আইনেও মেলেনি সমাধান, কবে থামবে ভারতের হাঙ্গর শিকার?

ভারতের অন্যতম ব্যস্ত বন্দর মুম্বাই জাহাজঘাটা। সারাদিন বন্দরের কর্তৃপক্ষও ব্যস্ত থাকে। তার মধ্যেই বছর তিনেক আগে বন্দর নিরাপত্তা কর্মীদের একজনের হঠাৎ সন্দেহ হয়। সন্দেহর উপযুক্ত কারণ অবশ্য কিছু ছিল না। সাধারণ শুকনো মাছ রপ্তানির (Exportation) জন্য জাহাজ ছাড়তে চলেছে। সেই জাহাজের মালের নমুনাও এসে গিয়েছে ইতিমধ্যে। কিন্তু দীর্ঘদিন কাজ করার ফলে অনুভূতির একটা জোর তৈরি হয়ে গিয়েছে অফিসারদের মধ্যে। আর সমস্ত প্যাকিং বাক্স খুলে পরীক্ষা করতেই বেরিয়ে এল আসল সত্য। শুকনো মাছ নয়, বরং শুকনো হাঙরের পাখনা (Shark Fin)।

সারা বিশ্বের বাজারে ক্রমশ বাড়ছে হাঙরের দাম। বিশেষ করে তার পাখনার দাম। আর ভারত মহাসাগরের, বিশেষত আরব সাগরের হাঙরের চাহিদার কথা তো আলাদা করে বলার কিছু থাকে না। কিন্তু ২০১৫ সালেই ভারতে হাঙর রপ্তানির ব্যাপারে কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। জীবন্ত হাঙর বা হাঙরের মাংস তো বটেই, তার কোনো দেহাংশও আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করতে গেলে নানা দপ্তর থেকে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। আর তার আগে এটাও নিশ্চিত করতে হয়, এই ব্যবসার জন্য কোনো জীবন্ত হাঙরের ক্ষতি করা হবে না।

তবে এসবের পরেও যে বাস্তব ছবিটা বদলায়নি, সেটা স্পষ্টই বোঝা যায় ২০১৮ সালের মুম্বাই বন্দরের ঘটনা থেকে। হাঙর রপ্তানি বে-আইনি ঘোষণার ৩ বছর পর ঘটে যায় এই ঘটনা। আর সামান্য কিছু পরিমাণ নয়। একটিমাত্র জাহাজ থেকে পাওয়া যায় প্রায় ৫ হাজার কেজি হাঙরের পাখনা। আর এই ঘটনার সূত্র ধরেই সামনে আসে একটি বড়ো চক্রও। জাহাজের কর্মীদের জেরা করে মুম্বাইয়ের একটি গুদামের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখান থেকে উদ্ধার হয় আরও ৬ হাজার কেজি হাঙরের পাখনা। আর এর পরেই সন্ধান পাওয়া যায় চেন্নাইয়ের একটি মূল কেন্দ্রের। সেখান থেকেই মুম্বাই শহরে হাঙরের পাখনা আমদানি করা হয়েছিল।

এই গোটা চক্রটিকে ধরতে কর বিভাগ এবং প্রশাসনের সময় লাগে মাত্র কয়েক মাস। তবে শুধু এই একটিই তো নয়। চারিদিকে আরও চক্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। চেন্নাই অঞ্চলে মৎস্যজীবিদের বক্তব্য অনুযায়ী, সেখান থেকেই হাঙরের পাখনা সংগ্রহ করে অন্তত ১০টি চক্র। এছাড়াও সমুদ্র তীরবর্তী অন্যান্য অঞ্চলগুলি তো রয়েছেই। আর এই সমস্ত বিপণনের অন্যতম বড়ো বাজার হয়ে উঠেছে হংকং শহর। হংকং শহর সমস্ত পৃথিবীর কাছে এক্সোটিক সামুদ্রিক জীবের এক বড়ো বাজার। আর হাঙরের পাখনার স্যুপ অত্যন্ত জনপ্রিয় খাদ্য। হংকং-এর বাইরেও কানাডা, আমেরিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে হাঙরের পাখনার যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, ভারত থেকে সরকারিভাবে যে পরিমাণ হাঙরের দেহাংশ রপ্তানি করা হয়, আর পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ভারত থেকে যে পরিমাণ হাঙরের দেহাংশ সরকারিভাবে রপ্তানি করে, তার মধ্যে একটা বড়ো ব্যবধান রয়েছে। সরকারিভাবে ভারত থেকে রপ্তানিকৃত হাঙরের দেহাংশের প্রায় ৩ গুণ অন্যান্য দেশগুলি আমদানি করে, এবং সরকারিভাবেই। সব মিলিয়ে তাই এটুকু বলাই যায়, চোরাশিকারীদের দৌরাত্মের পাশাপাশি সরকারি নিয়মেও বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে।

জাতিপুঞ্জের হিসাব বলছে গত ৫০ বছরে সারা পৃথিবীতে হাঙরের সংখ্যা কমেছে প্রায় ৭০ শতাংশ। আর তার বেশিরভাগটাই ঘটেছে ভারত মহাসাগর, বিশেষত আরব সাগর অঞ্চলে। অন্যতম বিপন্ন এই সামুদ্রিক প্রাণীটির অস্তিত্বের ওপর নির্ভর করছে জলজ বাস্তুতন্ত্রের একটা বড়ো দিক। এই পরিস্থিতিতে হাঙর শিকার কমিয়ে আনা না গেলে আগামীদিনে বহু সমস্যাই হাজির হতে পারে। আইনই যে শেষ কথা নয়, সেটা বোঝা গিয়েছে ইতিমধ্যেই। তাই সর্বস্তরে সচেতনতা গড়ে তোলার ওপরেই এখন জোর দিতে চাইছেন পরিবেশকর্মীরা।

Powered by Froala Editor