জঙ্গলের মধ্যে পরিত্যক্ত শহর! লুকিয়ে কোন ইতিহাস?

পর্যটকই হোক কিংবা ঐতিহাসিক— দক্ষিণ মেক্সিকোর সমুদ্র তীরবর্তী ইউকাটান অঞ্চল সকলের কাছেই স্বর্গরাজ্য। হ্যাঁ, এই ইউকাটানেই একসময় গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। আর সেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন দেখতেই সেখানে প্রতি বছর ভিড় জমান হাজার হাজার মানুষ। তবে মায়াদের এই সাম্রাজ্যের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে আরও একটি সভ্যতা। না, সেটি অত পুরনো নয়। বরং, এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল আঠেরো-উনিশ শতকে। বয়সের নিরিখে আমাদের কলকাতার সমবয়সী হলেও, এই শহরগুলি আজ পড়ে রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। 

মায়া সভ্যতার থেকে ইউকাটানের এই মধ্যযুগীয় শহরগুলিও কম আকর্ষণীয় নয় কোনো অংশেই। তবে এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পর্যটকদের দৃষ্টি কাড়েনি উনিশ শতকের এই শহরগুলি। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কীভাবে জনশূন্য হয়ে পড়ল এই নগরী? কেন সভ্য মানুষের ছাপ মুছে গেল এই রাজ্য থেকে?

বলতে গেলে আঠেরো শতকের শেষের দিকে ইউকাটানে বিচ্ছিন্নভাবে এই শহরগুলি গড়ে উঠেছিল চাষাবাদকে কেন্দ্র করে। মূলত, হেনিকুইনের চাষ হত এই অঞ্চলে। একদিকে যেমন ভেষজ ঔষধ তৈরিতে ব্যবহৃত হত এই গাছ, তেমনই হেনিকুইন তন্তুর মাধ্যমে তৈরি হত দড়ি। এই দড়ি বিক্রির টাকাতেই রীতিমতো ফুলে ফেঁপে উঠেছিল মেক্সিকোর এই অঞ্চলটি। 

মেক্সিকোর মেরিডা থেকে হোমুন শহরের মধ্যবর্তী ৬০ কিলোমিটার প্রশস্ত অঞ্চলজুড়ে অরণ্য কেটে সে-সময় গড়ে উঠেছিল বহু শহর। তবে শহর না বলে তাদের দেশ বললেও ভুল হয় না খুব একটা। মেক্সিকোর মূল ভূখণ্ডের মধ্যেই ছোটো ছোটো স্বতন্ত্র দেশ। কারণ, প্রতিটি শহরেই ছিল পৃথক পৃথক আইন, নিয়ম-কানুন, সংস্কৃতি। এমনকি এই শহরগুলির মধ্যে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যও চলত আন্তর্জাতিক ঢঙে। 

১৯৫০ সালের পর ধীরে ধীরে কারখানা গড়ে উঠতে থাকে মেক্সিকো-জুড়ে। নাইলন কিংবা অন্যান্য রাসায়নিকের ব্যবহারে শুরু হয় দড়ি তৈরির প্রক্রিয়া। প্রযুক্তির সামনে মুখ থুবড়ে বড়ে এই শতাব্দীপ্রাচীন মেক্সিকান ব্যবসা। ধীরে ধীরে প্রতিপত্তি হারান ইউকাটানের জমিদাররা। প্রথমে কাজের খোঁজে শহর ছাড়েন এখানকার দরিদ্র শ্রমিকরা। পরে রাজত্বের পাট চুকিয়ে মেক্সিকোর বাণিজ্য শহরগুলিতে স্থানান্তরিত হন জমিদাররাও। 

সাত দশক পেরিয়ে এসে আজ জনশূন্য অবস্থায় পড়ে রয়েছে সে-সময়ের প্রাচীন প্রাসাদ, সাধারণের জনবসতি। মানুষের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে মানুষের এই আদিম বাসস্থান। সাম্প্রতিক সময়ে পরিযায়নের সমস্যা থাবা বসিয়েছে গোটা মেক্সিকো জুড়ে। রাজনৈতিক টালবাহানা, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, বাসস্থানের অভাবে দেশ ছাড়ছেন বহু মানুষ। তবে সরকার সামান্য উদ্যোগ নিলেই এই অঞ্চলগুলি অনায়াসেই হয়ে উঠতে পারত তাঁদের থাকার জায়গা। প্রাচীন প্রাসাদগুলির সংরক্ষণে গড়ে উঠতে পারত পর্যটনকেন্দ্রও। কিন্তু তেমনটা আর হচ্ছে কই!

Powered by Froala Editor