জাতীয়তাবাদের ছুঁতোয় লাল-হলুদকে সমর্থন

এ যেন প্রবল ধর্মসংকট। আর তা নিয়ে গোলা-বারুদের যুদ্ধ কিংবা হাতাহাতি ঢুসোঢুসি ছাড়া প্রায় সবকিছুই জারি। মুখেন মারিতং জগৎ-এর সার্থক রচনা যাকে বলে আর কী। একমাত্র ভারতীয় দল হিসাবে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব আসিয়ান কাপের ফাইনালে। জিতলেই নজির। কিন্তু তা নিয়েও দ্বিধায় এ-শহর। চ্যাম্পিয়ন হলে সুলে মুসা, ডগলাসরা লাল-হলুদ শুভেচ্ছায় ভাসবেন। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় মহান এই রেকর্ড গড়বে তারা বলেই আশাবাদী ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টাররা। কলকাতায় ইস্টবেঙ্গলের খেলা হলেই বাইক চালিয়ে মাঠে যেত মন্টুদা। সে তো আমাদের মতো মোহনবাগানিদের বলেই দিল, “তোদেরও সাপোর্ট চাই ভাই।” তা শুনে ‘নিকুচি’ বলে বৈকালিক আড্ডার আসর ত্যাগ পরিতোষদার। আর সন্তু তো রীতিমতো যুদ্ধংদেহী মেজাজে ঘোষণাই করে দিল, ভুল করেও ইস্টবেঙ্গলকে সাপোর্ট করা চলবে না। আর করলে? সে ফতোয়ার কথা না হয় খানিক পরে বলছি। তার আগে করোনাকালের কথা। করোনার প্রথম বছরটা অর্থাৎ ২০২০ সাল ইস্টবেঙ্গলের আসিয়ান কাপ জয়ের ১৭তম বার্ষিকী। দুর্ভাগ্যবশত এই প্রাণঘাতী ভাইরাস খেলাধুলার জগতেও প্রভাব ফেলে। সেই সময় কিন্তু এগিয়ে এসেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের আসিয়ান কাপ বিজয়ী সদস্যরাও। স্মৃতি এক্কেবারে টাটকা। আমাদের সেই ইস্টবেঙ্গলি বাইক-সওয়ারী মন্টুদা তো ফুল লকডাউন চলাকালীন যেটুকু সময় পেটের জোগানে রাস্তায় বের হত, একবার না একবার পড়ার ক্লাবটার কাছে আসতই। বেশিরভাগ সময়টাই ক্লাবে তালা। একবার আমার মুখোমুখি হয়ে যায় মন্টুদা। দেখেই বলল― ‘‘জনগণের সাথে, জনগণের পাশে... জয় ইস্টবেঙ্গল।” শুরুতে ভেবেছিলাম নিছকই রাজনৈতিক স্লোগান, কটাক্ষ করছে। কিন্তু এরপর ‘জয় ইস্টবেঙ্গল’ বলতেই বুঝলাম, পুরনো চাল সত্যিই ভাতে বাড়ে। থিতিয়ে যাওয়া সময়... অচলায়তনেও মেঠোমায়া ঠিক রয়ে গিয়েছে তার। ব্যাপারটা কী, জিজ্ঞেস করতেই মন্টুদা বললেন, “বুঝলি আমাদের আসিয়ান জয়ী ফুটবলাররা করোনার প্রভাবে ভুগছেন যাঁরা, তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। গরিব মানুষের পাশে দাঁড়াবেন বলেছেন বাইচুং ভুটিয়া, সুলে মুসারা।” আমিও ভিতর থেকে একটা অদ্ভুত আনন্দ অনুভব করে বললাম― “বাহ! সেই আসিয়ান কাপ... মনে পড়ে কিছু? সেই ক্যাচালটার কথা?”

“হাহাহা... তা আর বলতে! তখন একেবারে রেগে গদগদ ছিলাম। আর এখন সেসব ভেবে হাসি পায়। এখন তো ছেলেপিলেরা খেলাধুলা করে না। সকাল থেকে মোবাইলে খুটুরখুটুর।” মন্টুদা বলল। আমি বললাম, “ওইসব ছাড়ো। আমাদের সন্তুর কথা মনে পড়ে? ওর কিন্তু তোমাদের সাপোর্ট করার বিষয়ে অ্যালার্জি ছিল।”

—হ্যাঁ সন্তু তো বলেই দিয়েছিল মোহনবাগানের যারা ইস্টবেঙ্গল কে সাপোর্ট করবে, তাদের ঘুণাক্ষরেও মাঠে যেতে দেওয়া হবে না। সে কি ক্যাচাল মাইরি! 

—তবে আসল কথাটাও এড়িয়ে যেও না মন্টুদা। সন্তু একটা সময় পর্যন্ত কিন্তু তোমাদের দিকেই হেলে ছিল। গণ্ডগোলটা কিন্তু পাকিয়েছিলে তুমিই। 

আরও পড়ুন
মারাদোনা ও মোহনবাগান

—একদম ফালতু কথা বলবি না রাজা। (পাড়ায় আমায় সকলে রাজা নামে চেনে)

আরও পড়ুন
একটি দীর্ঘশ্বাসের গল্প: মারাদোনা এবং কলকাতায় কিছু ভিজে যাওয়া চোখ

—উফ মন্টুদা, কুড়ি বছর পরেও একই রকম রয়ে গেলে। ‘ইস্টবেঙ্গল আসিয়ান কাপ জিতলে সেটা নাকি ১৯১১-র মোহনবাগানের আইএফএ শিল্ড জয়ের থেকেও বড় হবে’— তা কে বলেছিল তোমাকে সেদিন এমন উদ্ভট কথা বলতে?

আরও পড়ুন
মেসিময় সান্ধ্যনগরী

আরও পড়ুন
সেই অমলময় দিনগুলি

—কী ভুল বলেছিলাম রে? মোহনবাগান তো ব্রিটিশদের হারিয়েছিল ঘরের মাটিতে খেলে। কিন্তু ইস্টবেঙ্গল জিতলে সেটা বিদেশ থেকে জিতে আসত। নিঃসন্দেহে সেটা মোহনবাগানের শিল্ড জয় থেকে অনেক বড়ই।

—অ্যাই শোনো, লকডাউনে এমনিই খিচখিচে হয়ে গেছি। এসব বেকার বোকো না। একটা কথা মনে রেখো, তোমার ওই কথায় কিন্তু সেদিন ইস্টবেঙ্গলকে সাপোর্ট করিনি। অদ্ভুতভাবেই একটা জাতীয়তাবোধ কাজ করেছিল। তাই মোহনবাগানি হয়েও চেয়েছিলাম, কাপ জিতে ফিরুক ইস্টবেঙ্গল।

ওই সময়টা ইস্টবেঙ্গলের ক্ষেত্রে দারুণ যাচ্ছিল। একবছর আগেই জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে তারা। কেবল তা-ই নয়, ২০০২/০৩ মরশুমে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কিন্তু যে পাঁচটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল, সবক’টাতেই চ্যাম্পিয়ন। এমনই আবহে যখন ঠিক হল, লাল-হলুদ বাহিনী আসিয়ান খেলবে, তখনই আমার বাংলা-ইংরেজির স্যার পলাশ গাঙ্গুলি বলে দিলেন, চ্যাম্পিয়ন হবে তারা। তিনি ইস্টবেঙ্গল সমর্থক। জ্যোতিষ জানতেন বেশ ভালো। বোধহয় গণনা-টণনা করেছিলেন। যদিও এসবে বিশ্বাস ছিল না আমার। ভেবেছিলাম, বিদেশে গিয়ে ভরাডুবিই হবে। নিভে যাবে মশাল। এসব আউড়ালাম যখন, স্যার বললেন, “শোনো প্রসেনজিৎ, কোচটা সুভাষ ভৌমিক কিন্তু। চেনো ওনাকে?” এরপর তাঁর ছোটবেলাকার গল্প শোনালেন। সম্ভবত ১৯৭৩। এক তরুণ ফুটবলার মোহনবাগান গেট দিয়ে বেরিয়ে আসেন। বেশ ক্লান্ত। গঙ্গার দিকে আগুয়ান। হঠাৎ একটি গাড়ি এসে থামে। একজন গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে খোঁজ শুরু করেন আর-একজনের। খুঁজছেন যিনি, তিনি পিকে ব্যানার্জি। খোঁজ করছেন যাঁর, তিনি সুভাষ ভৌমিক। হাঁটুর চোট তাঁকে ভোগাচ্ছিল। সমর্থকদের উপহাসের পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। মোহনবাগান থেকেও বের করে দেওয়া হয়। যদিও কী করতে পারেন প্রিয় ছাত্র সুভাষ, জানতেন পিকে। অনবদ্য স্কাউটিং সেন্স ছিল সুভাষ ভৌমিকের। একজন অর্থোপেডিক সার্জেন তাঁকে কিছু ব্যায়ামের পরামর্শ দেন। ময়দানে দারুণভাবে ফিরে এসেছিলেন তারপর। সেসব তো ইতিহাস। স্যারই বললেন, “টানা চারটে বড় ম্যাচে গোল করার রেকর্ড কিন্তু ভোম্বলদারই। এমন রেকর্ড কারোর নেই। এই ভোম্বলদা কিন্তু জাতীয় লিগ দিয়েছেন। আসিয়ানও দেবেন। মিলিয়ে নিও।” হুঁ, আসিয়ান কাপে ইস্টবেঙ্গল যখন ইন্দোনেশিয়ার দল পেত্রোকিমিয়া পুত্রাকে টাইব্রেকারে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছল, তখন কিন্তু স্যারের ভবিষ্যদ্বাণীকেই সত্যি হতে পারে বলে মনে হয়েছিল।

এমনি এমনি এই সাফল্য আসেনি। আসিয়ান কাপের জন্য সুভাষ ভৌমিক প্রি-সেশন ক্যাম্প চালু করেছিলেন। গোটা দল একসঙ্গে হোটেলে থাকবে, একই সঙ্গে ট্রেনিংয়ের মধ্যে দিয়েও যাবে। এটাই তাঁর পরিকল্পনা। বিদেশি দলগুলোর সঙ্গে খেলার আগে তাঁর দলের ফুটবলাররা হীনম্মন্যতায় ভুগক, সেটা চাননি। এমন সময় খবরের কাগজগুলো শেষের পাতায় বড় বড় করে খবর ছাপে। বিদেশি দলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য দরকার চূড়ান্ত ফিটনেস। সেই কারণে ভারতীয় জাতীয় ক্রিকেট দলের তৎকালীন ফিজিওথেরাপিস্ট অ্যান্ড্রু লিপাসের সঙ্গে কথাও বলেন সুভাষ ভৌমিক। তাঁর পরিকল্পনায় মুগ্ধ হন লিপাস। যদিও কিছু কারণে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে যুক্ত হতে পারেননি। তবে, লিপাসের সুপারিশে পেশির উন্নতির জন্য অফ-দ্য-পিচ ইনপুট প্রচলন করেন সুভাষ ভৌমিক। লিপাস তাঁর জায়গায় ফিজিক্যাল ট্রেনার হিসাবে কেভিন জ্যাকসনকে পাঠান। তার পর তো ইতিহাস। ফাইনালে থাইল্যান্ডের ক্লাব বিইসি তেরো সাসানাকে ৩-১ গোলে হারিয়ে আসিয়ান কাপ চ্যাম্পিয়ন হয় সুভাষ ভৌমিকের ইস্টবেঙ্গল।

একটা পয়ামন্ত ব্যাপারও কিন্তু কাজ করেছিল। জাকার্তার গেলোরো বুং কার্নো স্টেডিয়ামে আসিয়ানের খেলাগুলো হয়। এই স্টেডিয়ামেই কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়াকে হারিয়ে ভারত এশিয়ান গেমস ফুটবলে শেষবার সোনা জিতেছিল ১৯৬২-তে। টুর্নামেন্টে ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড-সহ ১১টি দেশের ১২টি দল অংশ নেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ক্লাবগুলোর মধ্যে সম্ভবত এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ফুটবল টুর্নামেন্ট। আর তারপর তো রূপকথা। যা এঁকেছিলেন কোচ সুভাষ ভৌমিক। ঘানার সুলে মুসা, নাইজেরিয়ার মাইক ওকোরো, ব্রাজিলের ডগলাস ডি’সিলভাদের মতো চাবুক বিদেশিদের নিয়ে টিম এক্কেবারে তৈরি। দলে রয়েছেন বাইচুং ভুটিয়া, দেবজিৎ ঘোষও। তবে, সুভাষ ভৌমিক যখন প্রি-সেশনের জন্য হায়াত রিজেন্সির মতো ফাইভ স্টার হোটেলকে বেছে নিলেন, উপহাস কিন্তু তখনো জুটেছিল। কেউ কেউ তো বলেছিল, ক্লাবটা এবার দেউলিয়া হয়ে না যায়। এখন ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে।

ইস্টবেঙ্গল কোচ সুভাষ ভৌমিক

 

ফাইনালের দিনের কথায় আসি। সকালে উঠে দেখলাম, দু-তিন জায়গায় লাল-হলুদ পতাকা টাঙানো হয়েছে। মোড়ের মাথায় যে পতাকা টাঙানো হয়েছিল, সেটা ছিল সবচেয়ে বড়। ব্যায়াম সমিতি ক্লাবটার পুজো বেদিটা ঘেরা রয়েছে লোহার রেলিং দিয়ে। সেই রেলিংয়ে শোভা পেল পিচবোর্ডের ওপর বাইচুং, মুসা, ওমোলোদের ছবি। আরেকটা পিচবোর্ডের কাটিংয়ে বিরাট করে সুভাষ ভৌমিক। আয়োজন সাড়া। জিতলেই এই সবকিছু নিয়ে পাড়ায় বেরোনো হবে। স্বপনদা তো বলেই দিল, বড়বাজার থেকে ডাকা হবে তাসা। পুজোর ভাসানে যারা আসে, তাদেরকেই। সেই সন্তুর টিকিটুকু দেখা গেল না কিন্তু। তবে আমি-সহ অনেক মোহনবাগানিরা বেশ উপভোগ করছিলাম। সন্তুকে সেদিন না পেলেও আগের রাতে মেলা ইস্টবেঙ্গলের সাপোর্টারদের সামনে ও বলে দেয়, “তোরা পারবি না। ওরা তো এএফসি ফাইনালও খেলেছে। এই আসিয়ানেই তো তোরা বেক তেরোর ‘সাসানি’ সহ্য করতে পারিসনি। হেরে গিয়েছিলি। এত ফুর্তি কোথা থেকে আসে?” একটা কথা প্রসঙ্গত বলি, বিইসি (BEC) তেরো সাসানার ‘বিইসি’ আমাদের কাছে হয়ে গিয়েছি ‘বেক’। কিন্তু যে দল ফাইনালে পৌঁছে গেছে ইতিমধ্যেই, তার সাপোর্টাররা সন্তুর কথা ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে উড়িয়ে দিয়ে বিশেষ গা করল না। ম্যাচ নিয়েই ওদের বেশি উৎসাহ। নিজেদের মধ্যে ওই নিয়েই আলোচনা জারি রাখল। দলে বাইচুং থাকলেও ওদের বাজি কিন্তু ওকোরো। অ্যালভিটোর কথাও কেউ কেউ বলছিল। রক্ষণের ভরসা অধিনায়ক মুসাও তাদের ভরসার জায়গা। বেক তেরো সহজে লাল-হলুদ বক্সে ঢুকতে পারবে না। তাছাড়া রয়েছে বিজেন সিংয়ের দৌড়, যা ডিফেন্স কেটে ফালাফালা করে দেবে, এমনটাই আশা। কাপ যে আসছেই, একপ্রকার নিশ্চিত তারা। আমাকে দেখতে পেয়ে ম্যাচ দেখতে আসার আমন্ত্রণ জানাল। ব্যায়াম সমিতি ক্লাবেই বসবে আসর। দলবেঁধে ম্যাচ দেখা হবে। ২৬ জুলাই, শনিবার ছিল ফাইনাল। আগেই জানিয়ে রাখি, ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে সমর্থন করেছিলাম কিন্তু ক্লাবে নয়, খেলা দেখেছিলাম বাড়িতেই। খেলা শুরুর মুহূর্তে পাড়ার ক্লাবে শাঁখ বাজল। যেন বি আর চোপড়ার মহাভারত দেখতে বসেছি! ২০ মিনিটেই মাইক ওকোরোর গোল। ইস্টবেঙ্গল এগিয়ে গেল যখন, কানে ভেসে এলো সিটি, হুল্লোড়। উৎসবের মঞ্চ তখনই তৈরি। গোল করে টাচলাইনে ছুটে গেলেন ওকোরো। কোলে বাচ্চাকে দোলানোর মতো করে সেলিব্রেশনে মাতলেন সতীর্থদের সঙ্গে। মাত্র পাঁচটা দিন আগে বাবা হয়েছেন। আসিয়ান খেলছেন, তাই দেশে ফেরা হয়নি। গোল উৎসর্গ করলেন সন্তানকে। ৩-১ গোলে ফাইনাল জিতে নেয় ইস্টবেঙ্গল। বাকি দু’টি গোল লাল হলুদের পক্ষে করেন বাইচুং ভুটিয়া এবং অ্যালভিটো ডি’কুনহা। পাড়ায় বিজয় মিছিল, বাজি-পটকা, মিষ্টি বিতরণ সবই চলেছিল। আমার মতন মোহনবাগানিরাও শামিল ছিলেন বটে, তবে একটা লিমিট পর্যন্ত। আমরা শুভেচ্ছা জানিয়ে মিষ্টি খেয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। 

সেলিব্রেশনের মুহূর্তেও কেউ কেউ সেই পুরনো কাসুন্দি আউরাল। মানে, সেই ১৯১১-র সঙ্গে তুলনা। যা তখন বেশ বিব্রত করলেও এখন কিন্তু অনুভূতিটা অন্য রকম। কী সেই অনুভূতি, তা আমার ‘কোচ’ শুভ্রাংশু রায়ের কথা ধার করে বলব। তাঁকে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “১৯১১-র সঙ্গে তুলনার জায়গাটা আসলে তুলনার কোনো জায়গাই নয়। এই কথাটা আমি সুভাষদাকে বলেছিলাম। উনি আক্ষেপও করেছিলেন। ইস্টবেঙ্গলের এই জয়টা ভারতীয় ফুটবলের জন্য সেই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে  দারুণ একটি টেক অফ হতে পারত। সেই সময় বাঙালিদের মধ্যে নিওলিবারেল ইকোনমির সৌজন্যে গ্লোবাল বাঙালির ধারণা জনপ্রিয় হচ্ছিল। সেই সময় ইস্টবেঙ্গলের বিদেশের মাটিতে এই সাফল্য ধরে রাখতে পারলে তা কলকাতা এবং ভারতীয় ফুটবলকে এক অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিতে পারত। তাছাড়াও এই জয়টা নতুন এক যাত্রাপথের সূচকও। যদিও সেই শুরুটা হলেও তাকে ঠিকমতো ধরে রাখা গেল না। অন্যদিকে, সুভাষ ভৌমিক কেবলমাত্র আসিয়ান কাপ জিতেই চুপ থাকতে চাননি। এই টুর্নামেন্টে জেতার পর টাইগার কাপ খেলার জন্য প্রস্তুতিও শুরু করেছিলেন। ভারতীয় ফুটবলের পেশাদারিত্ব নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন সুভাষ ভৌমিক। বাজে মাঠে ফুটবল খেলা চলবে না, একথা ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিতেন সুভাষ ভৌমিক। কারণ ফুটবলাররা চোট পাচ্ছেন। সম্ভবত খারাপ মাঠের কারণেই চোট পেয়ে গিয়েছিলেন তুষার রক্ষিতের মতো প্লেয়ার। যাইহোক, আসিয়ান জয়ের পর ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কলকাতার একটা রিপ্রেজেন্টেশন হিসাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জায়গা করতে পারত। মনে রাখতে হবে, সেই সময় কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে শিল্পপতিদের একটা ইনভেস্টমেন্টের একটা সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছিল। সেই সম্ভাবনার ক্ষেত্রে আসিয়ান কাপ জয় বিরাট একটা টেকঅফ হতই। আর ১৯১১-র সঙ্গে তুলনা, এটা এক ধরনের পিছনে ফিরে তাকানো ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা আসলে ইতিহাসের মূর্খতা। এই জয় অতীত নয়, বরং সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সোপান ছিল। কলকাতা ফুটবল কিন্তু সেই ১৯১১... ১৯১১ করতে করতে সেই পিছনের দিকেই ফিরে গেল। আসিয়ান কাপের জয়কে কাজে না লাগানোর ব্যর্থতা আসলে লোকাল থেকে গ্লোবাল না হয়ে যাওয়ার গল্প।”

ছবি সৌজন্য- EAST BENGAL the REAL POWER (EBRP)

Powered by Froala Editor