'টু ডলার' রেফারিদের নানান গল্পস্বল্প

চৌরঙ্গি রোডের বাঁ-দিকে ঢুকে যাওয়া রাস্তাটা প্রেস ক্লাব প্যাথ। পথটা ধরে একটু এগোলেই প্রেস ক্লাব লেক। অনতিদূরে ঐতিহাসিক প্রেস ক্লাব। এর ডানেই ক্যালকাটা রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশন। আমাদের গন্তব্য ছিল একচিলতে ওই ঘরখানি। যেখানে যেতে হয় অনেকখানি সবুজ পেরিয়ে। দেবদারু, বট, অশথ, কৃষ্ণচূড়া, আম ইত্যাদি চেনা গাছগুলো হাতছানি দেয়। সেদিন আমগাছের কাণ্ড ঠোকরাচ্ছিল 'বন টিয়া' নীলগলা বসন্তবৌরি। নীল-সাদা সরকারি রঙের রেলিং রয়েছে অ্যাসোসিয়েশনের গেটের বাইরে। ভিতরে টিনের চালের তাঁবুর মতো ঘর, দেখে মনে হবে পাহাড়ি। বাইরেটায় বসার স্থায়ী বেঞ্চও রয়েছে। সরু পথ। অনিন্দ্যও (সানি) ছিল সঙ্গে। ঘরখানির ভিতরে ঢুকতে চোখে পড়ল কিংবদন্তি সব রেফারিদের ছবি। আমরা দেখা করব রেফারি মিলন দত্তের সঙ্গে। বহু কষ্টেশিষ্টে তাঁর ফোন নম্বর জোগাড় করা সম্ভব হয়েছে। নেপথ্যে অবশ্যই শুভ্রাংশুদা। মুঠোভাষে কথা বলার পর তাঁকে মনে হয়েছিল মাটির মানুষ। আর সেদিন, প্রায় বছর নয় আগে, তাঁর কথা শুনে নিজের পেশাদার জীবনও মিলে যাচ্ছিল। পেশাদার জগতে আমি প্রুফ রিডার। অত্যন্ত সম্মানের কাজ হলেও কোথাও গিয়ে বড্ড ‘থ্যাঙ্কলেস জব’। রেফারিংও অনেকটা তেমন। সামান্য ভুলে আপনি 'ভিলেন'। যাই হোক, শুরু করব একটা গল্প দিয়ে। যা সেদিন শুনেছিলাম মিলন দত্তের মুখে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়। রেফারিরা ম্যাচপ্রতি পেতেন দু'টাকা। রেফারি, লাইন্সম্যান সবারই একই মাইনে। এমনকী প্রথম ডিভিশন অবধি রেট একই। ষাটের দশকে কলকাতা লিগ শুরু হওয়ার আগে ‘পাওয়ার লিগ’ বলে একটা লিগ হত। যেখানে দলগুলো নিজেদের শক্তি যাচাই করে নিত। মরশুম শুরুর আগে নিজেদের দল কেমন তৈরি হয়েছে, সেটা দেখার আশায় পাওয়ার লিগের খেলাগুলোতে মাঠ সমর্থকে ভরে যেত। এই পাওয়ার লিগ ছিল খেলোয়াড়দের সঙ্গে রেফারিদেরও প্র্যাক্টিস। মিলন দত্ত বললেন, “এই পাওয়ার লিগে প্রতি ম্যাচ খেলানোর জন্য আমরা পেতাম আট আনা এবং এক বোতল লেমোনেড। ১৯৮৭ সালে আমি ইংল্যান্ড যাই কোর্স করতে। ইউরোপের অন্যান্য দেশ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, যেমন সৌদি আরব, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকেও অনেকে গিয়েছিলেন। আমি প্রথম ভারতীয় হিসেবে এই কোর্স করেছিলাম। একদিন সন্ধেবেলা ডিনারের পর আড্ডা হচ্ছে। হঠাৎ একজন জিজ্ঞেস করল, কোন দেশে কে কত টাকা মাইনে পাও? সেইসময় আরব দেশগুলোতে ম্যাচপ্রতি ১০০ ডলার মাইনে দেওয়া হত। এখন সেটা ৫০০ ডলারেরও বেশি। তখন এক ডলারের দাম ছিল ১৮-১৯ টাকা। আমাকেও যখন জিজ্ঞেস করা হল মাইনের কথা, অনেক হিসেব করে দেখলাম এক ডলারও তো হচ্ছে না। চক্ষুলজ্জার ভয়ে মাইনে বাড়িয়ে বলেছিলাম, ‘টু ডলার’। পরের দিন থেকে ক্লাসে আমার নাম হয়ে যায় 'টু ডলার রেফারি'। ভারতের রেফারিদের এরকমই করুণ অবস্থা ছিল তখন।”

মিলনবাবুর জীবনের এই ঘটনা শুনে গ্যালারি মনে পড়ছিল। যখন গ্যালারিতে বসে খেলা দেখি, রেফারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মাঝেমাঝেই অসন্তুষ্ট হই। তাঁদের তিরস্কার করতেও ছাড়ি না। গ্যালারিতে তখন রেফারি হয়ে ওঠেন একমাত্র 'ভিলেন'। বহুবার গ্যালারিতে বসে শুনেছি, ‘দু-পয়সার রেফারি শালা’ বলে জনতা রেফারিকে বেইজ্জতি করছে। মনে পড়ছে সেই সব অনাদরের দিন। যখন অসম্ভ্রমে নিজেরই রন্ধ্র শিথিল হয়ে আসে। প্রসঙ্গে ফিরি। মিলন দত্তের কাছে শুনেছি, পঙ্কজ গুপ্তকে ‘ফাদার অব রেফারিজ’ বলা হয়। তিনি হকি এবং ক্রিকেটের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। ১৯৫০-এর দশকে ইংল্যান্ড সফররত ভারতীয় ফুটবল দলের ম্যানেজার ছিলেন তিনি। ১৯৩৩ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় রেফারি হিসেবে শিল্ড ফাইনাল পরিচালনা করেন। অ্যাসোসিয়েশনের জন্মলগ্নে, ১৯৩২ সালে তিনি ছিলেন সহ-সভাপতি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৮ অবধি তিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি নিজে স্পোটর্স অর্গানাইজার ও সর্বভারতীয় ফুটবলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। পঙ্কজ গুপ্ত প্রথম ভারতীয় রেফারি হিসেবে অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হন। তখনকার বিখ্যাত ক্রীড়াবিদ কালু মিশ্র বক্সিং এবং ফুটবল খেলার পাশাপাশি রেফারিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন ১৯৬৪ সাল থেকে। মোহনবাগানের বিখ্যাত ডিফেন্ডার মন্মথ দত্ত সভাপতি ছিলেন ১৯৬৭-৬৮ থেকে। যতিশচন্দ্র গুহ ১৯৭৪ সালে সভাপতি হন। ১৯৭৭-৭৯— এই সময়ে মোহনবাগানের উমাপতি কুমার সভাপতি ছিলেন। তখনকার দিনে সাধারণত যাঁরা বাংলার ক্রীড়াজগতের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁরা কোনো না কোনোভাবে রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হওয়ার মূল মাপকাঠি হল, কমপক্ষে তাঁদের রেফারি হতেই হবে। ক্লাবের মতো বাইরের লোককে সভাপতি করা হয় না। উমাপতি কুমার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক ছিলেন ১৯৩৫ সালে। তখনকার দিনে প্রখ্যাত রেফারি অলোক রায়, সি পি চ্যাটার্জি— এঁরা সকলেই বিভিন্ন সময় অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তা হয়েছিলেন।

ভারতের প্রথম ফিফা রেফারি কে, জিজ্ঞেস করতেই মিলনবাবু বললেন, “প্রতুল চক্রবর্তী ছিলেন ভারতের প্রথম ফিফা রেফারি। ১৯৫৬ সালে তিনি প্রথম ভারতীয় রেফারি হিসেবে চিনে বিশ্বকাপ যোগ্যতা নির্ধারণকারী ম্যাচ খেলাতে গিয়েছিলেন। আমার দেখা বিখ্যাত রেফারিদের মধ্যে ছিলেন প্রতুল চক্রবর্তী, প্রভাত অরুণ সোম, নৃসিংহ চ্যাটার্জি, রবীন্দ্র কুমার দত্ত, দিলীপ সেন। এঁরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন সময় অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে এবং বিদেশে ম্যাচ পরিচালনা করেছেন। বাঘা সোম রেফারি হলেও মূলত কোচিং করাতেন। শৈলেন ভট্টাচার্য ছিলেন আর-এক ফিফা রেফারি। যিনি দিল্লিতে থাকলেও অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য ছিলেন। লক্ষ্মীনারায়ণ বোস ছিলেন ফিফা রেফারি। সুধীর চ্যাটার্জি এবং আমি নিজে ৫ বছর ফিফা রেফারি ছিলাম। সাগর সেন, দীলিপ সেন, সুমন্ত ঘোষ, প্রদীপ নাগ, গুলিনাথ পাইন, সুব্রত সরকার (অবসরপ্রাপ্ত, বিদেশে ম্যাচ খেলিয়েছেন), মৃণাংশু ভট্টাচার্য প্রমুখও রয়েছেন প্রিয় রেফারির তালিকায়।” আমাদের যেন উপরি পাওনা হচ্ছে এসব। মিলনবাবু জানালেন, বাংলার ফিফা সহকারী রেফারি বিপ্লব পোদ্দারের নাম। এর আগে ফিফা সহকারী রেফারি ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস মজুমদার, কালিদাস মুখার্জি গুণপতি রায়। মিলন দত্তের মুখের কথা নিয়ে বলতে হয়, “প্রথম বাঙালি মহিলা ফিফা রেফারি চৈতালি পাল। প্রথম বাঙালি সহকারী রেফারি অনামিকা সেন। বর্তমানে দু’জনেই অবসরপ্রাপ্ত। দু’জনেই স্বীকৃতি পেয়েছিলেন ২০০৫-০৬ সালে। এএফসি ইন্সট্রাক্টর হিসেবে প্রথম স্বীকৃতি পাই আমি, তারপর প্রদীপ নাগ, সুমন্ত ঘোষ, কর্নেল গৌতম কর। আমি ১৯৯২ সালে স্বীকৃতি পাই। প্রদীপ নাগ পান ১৯৯৭-এ, গৌতম কর ও সুমন্ত ঘোষ স্বীকৃতি পান ১৯৯৯ এবং ২০০১ সাল নাগাদ। এ ছাড়াও আমি একমাত্র ভারতীয় হিসেবে এএফসি রেফারি কমিটির সদস্য ছিলাম ২০০১ থেকে ২০০৬ অবধি। সর্বভারতীয় রেফারি বোর্ডের প্রথম বাঙালি সম্পাদক ছিলেন চন্দ্রভূষণ চ্যাটার্জি ষাটের দশকের শুরুর দিকে। এরপর আমি দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে রেফারি কমিটির সম্পাদক হই ১৯৯৭ থেকে ২০০১ অবধি। এরপর এআইএফএফ-এর রেফারি কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলাম ২০০৮ থেকে ২০১১ অবধি।”

এই মিলন দত্ত জুনিয়র লেভেলের রেফারি ছিলেন প্রতুল চক্রবর্তী রেফারি থাকাকালীন। সেই সময় ইস্টবেঙ্গল-ইস্টার্ন রেল বা এইরকম ছোটখাট ম্যাচে প্রতুলবাবুর সঙ্গে লাইন্সম্যান হিসেবে কাজ করেছিলেন মিলন দত্ত। যদিও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে প্রতুলবাবু রেফারি থাকাকালীন লাইন্সম্যান হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি তিনি। কে এই প্রতুল চক্রবর্তী? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে একটা কাকতালীয় ঘটনার কথা বলি। প্রতি রবিবার ‘প্রহর’-এর ‘রোববারান্দা’য় প্রকাশিত হচ্ছে ‘পায়ে পায়ে ময়দানে’। ষষ্ঠদশ পর্ব লেখার প্রস্তুতি চলছে। এই পর্বটায় ময়দানের রেফারিদের নিয়ে লিখব বলেও আমি তেমন এগোচ্ছি না। শুক্রবার হয়ে গেলেও বেশ 'খামোশ'। শুভ্রাংশুদা কেবল জানে যে, রেফারি নিয়েই লিখব আমি। কিন্তু কোনও উচ্চবাচ্য করছি না। শুক্রবার, ১৭ জুন, তার ফোনেই ঘুম ভাঙল। “রেফারি কদ্দূর?” কাঁচা ঘুম ভেঙেছে। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললাম, “কদ্দূর মানে? লেখা হলে তো দূরত্ব মাপব!” দাদা বললেন, “ওরে প্রতুল চক্রবর্তীর কথা কিন্তু লিখিস। ভারতের প্রথম ফিফা রেফারি রেফারি ছিলেন।” 'সে হবে ক্ষণ' বলে ফোনটা রেখে দিলাম। আড়মোড়া ভাঙতে মনে পড়ল, আরে এই প্রতুল চক্রবর্তীর কথাই তো শুনেছিলাম মিলন দত্তের কাছে। এই প্রতুল চক্রবর্তী প্রথম ভারতীয় হিসেবে বিদেশের মাটিতে প্রি-অলিম্পিক ম্যাচ খেলিয়েছিলেন বেজিংয়ে। তবে প্রতুলবাবর সঙ্গে আরো একটা নাম প্রসঙ্গত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নৃসিংহ চ্যাটার্জি। কারণ প্রতুল চক্রবর্তী মারডেকা কাপ ফাইনাল এবং এশিয়ান কাপের ফাইনাল খেলিয়েছিলেন নৃসিংহ চ্যাটার্জি। ভারতীয়দের মধ্যে বিদেশের মাঠে ফাইনাল ম্যাচ খেলানোর বিরল কৃতিত্ব এঁদের রয়েছে। মিলনবাবু বললেন, “সেই বড় ম্যাচে আমি লাইন্সম্যান হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে না পারলেও খেলাটা কিন্তু দেখেছি। ১৯৫৪ সালে শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান-হায়দরাবাদ ম্যাচে রেফারি ছিলেন প্রতুলবাবু। সেই খেলাও দেখেছি আমি। প্রতুলবাবুর চেহারা এবং ব্যক্তিত্ব খেলোয়াড়দের মধ্যে সম্ভ্রম ও সম্মান জাগাত। তখনও লাল কার্ডের ব্যবহার চালু হয়নি। কোনো খেলোয়াড় অপরাধ করলে তাঁকে মাঠের বাইরে চলে যেতে বলা হত। প্রতুলবাবুকে কখনো কোনো খেলোয়াড়কে মাঠ থেকে বের করে দিতে হয়নি, একবার তিনি কাউকে সতর্ক করে দিলে সেটাই ছিল যথেষ্ট। প্রতুল চক্রবর্তীর পর দ্বিতীয় সর্বাধিক সফল রেফারি ছিলেন নৃসিংহ চ্যাটার্জি। তখন লিগে দু’বার ইস্ট-মোহন ম্যাচ হত। বহুবার নৃসিংহবাবু সেই দু’টো ডার্বিই খেলিয়েছেন। তাছাড়াও প্রভাত অরুণ সোম বিদেশে প্রি-অলিম্পিক ম্যাচ খেলিয়েছেন। রবীন্দ্র কুমার দত্ত-ও বিদেশে ম্যাচ খেলিয়েছেন। তবে এঁদের মধ্যে সবচেয়ে সফল প্রতুল চক্রবর্তী এবং নৃসিংহ চ্যাটার্জি।” 

আরও পড়ুন
শিবাজি স্মৃতি এবং আই-লিগ

‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?’ “আমার অন্যতম অভিজ্ঞতা হিসেবে বলা যায়, ১৯৮৯ সালে ইস্ট-মোহন ম্যাচ খেলিয়েছিলাম। মোহনবাগান ২ গোলে জিতেছিল। শিশির ঘোষ দু’টো গোল করেছিলেন। ১৬ আগস্ট ইডেনের মর্মান্তিক ম্যাচের রেফারি ছিলেন সুধীর চ্যাটার্জি। পরের ম্যাচটিই ছিল মোহনবাগান বনাম মহামেডান। মহামেডানের হেভিওয়েট দল ছিল হাবিব-প্রসূন ব্যানার্জিদের নিয়ে তৈরি। আগের ম্যাচেই ওরকম একটা ট্রাজিডি ঘটে যাওয়ায় এই ম্যাচ নিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছিল। মহামেডানের অত ভালো দল থাকায় সেদিন মাঠে ভিড়ও হয়েছিল প্রচুর। সেই ম্যাচটি আমি পরিচালনা করি। দীর্ঘদিন পর সেবার মহামেডান ভালো দল তৈরি করায় ইস্ট-মোহনকে টপকে লিগ চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল। এ ছাড়া ’৮১ সালে মাদ্রাজে ইস্টবেঙ্গল-মহামেডান ফেডারেশন কাপ ফাইনাল ম্যাচ খেলিয়েছিলাম আমি।” এসব ইতিহাস খুঁড়ে আমাদের সামনে পেশ করলেন ১৯৪০ সালে জন্মানো মিলন দত্ত। তিনি কলকাতার মাঠে সাহেব ফুটবলারদের খেলতে দেখেছিলেন। তখন মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের কমন মাঠ ছিল। সেই সময় ‘ক্যালকাটা ফুটবল ক্লাব’ ছিল পুরোপুরি সাহেবদের ক্লাব। তাঁরা প্রতি রবিবার খেলত। কারণ, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল বড় বড় অফিসার। তাই সপ্তাহ জুড়ে খেলা তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এই সময় প্রথম ডিভিশন থেকে নেমে ক্লাবটি দ্বিতীয় ডিভিশনে খেলতে থাকে। দলটিতে ১১ জনই ছিলেন বিদেশি। তাঁর কাছেই জেনেছি, জার্মানি থেকে ‘বকুম ইলেভেন’ নামে একটি দল খেলতে এসেছিল এখানে। ‘আইএফএ একাদশ’-কে ৫-০ হারিয়েছিল। ওটা ছিল সুপার সকার সিরিজ। যা শুরু হয়েছিল ১৯৮৪-তে। তখন কলকাতা ছিল বাঁধা ভেন্যু। এখানে প্রত্যেকটি টিমের অন্তত একটি খেলা হবেই। আমরা কেবল আত্মবিস্মৃত। মিলনবাবু জানালেন, ২০১১-র ১৮ এপ্রিল রেফারি অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা দিবসে এই বর্ষীয়ান রেফারিকে লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। এই লক্ষ্মীনারায়ণ ঘোষ ছিলেন ’৭৭-এর মোহনবাগান বনাম কসমস, ওরফে ‘পেলে ম্যাচ’-এর রেফারি। মিলনবাবুর কথায় এরপর অভিমান ঝরে পড়ল। যদিও তার আগে জানালেন অনেক তারকা ফুটবলাররাই অবসর নেওয়ার পর রেফারি হয়েছেন। যেমন—বলাই চ্যাটার্জি, কে সি গুহ, উমাপতি কুমার প্রমুখ। বললেন, ”অনেক ফুটবলাররাই রেফারি হতে চান না। তাঁদের ধারণা, রেফারিং খুব একটা সম্মানের ব্যাপার নয়। আর একটা সমস্যা হল, এখন রেফারিদের ক্ষেত্রে বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ৩২ বছরের মাঠ রেফারির পরীক্ষায় বসতে হয়। কিন্তু খেলা ছাড়তে ছাড়তেই তো ৩৫-৩৬ বছর হয়ে যায়।” এবার নটেগাছটি মুড়োনোর পালা। শেষ করব প্রবাদপ্রতিম রেফারি সুশীল ঘোষের কথা দিয়ে। যা মিলনবাবু শুনেছিলেন খোদ সুশীল ঘোষের মুখ থেকে। “১৯৪৯ সাল। ইস্টবেঙ্গল বনাম এরিয়ান ম্যাচ। ম্যাচ পরিচালনার দায়িত্বে সুশীলদা। ম্যাচটি ইস্টবেঙ্গল হেরে হয়। কোপ পড়ে রেফারির উপর। আর কী, সমর্থকরা ক্ষোভ উগরে দেয় রেফারির ওপর। সুশীলদাকে মারধর করা হয়েছিল। যদিও সুশীলদা সেই ঘটনার স্মৃতি হিসেবে তাঁর ছেঁড়া জামাটা রেখে দিয়েছিলেন। নিজে রেফারি বলেই এমনসব বিচিত্র অনুভূতির কথা বুঝি।” ভাবি, এই চকমকি দুনিয়ায় ঝলসে যাচ্ছে আমাদের অতীত। তাও যদি বলার মতো ‘বর্তমান’ আমাদের থাকত! রেফারি অ্যাসোসিয়েশন থেকে যখন বেরোচ্ছি, সংলগ্ন মাঠটিতে এক মহিলা রেফারিকে খেলাতে দেখলাম। মিলন দত্ত বললেন, “উনিই অনামিকা সেন। তোমাদের বলেছি, উনি ভারতের প্রথম ফিফা সহকারী রেফারি। নাও, ফোন নম্বর নাও। আমি ওকে বলে দেব। টাইম ফিক্সড করে চলে যেও...”

আরও পড়ুন
মোহনবাগান এবং আমাদের সকলের আই-লিগ জয়

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
কৃষ্ণপদ গাঙ্গুলি এবং তাঁর মধ্যমগ্রাম হাইস্কুলের জয়গাথা