হতে পারত কোটিপতিদের বিনোদনকেন্দ্র, আজ তার পরিচয় ‘ভূতুড়ে শহর’

শহরজোড়া পেল্লাই সব অট্টালিকা দাঁড়িয়ে আছে পর পর। কোনোটির কাজ সম্পূর্ণ, কোনোটি-বা অর্ধনির্মিত। ধুলোয় মলিন হয়েছে বাড়িগুলির বাইরের আবরণ। কেউ নেই পরিষ্কার করার। কারণ, কোনো মানুষ থাকে না এখানে। প্রথম সাক্ষাতে মনে হবে যেন কোনো ‘ভূতুড়ে শহর’ (Ghost Town)। অথচ সব পরিকল্পনামাফিক চললে শুধুমাত্র কোটিপতিরাই ঘুরে বেড়াতেন এই শহরের বুকে। তাদের কথা মাথায় রেখেই তৈরি করা হচ্ছিল এই অত্যাধুনিক আবাসন প্রকল্প। আপাতত এখানে আস্তানা গেড়েছে গরু-মহিষের দল।

চিনের রাজধানী বেজিং থেকে শেনইয়াং (Shenyang) প্রদেশের দূরত্ব প্রায় ৬০০ কিলোমিটার। ২০১০ সাল নাগাদ চিনের রিয়াল এস্টেট সংস্থা ‘গ্রিনল্যান্ড গ্রুপ’ সেখানে একটি বিরাটাকার আবাসন বানানোর কাজ শুরু করে। যেখানে থাকবেন শুধু কোটিপতিরা। ঝাঁ চকচকে ইউরোপীয়ান স্টাইলের প্রাসাদে থাকবে বিলাসের আয়োজন, চওড়া রাস্তা দিয়ে ছুটে যাবে নামি-দামি সব গাড়ি, আধুনিক পরিষেবায় স্থান থাকবে না কোনো অভিযোগের। চিনের মধ্যে এক স্বপ্নের শহর হয়ে উঠবে শেনইয়াং। যার নাম ছিল ‘স্টেট গেস্ট ম্যানসনস’ (State Guest Mansions)। সেই অনুযায়ী হাত দেওয়া হয় ২৬০টি আবাসন তৈরির কাজে। 

কিন্তু ২০১২-র পর আচমকাই বন্ধ হয়ে যায় শহরের কাজ। অধিকাংশ প্রাসাদেরই নির্মাণকাজ তখন প্রায় সমাপ্ত। সব ফেলে রেখে পিছু হটে ‘গ্রিনল্যান্ড গ্রুপ’। ক্রমে ধুলো আর আবর্জনা গ্রাস করে নেয় শেনইয়াং-এর এই অঞ্চলকে। খসে পড়তে থাকে পলেস্তারা, নোংরা হতে থাকে দেওয়ালের সুদৃশ্য কারুকার্য। অবশেষে স্থানীয় কৃষকরা ‘দখল’ করে নেয় শহরটি। যেখানে হয়তো উচ্ছ্বাসের ফোয়ারা ছুটতে পারত, সেই বিরাট উঠোনে কোনো গরু আজ নিঃশব্দে ঘাস চিবোয়। কিংবা যে প্রকাণ্ড হলরুমে সারা রাত জুড়ে জমতে পারত নাচ-গানের আসর, এখন তার প্রতিটি কোণে পড়ে আছে স্থানীয় পশুপালকদের জীননযাপনের চিহ্ন। কিন্তু ‘স্টেট গেস্ট ম্যানসনস’-এর এই পরিণতি কেন হল?

সঠিক উত্তর দিতে পারছে না কেউই। চিনের সরকারও এ ব্যাপারে কুলুপ এঁটেছে মুখে। তবে, স্থানীয় পশুপালকদের উত্তর অত্যন্ত পরিষ্কার। আর তা হল দুর্নীতি। শেনইয়াং-এর প্রকল্প পাওয়ার আগেই ‘গ্রিনল্যান্ড গ্রুপ’ দেনায় ডুবে ছিল। তার হাত থেকে বাঁচতেই এই আবাসন নির্মাণকালে তারা টাকাপয়সার কারচুপি শুরু করে। খবর পৌঁছোয় চিন সরকারের উচ্চমহল পর্যন্ত। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে গ্রিনল্যান্ড গ্রুপের সমস্ত অনুমতিতে বিধিনিষেধ জারি করা হয়। বিশ বাঁও জলে ডুবে যায় শেনইয়াং-এর স্বপ্নের আবাসন প্রকল্প।

আরও পড়ুন
যে শহরে মাটির নিচেই বসবাস মানুষের

একই সঙ্গে উঠে আসে অন্য মতামতও। চিনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট শি জি-পিং রাজনৈতিক ক্ষমতায় বসেন ২০১২ সালেই। অর্থ ও সম্পদের দেখনদারি তাঁর নাকি একদম পছন্দ নয়। বিশেষত কোটি কোটি টাকার রিয়েল এস্টেটের ব্যবসা পুঁজির অপব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে শুধু শেনইয়াং নয়, চিন জুড়ে এরকম অসংখ্য বিলাসবহুল শহরের প্রকল্প বর্তমানে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ২০২১-এর ‘রোটেন টেইল বিল্ডিংস’ যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। আকাশছোঁয়া বাড়িগুলি একা দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। যে আবাসনে ঢুকে যেতে পারে অর্ধেক প্যারিস। শুধুমাত্র চিন সরকারের নীতির জন্য আপাতত পরিত্যক্ত এই প্রকল্পটিও।

আরও পড়ুন
ব্যক্তিগত বিমানে চেপেই প্রতিদিন কাজে যান এই শহরের বাসিন্দারা

অনেকের মতে, শেনইয়াং-এর আবাসনগুলিকে এভাবে ধ্বংস না করে তুলনায় মধ্যবিত্তদের হাতে অল্প দামে তুলে দেওয়া যেত। কিন্তু, এগুলি সাধারণের জন্য আদৌ এগুলি বানানোই হয়নি। আর এই রাজকীয় আয়োজন সস্তায় বিক্রিও করতে চায়নি লগ্নিকারী সংস্থাটি। ‘ভূতুড়ে’ শহর হিসেবে খ্যাতি হোক, তবু ‘লোকসান’ করতে তারা রাজি নয়। সরকারও আবাসনটি অধিগ্রহণ করতে খুব একটা উৎসুক নয়। ফলে শেনইয়াং আপাতত পশুখামার। মানুষ যাকে অর্ধেক রূপ দিয়ে ফেলে রেখে গেছে, তার দায়িত্ব নিয়েছে প্রকৃতি। রাস্তায় চলছে চাষাবাদ। পরিচর্যার অভাবে মলিন হয়ে যাওয়া বারান্দার সুদৃশ্য মেঝেতে বসে আছে কোনো গৃহপালিত পশু। ‘ভূতুড়ে’ নামে খ্যাতি পেলেও প্রাণের স্পর্শ কিন্তু রয়েই গেছে শেনইয়াং-এ।

Powered by Froala Editor