ছয়শো বছর পুরনো একটি ঘড়ি। আজও চলছে টিকটিক করে। চেক প্রজাতন্ত্রের প্রাগ (Prague) শহরে যারা ঘুরতে আসেন, তাদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ ‘অরলোজ’ নামের এই ঘড়িটি। যার আরেক নাম ‘দ্য ডেভিলস আই’ (The Devil's Eye)। রোজ হাজারো লোক জমা হয় এই দীর্ঘায়ু ঘড়িটি দেখতে। কেন? শুধুই কি পৃথিবীর প্রাচীনতম সক্রিয় ঘড়ির আশ্চর্যভাবে বেঁচে থাকা দেখতে? সেটা একটা কারণ তো অবশ্যই, তবে এর মূল বিশেষত্ব জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক থেকে। একই সঙ্গে মুগ্ধ করবে ঘড়িটির রঙ ও নকশার অপূর্ব কারুকার্য। আর তাতেও মন না ভরলে শুনতে হবে, ঘড়িটির সঙ্গে জুড়ে থাকা অসংখ্য গল্প। যার কোনোটি সত্যি, কোনোটি বা নিতান্তই লোককাহিনি।
১৪১০ সালে তৈরি হয় এই অদ্ভুত ঘড়িটি। কিন্তু এর নির্মাতা কে, তা নিয়েও আছে গল্প। সে কথায় না হয় পরে আসা যাবে, আগে দেখা যাক ঘড়িটির আসল কাজকর্ম। শুধু সময় বলা এর কাজ না। মধ্যযুগের ইউরোপের কোনো ঘড়িকেই শুধু সময়ের হিসেবনিকেশ রাখার জন্য তৈরি করা হত না। ‘অরলোজ’ একটি জ্যোর্তিবিদ্যা-সম্পর্কিত ঘড়ি (Astronomical Clock)। যে একই সঙ্গে দেবে দিন, রাত, তারিখ, মাসের খতিয়ান। জানা যাবে চন্দ্র-সূর্যের অবস্থানও। তবে হ্যাঁ, তখনও পৃথিবীকে মহাকাশের কেন্দ্রে রেখেই হত জ্যোর্তিবিজ্ঞানের চর্চা। ফলে অরলোজ-ও কাজ করে সেই পদ্ধতিতেই। তার দেওয়া সেই সব তথ্য অনুযায়ী নির্ধারিত হত খ্রিস্টানদের পবিত্র দিনগুলি।
ঘড়ির সারা দেহে ছড়িয়ে রঙের বাহার। নীল-লাল রঙের মিশেলে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধির পাশাপাশি চলে দিন-রাতের হিসেবও। সূর্যের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে মাঝের একটি ছোটো ডায়ালে রয়েছে বারোটি রাশির চিহ্ন। মাঝে বেশ কয়েকবার বন্ধ হয়ে গেলেও এখন দিব্যি সময়ের কথা বলে যাচ্ছে ‘অরলোজ’। এর নীচের অংশে রয়েছে আরেকটি নীল ডায়াল। সেটিতে আঁকা রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মের বিভিন্ন ধর্মীয় রীতিনীতির ছবি। আর একেবারে উপরে দুটি নীল দরজা রয়েছে। দিন-রাতের একটি নির্দিষ্ট সময়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে কয়েকটি মূর্তি। আর ঘণ্টা বাজে—ঢং! মৃত্যুর পদধ্বনি কি?
এবার ঢুকে পড়া যাক ‘অরলোজ’-এর রহস্যে। মূল ডায়ালটির বাইরেও রয়েছে ৮টি কাঠের মূর্তি। অনুমান, চারটি মঙ্গলের ও চারটি অমঙ্গলের দূত রূপে কাজ করে যাচ্ছে তারা। রয়েছে একটি কঙ্কালও। ২০১৮ সালে প্রাগের কর্তৃপক্ষ পরিষ্কার করছিলেন ভিতরের মূর্তিগুলি। তাদের মনে হয়, সেন্ট থমাস-এর মূর্তিটি অন্যগুলির তুলনায় ভারি। এরকম তো কোনোদিন হয়নি। অবিলম্বে এক্স-রে করা হয় মূর্তিটি। দেখা যায়, ভিতরে আছে একটি ধাতব কৌটো। যার মধ্যে লুকোনো একটি চিঠি। পরীক্ষায় জানা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক ভাস্কর মূর্তিগুলির রক্ষণাবেক্ষণের সময় করেছিলেন এই কর্মটি। চিঠিতেও আহামরি কোনো গুপ্তকথা ছিল না। কিন্তু কীভাবে যে করলেন আর কেনই বা করলেন, তার উত্তর মেলেনি।
আরও পড়ুন
৪৮ ঘণ্টায় ২০০০ ঐতিহাসিক ঘড়ির সংরক্ষণ, নজির দুই ব্রিটিশ ‘ক্লক-ম্যান’-এর
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে চলে যাওয়া যাক ঘড়ির নির্মাণকালে। আর তার সঙ্গেই জড়িয়ে প্রতিশোধ আর অভিশাপের রহস্যময় গল্প। প্রচলিত গল্প অনেকটা এরকম যে, ঘড়িটি বানিয়েছিলেন হানুস বলে এক ব্যক্তি। নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হল, সারা শহর ভেঙে পড়ল অপূর্ব ‘অলরোজ’-কে দেখতে। কিন্তু প্রমাদ গুণলেন নগরপ্রধান (গল্পান্তরে রাজা)। অন্য দেশেও যদি এরকম ঘড়ি বানানো হয়, তাহলে তো প্রাগের গরিমা কমে যাবে। অতএব, হানুস-কে অন্ধ করে দেওয়া হোক। পোষা গুন্ডাদল দিয়ে চোখে লোহার শিক ঢুকিয়ে নষ্ট করে দেওয়া হল তাঁর চোখ। এবার শুরু হল প্রতিশোধের পালা। কিছুদিন পর এক ছাত্রের সাহায্যে হানুস অকেজো করে দিলেন ঘড়িটি। সঙ্গে দিয়ে রাখলেন অভিশাপ। পরের প্রায় একশো বছর বন্ধ থাকে ঘড়িটি। আর পরবর্তীকালে যখনই প্রাগে বিপদ এসেছে, তখনই নাকি নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে যেত সে।
আরও পড়ুন
ছত্তিশগড়ের এই গ্রামে ঘড়ির ঘোরে উল্টোদিকে!
সেই থেকে ঘড়িটির নাম হয়ে যায় ‘দ্য ডেভিলস আই’ বা শয়তানের চোখ। তবে পরবর্তী গবেষণায় পাওয়া গেছে অন্য তথ্য। হানুস নয়, ঘড়িটি বানিয়েছিলেন ‘মিকুলাস’ নামের একটি ঘড়ি প্রস্তুতকারক সংস্থা। ফলে হিংসা আর প্রতিশোধের গল্পটি প্রায় আবর্জনার স্তূপে যেতে বসে। তবে, যুগ যুগ ধরে তৈরি হওয়া গল্পকথাগুলো তো এভাবে ফুরিয়ে যায় না। তথ্য যাই বলুক, হানুসকে সামনে রেখেই আজও ভিড় জমে ওঠে প্রাগের রাজপথে। ঘড়ির প্রতিটি কাঁটা আর ঘণ্টাধ্বনিতে লেগে থাকে ‘অন্ধ’ হানুসের হাতের স্পর্শ।
Powered by Froala Editor