ময়দানি কুইজিন

‘দাঁড়া, সেনসেক্স নামলে খাবি।’ খিদেয় যখন পেট কামড়ে ধরেছে, শুভ্রাংশুদার এমন ফতোয়া জারি। কিন্তু যুবভারতীতে এই খেলার সময় বিক্রি হওয়া প্যাটিসের সঙ্গে সেনসেক্সের সম্পর্ক কী? প্রশ্ন করতেই সটান উত্তর, ‘একটা ঘণ্টা খিদে সহ্য কর, বুঝবি।’ আসলে সেদিনের ম্যাচটার হাফটাইমের পর খিদের চোটে প্যাটিস খেতে গ্যালারির ব্লকের বাইরেটায় যাব বলে প্রায় তৈরি। ওইখানটায় প্যাটিস বিক্রি হচ্ছে। চিকেন প্যাটিস ৩০ টাকা। যদিও চিকেনের সিকিকণা খুঁজে পেতে টেলিস্কোপের সাহায্য নিতে হয়। তবে, খিদের মুখে সেটুকুও অমৃত। যাইহোক, খেলা শেষ হতে ওই প্যাটিস-ওয়ালাকে দেখতে পেয়ে শুভ্রাংশুদা এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল দাম।
―১০ টাকা।
―দেখলি তো ময়দানি সেনসেক্স কেমন নেমে যায়…

আমি হাসলাম মাত্র। ব্যাখ্যায় গেলাম না। গলাধঃকরণ করলাম ‘চিকেনহীন’ চিকেন প্যাটিস।

ময়দানের ভিতর আরো এক ময়দানকে চেনা থাকলে এমন অনেক গল্প পাওয়া যাবে। তেমনি একজন পাশোয়ানদা। আচার বিক্রি করেন। মোহনবাগান ক্লাব তাঁবুর ঠিক পিছন দিকটায়। অনেকদিন ধরেই কলকাতায় আচার ফেরি করছেন। তাঁর বাড়ি বিহারের আরা নামে এক পুরসভা এলাকায়। ভোজপুর জেলার একটি শহর এই আরা। জায়গাটার নাম প্রথম শুনেছিলাম একটু অদ্ভুতভাবে। গোষ্ঠ পাল সরণির মোহনবাগান ক্লাব তাঁবু থেকে বেরিয়েই আমরা মাঝেমাঝেই যেতাম পাশোয়ানদার আচারের ঠেকে। একদিন তো শুভ্রাংশুদা ওনাকে দেখে আওড়াল, ‘আরা জিলা ঘরবা, কা চিজ কা ডরবা’ (আরা জেলায় বাড়ি, তাই কোনো কিছুতেই ভয় নেই)। শুনে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে অদ্ভূতুড়ে এক আইটেম তৈরিতে মন দিলেন শ্রীমান পাশোয়ান। চোখের সামনে দেখছি তেঁতুল, কুল আর আমড়ার আচারকে একসঙ্গে মিশে যেতে। এবং পাশোয়ানদার সঙ্গে শুভ্রাংশুদা দেশি হিন্দিতে কথা বলছে। এরই ফাঁকে পাশোয়ানদা লেবু চটকে হালকা করে লঙ্কাগুঁড়ো ছড়িয়ে দিলেন ওই আচারের মিশ্রণের ওপর। তারপর তো আরো চমক! কারণ এই মিশ্রণের ওপর ডাঁসা পেয়ারা কুঁচি কুঁচি করে কেটে সিদে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন উনি। খাব কী, এমন অদ্ভুত কম্বিনেশন দেখে আমার তো ভিমরি খাওয়া দশা! শুভ্রাংশুদা হেসে বলল, ‘আরে দেখছিস কী? খেয়ে নে। একে বলে ময়দানি কুইজিন।’ ইতস্তত ভাবে সেই অদ্ভুত ককটেল আইটেম চেখে বুঝলাম, আহা অমৃত! শুভ্রাংশুদা সেই অদ্ভুত আচারের সঙ্গে পেয়ারার টুকরো মিশিয়ে কামড় দিতে দিতে বলে উঠল, ‘বুঝলি জো পল আনচারিও প্যাকটিস থেকে বেরিয়ে এরকম একটা খাবার খেত। তবে পেয়ারাটা কিন্তু একদমই আমার নিজের সংযোজন।’ ততক্ষণে পকেট থেকে পয়সা মিটিয়ে দাদা গোষ্ঠ পালের স্ট্যাচুর দিকে হাঁটা দিয়েছে। আমিও কিছু মুহূর্ত পর উপলব্ধি করলাম, জীবনের সবচেয়ে বেশি না-পসন্দ পেয়ারা দিব্যি খেয়ে নিয়েছি পরিস্থিতি এবং শুভ্রাংশুদার ভোকাল টনিকে সম্মোহিত হয়ে।

আর হ্যাঁ, পাশোয়ানদার পাশেই বসতেন আর-এক আচারওয়ালা ইসমাইলদা। ওঁর বাবাও আচার বানাতেন। আমি ওনাকে দেখিনি। তবে, এই ইসমাইলদা ছিলেন পাশোয়ানদার এক্কেবারে বিপরীত― গম্ভীর প্রকৃতির। হাতের আচার ছিল তৃপ্তি দিয়ে মাখা। এই দুই ‘মহান’ আচারওয়ালার পাশে বসতেন কাঁচা পেয়ারা নিয়ে একজন। নামটা মনে নেই। ওই পেয়ারাওয়ালা আমার আর দাদার এইসব কীর্তি দেখে হাসতেন। মনে পড়ছে, ঘুগনি বিক্রেতা রাহুলের কথা। বসত, মোহনবাগান ক্লাব তাঁবুর ঠিক বাইরেটায়। বড় ম্যাচের টিকিট কিনতে ক্লাবে যাব। রাহুলদা বসেছে দেখে, ‘ওর দিকে এগোতেই বলত, আগে টিকিটটা নিয়ে এসো। তারপর খাও। জানোই তো সবটা… খানিক পরেই দেখবে টিকিট ফিনিশ।’ ঠিক তাই। চোখের সামনে টিকিট ‘ফিনিশ’ হতে যে কতবার দেখেছি, তার ইয়ত্তা নেই। টিকিট ফিনিশ হলেই হইহই ব্যাপার ঘটত। ‘দাদা, বহুদূর থেকে এসেছি। সেই বাগনান। একটা টিকিট দিন প্লিজ…’ অমন অনুনয়ে মন ভারী হয়ে গেলেও কিছু করার থাকত না। টিকিট ছাড়তে চাইতেন না কেউই। শেষমেশ নিজের টিকিট ব্যাগ বা পকেটের সুরক্ষিত জায়গায় রেখে রাহুলের বানানো ঘুগনিতে উদর-সন্তোষ মিটিয়ে রাস্তা পার হয়ে ৭৮/১ ধরে বাড়ি ফেরাটা ছিল বড় ম্যাচের আগে রুটিন।

আরও পড়ুন
সশরীরে বিশ্বকাপে

কখনো রঞ্জি দেখতে ইডেন যাইনি। শুভ্রাংশুদার মুখে শুনেছি, রঞ্জি ম্যাচের গ্যালারিতে ধুতি পরে চা বিক্রি করতে আসা তিওয়ারিদার কথা। শুভ্রাংশুদার মুখেই প্রসঙ্গত শুনলাম ঐতিহাসিক এক রঞ্জি ম্যাচের কথা। ’৯১-এর রঞ্জির কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি বাংলা বনাম কর্নাটক। তুমুল শক্তিশালী কর্নাটক দলে সৈয়দ কিরমানি, রাহুল দ্রাবিড়, ভি অর্জুন রাজা, জভগল শ্রীনাথ, ভেঙ্কটেশ প্রসাদ, রঘুরাম ভাট, অনিল কুম্বলের মতো তারকা খেলোয়াড়রা। কর্নাটক ৬ উইকেটে ৭৯১ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার ঘোষণা করে। কিরমানির সুইপ সজোরে গিয়ে লাগে শর্ট লেগে ফিল্ডিং করতে দাঁড়ানো স্নেহাশিস গাঙ্গুলির গোড়ালিতে। তৎক্ষণাৎ তাঁকে মাঠ ছাড়তে হয়। পরে হাসপাতালেও নিয়ে যেতে হয়। পঞ্চম দিনে কি ব্যাট করতে নামতে পারবেন? অনিশ্চয়তা। শেষদিনে সৌরভ গাঙ্গুলি আউট হতে দেখা গেল স্নেহাশিসকে ব্যাট হাতে নেমে পড়তে। তাঁর পায়ের সঙ্গে বুট এবং প্যাড একসঙ্গে বিশেষ এক পদ্ধতিতে বাঁধা। তিনি যে ব্যাট করতে নামবেন, একপ্রকার কেউই আন্দাজ করতে পারেননি। স্নেহাশিসের সঙ্গে রানার হিসেবে নামেন বাংলার অধিনায়ক প্রণব রায়। গোটা স্টেডিয়ামে তখন পিন পতন নীরবতা। প্রথম বলেই বাউন্সার। নড়তে বেশ অসুবিধা হচ্ছে স্নেহাশিসের… এরমধ্যে শ্রীনাথের একটা বল হেলমেটে গিয়ে সজোরে লেগেছে। এমনকী সেই হেলমেট ড্যামেজ হয়ে যাওয়ায় নতুন হেলমেটে ভরসা রাখতে হয়েছে। কিছুক্ষণ চলল ২২ গজের সেই মরণপণ লড়াই। এরপর জলপানের বিরতি। খেলা শুরুর পর জেদি স্নেহাশিস অর্ধশতরান পেরিয়ে গেলেন। চার-চারটে ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়ে ব্যাটিং করতে থাকা স্নেহাশিসকে দমানো যায়নি। এরইমধ্যে রেডিয়োয় গমগম করছে অজয় বসুর কণ্ঠস্বর, ‘এরপর শুরু হচ্ছে রুদ্ধশ্বাস ম্যান্ডিটরি ২০ ওভার।’ শুভ্রাংশুদা ওর মামার সঙ্গে তখন মোহনবাগান ক্লাবে। অমন ধারাবিবরণী শুনে ইডেনমুখো হয় তারা। তখন ধীরে ধীরে লোক বাড়তে শুরু করেছে। অনেকটাই ভরে উঠেছে ইডেন। শুভ্রাংশুদার কথায়, ‘রীতিমতো টেনশন! প্রায় সাত-আটবার চা খেয়ে ফেলেছি। আমি একা নই অনেকেরই এই দশা। চা বিক্রি করছিলেন সেই তিওয়ারিদা।’ ততক্ষণে ডবল সেঞ্চুরি করে আউট হয়ে গিয়েছেন শ্রীকান্ত কল্যাণী। এরপর একে একে সাজঘরের রাস্তা দেখেন শরদিন্দু মুখার্জি, উৎপল (ডেভিড) চ্যাটার্জি এবং দত্তাত্রেয় মুখার্জি। উইকেটে তখন স্নেহাশিসের সঙ্গে সাগরময় সেন শর্মা। ম্যাচ বাঁচাতে গেলে আরো দুটো ওভার টিকে থাকতে হবে তাঁদের। ‘ওই সময় চা বিক্রি ছেড়ে তিওয়ারিদাও পর্যন্ত খেলা দেখতে মশগুল।’ যোগ করল শুভ্রাংশুদা। শেষমেশ ম্যাচ বাঁচায় বাংলা। অপরাজিত ১১৬ রানের ঐতিহাসিক ইনিংস খেলেন স্নেহাশিস গাঙ্গুলি। 

আরও পড়ুন
৯ ডিসেম্বরের বাতিল ডার্বি: মাঠ থেকে দূরে অথচ মাঠের এত কাছে

এই ইডেনেরই ৮, ১০ কিংবা ১২ নম্বর গেটের কাছে ইডলি নিয়ে বসতেন রামাস্বামী। লোকজন ওনাকে ‘স্বামী’ বলতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। টালিগঞ্জের মনাদা কোকোকোলা স্টল দিতেন ইডেনে আন্তর্জাতিক ম্যাচের আগে। খোলা ময়দানে শুভ্রাংশুদার সঙ্গে হাঁটতে গিয়ে একজনকে দেখেছি হরলিক্স বিক্রি করতে। একজন ছিলেন, যিনি গরমে গ্লুকোন ডি বিক্রি করতেন। হালফিলে পরিচয় হয়েছিল ‘লজেন্স দিদি’র সঙ্গে। নিবাস আগরপাড়ায়। পোশাকি নাম যমুনা দাস। আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়েছিল ২০১৭-র শিলিগুড়ি ডার্বিতে, মাঠে ঢোকার আগে। ঝোলা ব্যাগে লজেন্স নিয়ে ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির দিকে যাচ্ছিলেন। প্রায় তিরিশ বছর ধরে লজেন্স ফেরি করছেন। ইস্টবেঙ্গলের খেলা হলে তাঁকে দেখা যাবেই লাল-হলুদ গ্যালারিতে। এখন অনেককিছুই চোখের সামনে ‘অতীত’ হয়ে যাচ্ছে। আইএসএল নামক কর্পোরেট টুর্নামেন্ট আসায় আই-লিগ দ্বিতীয় সারির টুর্নামেন্টের মর্যাদা পেয়ে যাচ্ছে রাতারাতি। এখন একটা প্যাটিস কিনতে গেলে পঞ্চাশ টাকার বেশি খরচ করতে হয়। সঙ্গে দিতে হয় জিএসটি। ফুটবল অবশ্যই বিনোদন দেয়। কিন্তু সেই বিনোদন কোনও মাল্টিপ্লেক্সে বসে একশো টাকায় পপকর্ন কিনে চিবোতে চিবোতে সিনেমা দেখার মতো নয়, একথা বোঝেনই বা ক’জন?

আরও পড়ুন
স্বপ্ন আর স্বপ্নভঙ্গের দিনলিপি

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
দলবদল নয় সরগরম 'টিকিট বদল'