বন্ধুরা জেবিএল বক্স ফিট করছে। রাত হয়ে গিয়েছে বলে পরেরদিন সকাল থেকে হবে সেলিব্রেশন। আমি ওদের স্বেচ্ছায় মিষ্টি খাবার টাকা দিলাম। ওরা বলল, পরের দিন এয়ারপোর্ট যাবে। আই-লিগ জয়ী মোহনবাগান দল বিমানবন্দরে নামবে যে। নাহ, অফিসের কল্যাণে সেদিনও যেতে পারিনি। তবে কলকাতার রাজপথে প্রায় ৫০ হাজার লোক হয়েছিল। বিমানবন্দর থেকে সবুজ-মেরুন যোদ্ধারা বের হতেই উন্মাদনা বাঁধ ভাঙে। অত মানুষ র্যা লি করে মোহনবাগানের টিম বাসের সঙ্গে গোষ্ঠ পাল সরণির ক্লাব তাঁবুতে এসে পৌঁছয়। আই-লিগ ট্রফিটা একটিবার ছুঁয়ে দেখার জন্য তখন হইচই কাণ্ড। এমন সেলিব্রেশন কিন্তু ২০১১-র ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়ের পরেও দেখেনি কলকাতা।

Powered by Froala Editor