‘নীরবতা’-র আইনে পার পেয়ে যায় অপরাধী, দিতে হয় ‘চুপ থাকার’ মাশুলও

হলিউডি সিনেমার সঙ্গে যাঁরা কমবেশি পরিচিত, তাঁদের কাছে এই দৃশ্য নতুন নয়। অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করছে পুলিশ এবং তাঁকে শোনানো হচ্ছে সতর্কবার্তা। এই মুহূর্তে কোনো কথা বলার অধিকার তাঁর নেই। কথা বললে, সেগুলি তাঁর বিরুদ্ধে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হবে। অভিযুক্তও নীরবতার সঙ্গে উঠে পড়ছে গাড়িতে। কিন্তু দৃশ্যটি চিরকাল এরকম ছিল না। এক জঘন্য অপরাধের সমাধান করতে গিয়ে আদালতের চোখে পড়ে আইনের ফাঁকটি। আর ‘অধিকার’-এর ফাঁক গলে প্রায় বেঁচেও যাচ্ছিল সেই অপরাধী। 

তার নাম আর্নেস্তো মিরান্দা (Arnesto Miranda)। আমেরিকার আরিজোনা (Arizona) প্রদেশে জন্মকর্ম। ১৯৬৩ সালে একটি আঠারো বছরের মেয়েকে অপহরণ ও ধর্ষণের অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। নৃশংস অপরাধ সন্দেহ নেই। পুলিশও অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া সমস্ত প্রমাণ আর্নেস্তোর বিপক্ষেই সায় দিচ্ছিল। প্রথমে অস্বীকার করলেও পুলিশের চাপে লিখিতভাবে সমস্ত অপরাধ কবুল করে নেয় সে। যেখানে লেখা ছিল, সে স্বজ্ঞানে কোনোরকম চাপের মধ্যে না এসে সমস্ত অপরাধ স্বীকার করছে। এবং এই স্বীকারোক্তি যে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে, সেই সম্বন্ধেও অবগত রয়েছে।

কাজ সহজ হয়ে যায় আদালতের পক্ষে। বিভিন্ন অপরাধের গুরুত্ব বিচার করে প্রায় ২০ থেকে ৩০ বছর হাজতবাস হতে পারে আর্নেস্তোর। কিন্তু বেঁকে বসেন তার উকিল। তিনি যুক্তি দেন যে, আর্নেস্তো মাত্র নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে। দেশের আইন সম্বন্ধে তার সঠিক ধারণা নেই। মানসিকভাবেও সম্পূর্ণ সুস্থ নয়। এগুলির সুযোগ নিয়ে পুলিশ তাকে দিয়ে জোর করে এই স্বীকারোক্তি লিখিয়েছে। এই চিঠি যে তার বিরুদ্ধে যাবে কিংবা তার যে উকিলের সঙ্গে কথা বলার অধিকার আছে, পুলিশ সে বিষয়ে কিছু জানায়নি আর্নেস্তোকে। এক অর্থে পুলিশও আইন বহির্ভূত কাজ করেছে।

আর্নেস্তো যে অপরাধী সেই নিয়ে কারোই সংশয় ছিল না। কিন্তু প্রশ্নটা ছিল অধিকার নিয়ে। প্রাথমিকভাবে তাকে সাজা দেওয়া হলেও মামলা চলে যায় উচ্চ আদালতে। শুরু হয় মামলা ‘আর্নেস্তো মিরান্দা বনাম আরিজোনা, ৩৮৪ ইউ. এস ৪৩৬ (১৯৬৬)’। যা প্রশ্ন তুলে দেয় আমেরিকার আইনি ব্যবস্থা নিয়ে। সংশোধন করা হয় ৫ ও ৬ নম্বর আমেডমেন্ট। যেখানে অভিযুক্তকে নীরব থাকা ও উকিলের উপস্থিতিতে পুলিশি জেরা বাধ্যতামূলক করা হয়। গ্রেপ্তারের সময়কার সাবধানবাণীর নামই হয়ে যায় ‘মিরান্দা ওয়ার্নিং’। সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে বিখ্যাত হয়ে যায় আর্নেস্তো। যার সুযোগে সে এক প্রকার ব্যবসা শুরু করে দেয়। নতুন আইন পোস্ট কার্ডে ছাপিয়ে, তাতে সই করে ‘মিরান্দা কার্ড’ চালু করে বাজারে। 

আরও পড়ুন
আদালতের আইনি নথিতে কমিকস, চমকে উঠলেন স্বয়ং বিচারপতি!

অপরাধ করেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠায় শেষ পর্যন্ত আর ‘সংশোধিত’ হয়নি তার জীবন। ফলে ১৯৭২-এ প্যারোলে মুক্তি পেলেও শেষ হয়নি ঘটনা। মুক্তি পেলেই একের পর এক ছোটো-বড়ো অপরাধ করতে থাকে সে। জেলে ফিরে যেন নিজেকে রাজার সমান মনে করত। প্রায়ই গণ্ডগোল বেঁধে যেত অন্য বন্দিদের সঙ্গে। ১৯৭৬-এ ঘটল সেরকমই এক ঘটনা। ইজেকুয়েল মোরেনো পেরেজ (Esequiel Moreno Perez) নামে যুবকের সঙ্গে রীতিমতো সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে সে। যার উত্তরে পেরেজ ছুরি দিয়ে খুন করে আর্নেস্তোকে। জেলের পুলিশ সবই জানত। ঘটনার দু-দিন পরেই সম্পূর্ণ অজানা এক কারণে তাকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। সুযোগ বুঝে পেরেজ পালিয়ে যায় মেক্সিকোতে। আর কোনোদিন ধরা পড়েনি সে।

আরও পড়ুন
ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড, সাউথ ক্যারোলিনার খসড়া আইনে বিতর্ক...

এই খুনের ঘটনায় জড়িয়ে ছিল রদরিগেজ নামে আরেক বন্দিও। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ছুরির জোগান দিয়েছিল সে। কিন্তু বিচারকালে চুপ করে বসে থাকে রদরিগেজ। প্রধান অভিযুক্ত পলাতক, সহকারী নীরব। পুলিশও খুব একটা সচেষ্ট ছিল না। ফলে শেষ পর্যন্ত শাস্তি হয়নি কারোরই। আর্নেস্তোর অস্ত্রেই তাকে ঘায়েল করেছিল রদরিগেজ। বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদেনি ঠিকই, সাজা পেয়েছিল অপরাধী। আইনের ফাঁক গলেই। 

চিত্রঋণ : The Hardy Law Firm

Powered by Froala Editor