ডায়মন্ড দত্ত থেকে চাতুনি পর্ব

“কী রে, চাতুনি তোদের চাটনি বানিয়ে দিল যে!” সেদিন ছোটনদা এক ইস্টবেঙ্গলের সমর্থককে ডেকে বলেছিল। সেদিন মানে ’৯৭-এর ফেড কাপের ফাইনালের দিন। ফাইনালে ফেভারিট হয়ে মাঠে নামা ইস্টবেঙ্গল সেদিন হেরে গিয়েছিল সালগাওকারের কাছে। মনে আছে, সেমির জন্য পুষে রাখা বারুদ সেদিন জ্বলে উঠেছিল আমাদের মনে। কিন্তু ওই, ফাইনাল হারলেও বিড়াল তো মেরেই রেখে দিয়েছিল ওরা। সব কথার শেষে ওরা একটা কমন কথা বলতই, “চার গোল খেয়ে এত আনন্দ আসে কোথা থেকে? সাধে তোদের মাচা বলি না।” আমি দূর থেকে অবাক হয়ে কথাগুলো শুনছিলাম। এক্কেরে আঁতে ঘা দিয়ে সে বেরিয়ে যেতেই ছোটনদাকে ডেকে সাদা মনে কাদা না রেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ও ছোটনদা, তোমাকে মাচা বলে গেল কেন গো? এর মানে কী?” 

ছোটনদা রেগেমেগে বলেছিল, “ধ্যাত্তারি, একে চার গোল খেয়েছি, তারপর তোর এমন উজবুকের মতো প্রশ্ন। আয় ক্লাবে।” কী বলে বসবে ছোটনদা তা ভাবতে ভাবতেই পাড়ার ক্লাবের মেঝেতে রাখা একটা জিনিসকে দেখিয়ে বলল, “এটা কী বল?”

―এটা তো পালতোলা নৌকা। মাঠে নিয়ে গেছিলে তোমরা। ভাগ্নেরা মিলে সব ঘটা করে বানিয়েছিলে।
―হ্যাঁ। এটা আমাদের প্রতীক। নৌকার মাচা থাকে। হয়তো তাই ওরা আমাদের... যা তো, আর জ্বালাসনি। ওদেরও এর ঠিক জবাব দেব।

ডিসিএম জয়ী মোহনবাগান ফুটবলাদের সঙ্গে কর্মকর্তা হারু মণ্ডল

 

আরও পড়ুন
সেই অমলময় দিনগুলি

এ যেন অনেকটা গুরুমারা বিদ্যার গল্প। অমল দত্তের অমন শক্তিশালী মোহনবাগানকে উড়িয়ে দিয়ে ’৯৭-এর ফেডারেশন কাপের ফাইনালে পৌঁছেছিল পিকে ব্যানার্জির ইস্টবেঙ্গল। আর ফাইনালে সেই পিকে ব্যানার্জির ইস্টবেঙ্গলকে হারতে হয়েছিল টিকে চাতুনির সালগাওকরের কাছে। এই টিকে-র এক সময়কার কোচ ছিলেন পিকে। সত্তরের দশকে চাতুনি যখন ইন্ডিয়া খেলছেন, সেই সময় কোচ ছিলেন প্রদীপ কুমার ব্যানার্জি। কেবল তাই নয়, চাতুনি তাঁকে কোচ হিসাবে পেয়েছিলেন জেসিটি মিলস কিংবা মোহনবাগানের হয়ে খেলার সময়েও। আর প্রিয় শিষ্যের কাছে যখন ফেডারেশন কাপের ফাইনালে হেরে গিয়েছিল লাল-হলুদ বাহিনী, তখন কিন্তু পিকে নিজে তাঁর একদা প্রশিক্ষণার্থী চাতুনির কাছে এসে সৌজন্য দেখিয়েছিলেন। শিষ্যের জন্য গর্বিত ছিলেন পিকে। তবে তা ছিল মাঠের কথা। মাঠের বাইরে ছিল অন্য কথা। ইস্টবেঙ্গল হেরেছে বলে আমাদের মুখে তখন বিশ্বজয়ের হাসি। তখনো কেউই ভাবতেই পারিনি যে, এই চাতুনিই পরের বছর কোচ হয়ে আসবেন। তার আগে ’৯৭-এই আরো কিছুক্ষণ থাকা যাক। মনে আছে, সেই সময় দেবজিৎ ঘোষ, বাসুদেব মণ্ডল, হেমন্ত ডোরা, অমিত দাসদের মতো তরুণ তুর্কিরা ইস্টবেঙ্গল থেকে মোহনবাগানে সই করেছিলেন। দলে ছিলেন চিমা ওকেরি, জেমস ওধিয়াম্বোর মতো বিদেশি। তাতে কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। ফেডারেশন কাপে হারার চেয়েও কষ্টটা বেশি হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলের কাছে হেরেছিলাম বলে। অমল দত্ত কিন্তু নিজের বিন্দুতেই স্থির ছিলেন। ডায়মন্ড সিস্টেমের বাইরে যাননি। এও মনে পড়ে, একমাস পর ইস্টবেঙ্গলকে এক গোলে হারালেও খচখচানি দূর হয়নি। তবে, এই ডার্বিতে ফেড কাপে হ্যাটট্রিক করা বাইচুংয়ের মার্কার হিসাবে অমল দত্ত রেখে দিয়েছিলেন দেবজিৎ ঘোষকে। একদম বোতলবন্দি হয়ে গিয়েছিল বাইচুং। আর তা দেখে বাবা বলে উঠেছিল, “ওদের পাহাড়ি বিছের হুল আজ ভোঁতা করে দিয়েছে দেবজিৎ।” যাই হোক, দীপেন্দু বিশ্বাসের শেষ মুহূর্তের হেড-গোলে ম্যাচ জিতে আমাদের মুখে হাসি ফুটলেও তেমন মুখরা হননি বাগান সমর্থকরা। কারণ ম্যাচের পরে চলেছিল রেফারি উদয়ন হালদার কেন আমাদের পরিষ্কার পেনাল্টি থেকে বঞ্চিত করলেন, তা নিয়ে আলোচনা। লোলেন্দ্র সিংকে যেভাবে জার্সি টেনে ধরে ধাক্কা মেরে আটকেছিলেন দেবাশিস পালচৌধুরি, তাতে হয়তো অতি বড় ইস্টবেঙ্গল সমর্থক থাকলেও নিজের বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে পেনাল্টির বাঁশি বাজাতেন। 

আরও পড়ুন
ময়দানি প্রেমের প্রথম দিনগুলি

টিকে চাতুনি

 

সেদিন মাঠে উপস্থিত প্রায় লক্ষাধিক দর্শক দেখেছিলেন রেফারির অমন উদ্ভট সিদ্ধান্ত। আর হ্যাঁ, রোশন পেরিরার বদলি হিসাবে মাঠে নেমেছিলেন দীপেন্দু। তাঁর মাথা ছুঁয়ে ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার কল্যাণ চৌবের পরিবর্ত হিসাবে তিন কাঠির দায়িত্ব সামলানো রাজনারায়ণ মুখার্জিকে ধোকা দিয়ে বল যখন নেট ছুঁয়েছে, যখন মোহন সমর্থকরা ফেড কাপের মধুর বদলা নেওয়ার প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছেন, সেই সময় তাল কাটল। লাল-হলুদ প্লেয়াররা তখন রেফারিকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। ইস্টবেঙ্গল কর্তারাও তাতে শামিল হয়ে মাঠে ঢুকে পড়েছেন। এ যেন ‘ধন্যি মেয়ে’ সিনেমার হাড়ভাঙা ক্লাবের সভাপতি গোবর্ধন চৌধুরির ইচ্ছার মতো ব্যাপার। যিনি চাইতেন শিল্ড গ্রামের বাইরে কখনো যাবে না। ইস্টবেঙ্গলের ভাবখানা ঠিক যেন এমনই ছিল। তবে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব খারাপ লাগাগুলো অনেক কমে যায়। কিন্তু ২ আগস্টে হওয়া এই ডার্বি ম্যাচ ঘিরে একটা খারাপ লাগা এখনো রয়ে গেছে। সেদিন প্রায় গোল করে ফেলা চিমাকে আটকাতে গিয়ে শঙ্করলাল চক্রবর্তী বড় চোট পেয়ে বসেন। আর খেলতে পারেননি তিনি। এই চোটটাই তাঁর ফুটবল কেরিয়ার অকালে শেষ হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ ছিল। যাই হোক, সেবারের কলকাতা লিগের ফিরতি ডার্বিতেও মোহনবাগানকে হারাতে পারেনি লাল-হলুদ ব্রিগেড। খেলা শেষ হয়েছিল গোলশূন্য অবস্থায়। সে-বছর কলকাতা লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মোহনবাগান। আবছা মনে পড়ে যেটুকু, শেষ ম্যাচে ইস্টার্ন রেলওয়েকে হারিয়েছিল সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। আর খেলা শেষে দীপেন্দুকে নিয়ে খুব মাতামাতি হয়েছিল। সবার মুখে ছিল একটা কথা, বাঙালি যেন তার নতুন স্বপ্নের ফুটবলারকে পেয়ে গেছে। সেবারের লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতাও ছিলেন দীপেন্দু। 

ফেড কাপ ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলকে হারানোর পর সালগাওকারের সতীর্থদের কাঁধে ব্রুনো কুটিনহো

 

অমল দত্তের সঙ্গে দীপেন্দু বিশ্বাস

 

এরপর টগবগ করে ফুটতে থাকা মোহনবাগান দিল্লি গেল ডুরান্ড কাপ খেলতে। দারুণ খেলতে খেলতে ফাইনালে গিয়ে ছন্দপতন ঘটল। আই এম বিজয়ন, জো পল আনচারির এফসি কোচিনের কাছে ১-৩ গোলে হেরে গেল মোহনবাগান। বাগান খেলোয়াড়দের আত্মবিশ্বাস তখন তলানিতে। খবরের কাগজে নিত্য তুলোধোনা চলছে গোষ্ঠ পাল সরণির ক্লাবটির। এরই মাঝে একটা খবর প্রকাশিত হল প্রায় সমস্ত বাংলা খবরের কাগজগুলিতে। অমল দত্ত নাকি আমাদের খেলোয়াড়দের নিয়ে আগ্রায় ঘুরতে চলে গিয়েছেন। ভারী অবাক লাগল। দল হেরে বসে আছে আর দল ঘুরতে গেছে। এটা কেমন হল! সেই ইস্টবেঙ্গলি পিন্টু আবার বলল, “ওরে ক্ষ্যাপা দ্যাখ একবার। মমতাজের শোকে তাজমহল বানিয়েছিল শাহজাহান। ডুরান্ড হারের শোকে আগ্রায় এবার 'অমল মিনার' তৈরি হবে।” কান গরম হয়ে গেল। পরে খোদ অমল দত্তের মুখে শুনেছিলাম হারের স্মৃতি ভুলিয়ে দিতে তিনি ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিলেন ফুটবলারদের। তাঁরা হালকা হয়েছিলেন। ফুরফুরে মেজাজে বহুদিন অংশ না নেওয়া ডিসিএম ট্রফিতে খেলতে নেমে ফাইনালে টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমিকে ২-০ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাগান। আর হ্যাঁ, সেমিফাইনালে কিন্তু মোহনবাগান ৩-১ গোলে এফসি কোচিনকে হারিয়ে ডুরান্ড হারের বদলা নিয়েছিল। কিন্তু এত সবের পরেও অমল দত্তের চাকরি চলে যায়। ডিসিএম-এর পর আইএফএ শিল্ড এবং রোভার্স কাপে প্রথম রাউন্ড থেকে ছিটকে যায় বাগান। কীভাবে যেন রোভার্স কাপে গটআপ বিতর্কে নাম জড়িয়ে যায় অমল দত্তের। সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে কোচের পদ থেকে। তাই মোহনবাগান কর্মকর্তারা ন্যাশনাল ফুটবল লিগ শুরুর আগে সালগাওকার থেকে একপ্রকার ‘হাইজ্যাক’ করে আনলেন টিকে চাতুনিকে। তা নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। গোয়ান ক্লাব আইনি পথ বেছে নিয়েছিল। নিয়মের গেঁড়াকলে পড়ে জাতীয় লিগের শুরুর কিছু ম্যাচ রিজার্ভ বেঞ্চে বসতে পারলেন না চাতুনি। আমাদের অবস্থা তখন আতুরে নিয়ম নাস্তি বালে বৃদ্ধে তথৈবচ। আবালবৃদ্ধ বাগান জনতা তখন ভাবছেন কখন শেষ হবে এমন নিয়মের গেরো। এমনই আবহে শুরু হল ন্যাশনাল ফুটবল লিগ― জাতীয় লিগ। রিজার্ভ বেঞ্চে বসতে না পেরে গ্যালারি থেকে কোচিং করাতে থাকলেন টিকে চাতুনি। রিজার্ভ বেঞ্চে প্রধান কোচ ছাড়া আমরা জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচে এক গোলে হেরে গেলাম এয়ার ইন্ডিয়ার কাছে। তারপর ঘটল বেশ কিছু মজার ঘটনা...

Powered by Froala Editor